বিশ্বজুড়ে 70 মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আছেন, যারা তোতলামির সমস্যায় ভোগেন । কিন্তু এই সমস্যা কেন হয় এবং কীভাবে এর সমাধান করা যেতে পারে ? আমরা অডিয়োলজিস্ট ও স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথোলজিস্ট (SPL) তথা হায়দরাবাদের তেলাঙ্গানা অডিয়োলজিস্ট অ্যান্ড স্পিচ প্যাথোলজিস্ট প্যাথোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ডা. কে নাগেন্দরের সঙ্গে কথা বলেছি । তিনি নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ।
তোতলামি কী ? এর কারণ কী ?
ডাঃ নাগেন্দরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ‘স্ট্যামারিং’কেই ‘স্লাটারিং’ বলা হয় । এটা কথা বলার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অসাবলীলতাকেই তুলে ধরে । যাদের এই সমস্যা রয়েছে, তারা সড়গড়ভাবে কথা বলতে পারেন না অন্যদের মতো । আবার কখনও কখনও এমনও হয় যে, যে সব মানুষ কথা বলার সময় তোতলান, তারা কিন্তু গান গাওয়ার সময় এই সমস্যার মুখে পড়েন না । সুতরাং, এটা বুঝতে হবে যে তোতলামির সমস্যা কেবলমাত্র কথা বলা আর গান গাওয়ার সময়ই হচ্ছে কি না । অন্তত 98 শতাংশ মানুষ কথা বলার সময় তোতলান ।
তোতলামি আসলে একটি অত্যন্ত পরিবর্তনশীল ডিসঅর্ডার এবং মানুষ থেকে মানুষ ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার তারতম্যে এর বদল ঘটে । এর কয়েকটি কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য :
- জেনেটিক্স
কখনও কখনও তোতলামির সমস্যা বাবা-মায়ের থেকে শিশুতে সংবাহিত হয় জিনের মাধ্যমে ।
- অনুকরণ
অন্য কাউকে অনুকরণ করতে গিয়েও শিশুদের মধ্যে তোতলামির সমস্যা দেখা দেয় । যদি কোনও শিশু এমন কাউকে নকল করে, যিনি তোতলান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শিশুটিরও তোতলামির সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা জোরালো ।
- মানসিক চাপ
মানসিক চাপও স্পিচ ডিসঅর্ডার ঘটাতে পারে এবং কোনও চাপের তথা উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে যেমন ইন্টারভিউয়ের সময় ব্যক্তি কীভাবে কথা বলছেন, তাতে প্রভাব ফেলতে পারে ।
- নিউরোলজিক্যাল সমস্যা
কখনও কখনও দুর্ঘটনার ফলে মস্তিষ্কে আঘাত লাগে, যার জেরে মস্তিষ্কের সেই নির্দিষ্ট অংশটি, যা কথা বলার জন্য দায়ী, তা নষ্ট হয়ে যায় এবং তার থেকে স্পিচ ডিসঅর্ডার ঘটতে পারে।
- হীনমন্যতা
কখনও কখনও হীনমন্যতার জন্যও ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে। যদি কোনও শিশুকে তার সহপাঠীরা অন্য চোখে দেখে, উপহাস করে, তাহলে তার মনের মধ্যে ভয় গেঁড়ে বসে এবং সে সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে না ।
কোন বয়সে এটা হতে পারে?
শৈশবে বা কৈশোরকালে এই ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে । আমাদের বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “কখনও কখনও ভাষার উপর দখল তৈরি করার সময়ে 2.5 থেকে 4 বছরের শিশুরা তোতলাতে পারে, যাকে ‘নর্ম্যাল ননফ্লুয়েন্সি’ বলা হয় । অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে, এই বয়সে সেই শিশুটিকে কোনওভাবে চাপ দিয়ে বা জোর করে সঠিকভাবে কথা বলতে বাধ্য করা যাবে না আর এই তোতলামির সমস্যা পরে নিজে থেকেই চলে যাবে । তবে যদি এই সমস্যা 4 বছরের পরেও থাকে, তাহলে অভিভাবকদের আর দেরি না করে কোনও বিশেষজ্ঞ তথা যোগ্য স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ প্যাথোলজিস্ট (SLP)-র পরামর্শ নেওয়া উচিত ।
এটা বুঝতে হবে যে শৈশবে যদি কথা বলার ধরনকে সংশোধন না করা যায়, তাহলে পরে একে সম্পূর্ণভাবে ঠিক করা যাবে না । কিছুটা তোতলামির সমস্যা তো থাকবেই । সুতরাং, এই স্পিচ ডিসঅর্ডারকে গোড়াতেই চিহ্নিত করা এবং সংশোধন করা অত্যন্ত জরুরি ।
কী হয় ?
এই স্পিচ ডিসঅর্ডারের নিরাময়ের একমাত্র এবং সেরা উপায় হল স্পিচ থেরাপি । এই নিয়ে ডাঃ নাগেন্দরের ব্যাখ্যা, সাধারণভাবে মানুষ কোনও শব্দ বা বর্ণমালার প্রথম অক্ষরটি উচ্চারণ করতে গিয়ে তোতলায় । যা যা হতে পারে, তা হল–
- পুনরাবৃত্তি, “পি-পি-পি-পি-পেন ৷”
- সম্প্রসারণ, “মমমমমমমমাদার ।”
- কথা বলার ফাঁকে বিরতি নেওয়া, “আমি একটি (বিরতি) বই পড়ছি ।”
- বাক্যাংশের পুনরাবৃত্তি, “আমি...আমি...পড়ছি ।”
- বাক্যের ফাঁকে ফাঁকে শব্দ বা আওয়াজ যোগ করা,“আমি (উমমম) খেলতে (উমমম) যাচ্ছি ।”
এর চিকিৎসা কী ?
এই ধরনের সমস্যা নানা ধরনের স্পিচ থেরাপি কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে ঠিক করা যেতে পারে । এর মধ্যে কয়েকটি হল –
- এয়ারফ্লো টেকনিক চর্চা করা
- ব্রিদিং এক্সারসাইজ করা
- রিল্যাক্সেশন এক্সারসাইজ করা
- ফিংগার ট্যাপিং এক্সারসাইজ করা
- প্রোলংগেশন টেকনিক
- মিনিম্যাল পেয়ার থেরাপি
তাঁর কথায়, “প্রতিটি থেরাপি সেশন অন্তত 40-45 মিনিট স্থায়ী হয় এবং 20-40 সেশনের পরই তোতলামির সমস্যা কেটে যায় । যদিও থেরাপি সেশনে যে কৌশল শেখানো হয়, তা বাড়িতে এবং অন্যত্রও কথা বলার সময় অনুশীলন করতে হবে ।” তাছাড়াও যদি সেই ব্যক্তি এই কৌশলগুলি থেরাপি সেশন ছাড়া ব্যক্তিগত স্তরে অনুশীলন না তাহলে গোটা প্রচেষ্টাই মাঠে মারা পড়বে এবং ডিসঅর্ডার আবার নতুন করে দেখা দিতে পারে । তাই তিনি বলেছেন, “সন্তানের কথাবলা নিয়ে প্রত্যেক অভিভাবককে সচেতন হতে হবে । স্মার্টফোনে আটকে না থেকে তাদের উচিত, সন্তানদের সঙ্গে কথা বলা এবং মনোযোগ দিয়ে দেখা যে তারা কীভাবে কথা বলছে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তোতলামির সমস্যা ঘটে ৷ এনিয়ে ভুল ধারণা থাকার জন্য এবং অভিভাবকদের এনিয়ে সতর্ক থাকা উচিত এবং SLP-র সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ।” সুতরাং, গোড়াতেই এই স্পিচ ডিসঅর্ডারকে চিহ্নিত করা এবং সংশোধন করা সমস্যাকে চিরতরে নির্মূল করতে পারে, তবে এর জন্য নির্দিষ্ট কিছু থেরাপিরও সাহায্য নেওয়া জরুরি । অন্যথায় চিকিৎসায় দেরি হয়ে গেলে কোনও মানুষকে আজীবন এই সমস্যাকে নিয়েই বাঁচতে হবে । তাছাড়াও সাধারণ মানুষকে এই স্পিচ ডিসঅর্ডার সম্পর্কে সচেতন করাতে হবে এবং যারা তোতলান, তাদের কখনও অবহেলা বা ব্যঙ্গ করা চলবে না । তাদেরও সমানভাবে দেখতে হবে । এছাড়াও সামনে যখন কেউ তোতলাবেন বা কথা বলতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন, তখন তার সঙ্গে সংযোগসাধন করতে গিয়ে যোগাযোগ বজায় রাখতে হবে এবং ধৈর্য্যশীল হতে হবে ।