ইসলামাবাদ, 10 অক্টোবর : দীর্ঘ রোগভোগের পর 85 বছর বয়সে প্রয়াত হলেন পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার বিতর্কিত জনক আব্দুল কাদির খান (Abdul Qadeer Khan) ৷ পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ (Sheikh Rasheed Ahmad) জানান, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ইসলামাবাদের কেআরএল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি । ইসলামাবাদেরই একটি মসজিদে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করার কথা রয়েছে ৷
সত্তরের দশকের শুরুতে পরমাণু বোমার ফর্মুলা পাচারের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে ৷ সেই সময় তিনি নেদারল্যান্ডে পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে কর্মরত ছিলেন ৷ দেশে ফেরার আগে থেকেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন ৷ কার্নেগি এন্ডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের (Carnegie Endowment for International Peace) গবেষণা অনুযায়ী, আব্দুল কাদিরের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ড থেকে প্রযুক্তি চুরির অভিযোগ ওঠে ৷ অভিযোগে দাবি করা হয়, এই প্রযুক্তি তিনি পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহারের জন্য চুরি করেছেন ৷
বেলজিয়ামের ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব লিউভেন থেকে ধাতুবিদ্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন আব্দুল কাদির ৷ ভারত 'শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিস্ফোরণ' ঘটানোর পরই 1974 সালে পাকিস্তানে পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করেন আব্দুল কাদির ৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর (Zulfikar Ali Bhutto) কাছে পাকিস্তানের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জন্য প্রযুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন । 1971 সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার অশান্তির মধ্যেও জুলফিকার প্রতাবটি গ্রহণ করেন ৷ তিনি বলেছিলেন, "আমরা (পাকিস্তানিরা) ঘাস খাব, এমনকি ক্ষুধার্তও থাকব, কিন্তু আমাদের নিজস্ব (পারমাণবিক বোমা) থাকবে ।" তারপর থেকে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে মিলে তার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি চালিয়ে গিয়েছে । 1998 সালে পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানোর পর দুই দেশকেই পারমাণবিক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয় ।
পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং তার সঙ্গে আব্দুল খানের জড়িয়ে থাকার বিষয়টি প্রথম থেকেই সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় ৷ নব্বইয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে ইরান এবং উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নথি পাচারের অভিযোগ আনে ৷ প্রতিবেশী আফগানিস্তান 10 বছর ধরে সোভিয়েত দখলে থাকার সময় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতিরা জানান, পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছিল না । মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের এই শংসাপত্র জরুরি ছিল আমেরিকান আইনের অধীনে পাকিস্তানের মাধ্যমে কমিউনিস্ট বিরোধী বিদ্রোহীদের মার্কিন সহায়তা দেওয়ার জন্য ৷ কিন্তু 1990 সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মাত্র কয়েক মাস পরও আমেরিকার তরফে পাকিস্তানকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয় ৷ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু নথি পাচারের অভিযোগ আনে তারা ৷
তবে এসবের পরও পাকিস্তানে আব্দুল কাদির খানকে বীর এবং দেশে পারমাণবিক বোমার জনক হিসাবে মানা হয় ৷ উগ্র ধর্মীয় দলগুলি তাঁকে একমাত্র ইসলামী পারমাণবিক বোমার জনক বলেও অভিহিত করেছিল । পাকিস্তানের স্বৈরশাসক পারভেজ মোশারফ (Pervez Musharraf) 2001 সালের পর আব্দুল কাদিরকে প্রত্যাখ্যান করেন ৷ সেই সময় তাঁর পরমাণু নথি পাচারের বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত শুরু করা হয় ৷ তবে আব্দুল কাদির বরাবরই দাবি করে এসেছেন, তিনি পরমাণু নথি পাচারেরে মতো কোনও কাজে জড়িত থাকেননি ৷
ইদানীং লোকচক্ষুর আড়ালে জীবনযাপন করছিলেন আব্দুল কাদির ৷ এদিন তাঁর মৃত্যুত পর তাঁর সহকর্মী বিজ্ঞানী এবং পাকিস্তানি রাজনীতিকরা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ৷ প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান (Imran Khan) তাঁকে 'জাতীয় আইকন' বলেছেন ৷ বলেন, "তাঁর পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি আমাদের আক্রমণাত্মক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দিয়েছে । পাকিস্তানের জনগণের কাছে তিনি ছিলেন জাতীয় আইকন ।" আব্দুল কাদিরের সহকর্মী বিজ্ঞানী সমর মোবারকমন্ডের মতে, আব্দুল কাদির পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ ৷ পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমী দেশগুলির প্রচেষ্টাকে ঠেকাতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷ পশ্চিমী দেশগুলির পক্ষে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্তিত্ব স্বীকার করা কল্পনাতীত হলেও আব্দুল কাদিরের কৃতিত্বের জন্য তারা তা স্বীকার করতে বাধ্য হয় ৷
আরও পড়ুন : India-China 13th Meet : এলএসি-র মলডোতে ভারত-চিন 13তম বৈঠক