নয়াদিল্লি, 28 অগাস্ট: রিপাবলিকান প্রার্থী হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে মনোনয়নের ঠিক আগেই বেজিংয়ের বিরুদ্ধে সুর চড়াল ওয়াশিংটন। বৃহস্পতিবার অ্যামেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পদে রিপাবলিকান প্রার্থী হিসাবে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে সিলমোহর পড়ার ঠিক আগে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করল ওয়াশিংটন। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, একাধিক চিনা নাগরিকের ভিসায় মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিষেধাজ্ঞা চাপানো এবং 24 টি চিনা ব্যবসায়িক সংস্থার উপর সে দেশের বাণিজ্য মন্ত্রকের নিষেধাজ্ঞা চাপানো। এই দুই পদক্ষেপের কারণ হিসাবে দক্ষিণ চিন সাগরে চিনের সামরিকীকরণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অ্যামেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেয়ো বলেন, "আমরা প্রত্যেক দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি, তা সে দেশের আয়তন যত কমই হোক না কেন। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন মেনে সমুদ্র এলাকায় শান্তি ও স্বাধীনতারও পক্ষে আমরা।"
অ্যামেরিকা যে বরাবরই স্বাধীন দক্ষিণ চিন সাগরের পক্ষে, তা জানিয়ে পম্পেয়ো বলেন, "শীঘ্রই স্টেট ডিপার্টমেন্ট সেই সব চিনা নাগরিকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে, যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দক্ষিণ চিন সাগরের বিতর্কিত অঞ্চলে অবৈধ নির্মাণ এবং সামরিকীকরণের সঙ্গে যুক্ত অথবা ওই অঞ্চলে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে ন্যায্য অধিকারকে বঞ্চিত করে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে যুক্ত।"
অ্যামেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট আরও বলেন, "এর পর থেকে ওই সব চিনা নাগরিক আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবেন না। এমনকী তাঁদের নিকট আত্মীয় ও পরিবারের সদস্যদের উপরেও এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে।"
বাণিজ্য মন্ত্রকের ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "একইসঙ্গে আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রক 24 টি PRC (পিপলস রিপাবলিক অব চায়না) সংস্থা ও একাধিক CCCC (চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কম্পানি) নিয়ন্ত্রিত সংস্থার তালিকা তৈরি করেছে।"
পম্পেয়োর অভিযোগ, 2013 সাল থেকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থার সাহায্যে বেজিং দক্ষিণ চিন সাগরের তিন হাজার একরেরও বেশি এলাকা দখল করে নিয়েছে। আর এই বেআইনি কাজ করতে গিয়ে ওই অঞ্চলের একাধিক দেশ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার হরণ করেছে চিন। এর ফলে পরিবেশেরও বহু ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন পম্পেয়ো।
সেক্রেটারি অব স্টেট বলেন, "CCCC-এর সাহায্যে দক্ষিণ চিন সাগরে অবস্থিত তাদের বিভিন্ন চেকপোস্টকে কাজে লাগিয়ে ধ্বংসাত্মক নির্মাণ প্রক্রিয়া চালিয়েছে বেজিং। এই CCCC বেজিংয়ের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (যা এখন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ বা BRI নামে পরিচিত) প্রকল্পের অন্যতম কন্ট্র্যাক্টর। এই CCCC এবং তার একাধিক সহযোগী সংস্থা বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি, আর্থিক তছরূপ, পরিবেশ ধ্বংসের মতো কাজের সঙ্গে যুক্ত।"
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সীমান্ত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পম্পেয়ো বলেন, "CCCC এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অন্যান্য সংস্থাকে হাতিয়ার করে চিনের এই আগ্রাসী সম্প্রসারণমূলক প্রকল্পের অনুমতি দেওয়া যাবে না। দক্ষিণ চিন সাগরে চিন যত দিন এই আগ্রাসী আচরণ বন্ধ করবে না, তত দিন অ্যামেরিকা এর সক্রিয় প্রতিবাদ করবে। এই অঞ্চলের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে একযোগে কাজ করবে অ্যামেরিকা।"
দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের আধিপত্যবাদী নীতি এবং এই অঞ্চলের একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সীমান্ত সমস্যার মাঝে পম্পেয়োর এই মন্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। লাদাখে ভারত ও চিনের সীমান্ত সংঘাত ও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (LAC) 45 বছরের ব্যবধানে প্রথম প্রাণঘাতী সংঘর্ষে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে। এই আবহেও অ্যামেরিকান সেক্রেটারি অব স্টেটের এই মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
গত মাসে চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (PLA)-র নৌবাহিনী দক্ষিণ চিন সাগরে উভচর সামরিক যান নিয়ে সামরিক মহড়া শুরু করেছিল। এর পাল্টা হিসাবে দক্ষিণ চিন সাগরের পারাসেল দ্বীপের কাছে তিনটি পরমাণু অস্ত্রবাহী বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়ে দেয় অ্যামেরিকা।
দক্ষিণ চিন সাগরের স্পার্টলি এবং পারাসেল দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে একাধিক দেশের সঙ্গে সংঘাতের সম্পর্ক চিনের। স্পার্টলি দ্বীপপুঞ্জের অন্য দাবিদার দেশগুলি হল ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনাম।
2016 সালে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের স্থায়ী সালিশি আদালত জানিয়ে দেয় যে, বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্র বাণিজ্যপথ দক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপিন্সের অধিকার লঙ্ঘন করেছে চিন। ফিলিপিন্সের মৎস্যজীবীদের বাধা দেওয়া, সে দেশের পেট্রোলিয়াম খননে বাধা দেওয়া, ওই এলাকায় কৃত্তিম দ্বীপ তৈরি এবং চিনা মৎস্যজীবীদের ওই এলাকায় মাছ ধরা থেকে বিরত না করার মতো একাধিক অভিযোগ ওঠে চিনের বিরুদ্ধে।
গত মাসে দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের বিরুদ্ধে ফের সামুদ্রিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ করে ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন্স।
মাইক পম্পেয়োর বক্তব্য নিয়ে বুধবার মিডিয়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক আধিকারিক জানান, 2016 সালে চিন ও ফিলিপিন্স নিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের রায় অনুযায়ী দক্ষিণ চিন সাগরে কাজ করতে বদ্ধপরিকর অ্যামেরিকা। তাঁর কথায়, "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সব দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নেবে ওয়াশিংটন। বেজিং যে ভাবে এই অঞ্চলে তার আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছে এবং যে ভাবে তারা বেআইনি ভাবে ওই এলাকার সামুদ্রিক সম্পদ দখল করে চলেছে, তাতে আমেরিকা গভীর ভাবে চিন্তিত।"
তাঁর দাবি, "বিভিন্ন বিতর্কিত এলাকায় পরিবেশ ধ্বংস করে এবং সামরিকীকরণ করেই চলেছে বেজিং। এর ফলে ওই সব এলাকার প্রবাল প্রাচীরে চিরস্থায়ী ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ চিন সাগরের এই সব অঞ্চলকে তারা প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করে চলেছে। এই কাজে তারা তাদের নৌসেনাকে বিপজ্জনক ভাবে ব্যবহার করছে। এমনকী চিনা সেনার প্রত্যক্ষ মদতে বহু অসামরিক ভেসেল ওই সব এলাকায় পৌঁছে দখলদারি চালাচ্ছে। এই সব করে দক্ষিণ চিন সাগরে অধিকার বাড়িয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করছে বেজিং।"
ওই একই সাংবাদিক বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রকের এক বরিষ্ঠ আধিকারিক জানান, 24 টি চিনা সংস্থাকে অ্যামেরিকা তালিকাভুক্ত করেছে। এর কারণ হিসাবেও দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিংয়ের আগ্রাসন ও সামরিকীকরণের কথাই বলেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রকের ওই কর্তা বলেন, "যে সব চিনা সংস্থাকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারা এর পর থেকে অ্যামেরিকা থেকে কোনও পণ্য বাইরে নিয়ে যাওয়া বা বিদেশে তৈরি কোনও পণ্য আমদানি বা রপ্তানি করা বা অ্যামেরিকার মধ্যেও তালিকাভুক্ত দুই সংস্থার মধ্যে পণ্য বিনিময়ে করতে পারবে না। এই সব করতে হলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়বে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, কোনও সংস্থা যদি এই তালিকায় থাকা কোনও সংস্থার সঙ্গে কোনও পণ্য, সফটওয়্যার বা প্রযুক্তি আদানপ্রদান করতে চায়, তা হলে অবশ্যই বাণিজ্য মন্ত্রকের বিশেষ আবেদন করতে হবে। আমরা তার পর সেই আবেদন নিয়ে ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, প্রতিরক্ষা এবং প্রয়োজনে শক্তি মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব যে অনুমতি দেওয়া যায় কি না।"
সাংবাদিক বৈঠকে মার্কিন বাণিজ্য মন্ত্রকের ওই কর্তা আরও জানান যে, "চিনের বিরুদ্ধে আমেরিকার এই পদক্ষেপ ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার বন্ধু দেশগুলির প্রতি এবং তাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি ওয়াশিংটনের সমর্থনের প্রমাণ। আন্তর্জাতিক আইন মেনে আমরা ওই এলাকার সমস্ত বিতর্কিত অঞ্চলের সমাধানে আগ্রহী।"
চিনের সঙ্গে বেড়ে চলা সঙ্ঘাত এবং লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর বেজিংয়ের সঙ্গে চলতি মত পার্থক্যের পরিবেশে অ্যামেরিকার এ হেন পদক্ষেপ নয়াদিল্লির কানে মধুর সঙ্গীতের মতো শ্রুতিমধুর।
অ্যামেরিকা, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একটি অক্ষ রয়েছে ভারতের। এই অক্ষ শান্তি, উন্নয়ন এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাধাহীন জাহাজ চলাচলের বিষয়ে এক যোগে কাজ করে। এই অঞ্চল জাপানের পূর্ব তটরেখা থেকে আফ্রিকার পূর্ব তটরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনফিংয়ের আগ্রাসী নীতির আবহে এই অক্ষ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।