2018 সালে লেখা ‘আইডেন্টিটি’ বইয়ে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা এই যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে, অভিবাসন তাস খেলায় শ্রেণি এবং বর্ণবিদ্বেষের ইশুর উপর থেকে নজর সরে গিয়েছে । আর এটাই মুখ্য কারণ যার জন্য অ্যামেরিকানরা রিপাবলিকানদের পক্ষে ভোট করে । তা প্রমাণের জন্য রাজনৈতিক বিজ্ঞানী হাজনাল এবং আব্রাজানোর তরফে নথিও তুলে ধরেছিলেন তিনি ।
ফুকুয়ামা তাঁর বইয়ে (পৃষ্ঠা 132) লিখেছিলেন, “1960 সালের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে অ্যাফ্রিকান- অ্যামেরিকাদের অর্ন্তভুক্তিই দেশের দক্ষিণাংশের অধিবাসীদের রিপাবলিকানদের প্রতি অনুগত করে তুলেছিল । এখন অভিবাসন ইসু্য ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করছে । ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার সূচি এবং পরবর্তীকালে তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার যাত্রাপথের কেন্দ্রভাগে মেক্সিকান এবং মুসলিম অভিবাসনের বিরোধিতাই স্থান পেয়েছিল ।”
বর্তমানে ট্রাম্প যখন আগামী নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের জয়ের আশায় রয়েছেন, তখন নির্বাচন বিতর্কে যে দু’টি বিষয় নিয়ে চর্চা তুঙ্গে, তা হল অভিবাসন এবং জাতি বিদ্বেষ । রিপাবলিকান নেশন কনভেনশনের প্রথম রাতে নিক্কি হ্যালি, রাষ্ট্রসংঘের প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং দক্ষিণ ক্যারোলিনার প্রাক্তন গভর্নর অ্যামেরিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের কথার জবাব দেন । হ্যালি এবং হ্যারিস, দু’জনেরই জন্ম অভিবাসী পরিবারে আর দু’জনেরই শিকড় ভারতীয় । তাঁর বাবা যে পাগড়ি পরতেন আর মা শাড়ি, সে কথা উল্লেখ করে প্রতিনিধি দলকে হ্যালি বলেন, “ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সুরে সুর মিলিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, অ্যামেরিকা জাতিবিদ্বেষী । কিন্তু এটা মিথে্য । অ্যামেরিকা জাতিবিদ্বেষী দেশ নয় । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি এটা বলছি । আমি ভারতীয় অভিবাসীদের সন্তান আর আমি তার জন্য গর্বিত । অ্যামেরিকা এমন একটা গল্প, যার শেষ এখনও লেখা হয়নি । এবার সময় এসেছে গল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর অ্যামেরিকাকে আরও মুক্ত, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ এবং সকলের জন্য আরও ভালো করে তোলার । আর তাই এটা দেখে কষ্ট লাগছে যে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এসবের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সংঘর্ষ আর অশান্তি ছড়াতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ।”
তাহলে কী সতি্যই অ্যামেরিকা জাতিবিদ্বেষী এবং 2020 সালে এই জাতিবিদ্বেষের ইশুই কি দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে? সিনিয়র জার্নালিস্ট স্মিতা শর্মা এই বিদ্বেষের ইশুতে #ব্যাটেলগ্রাউন্ডUSA2020 নিয়ে অ্যামেরিকার দু’জন বিশিষ্ট প্যানেলিস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন । এদের একজন সোশিওলজির অধ্যাপক, ‘হেটক্রাইম’ গবেষক এবং ঔপন্যাসিক ব়্যান্ডাল ব্ল্যাজ়াকের মতে, জাতিবিদ্বেষ ইশুটিকে নিয়ে অ্যামেরিকা বর্তমানে নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার পথে হাঁটছে । ওরেগনের পোর্টল্যান্ড, যেখানে শ্বেতাঙ্গদেরই আধিপত্য বেশি, সেখান থেকে তিনি জানিয়েছেন, “অপ্রাতিষ্ঠানিক স্তরে বর্ণ তথা জাতিবিদ্বেষের ঘটনা এখানে কয়েকশো বছর ধরে প্রাধান্যই পায়নি । আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে বদল এসেছে 2020 সালে আর হয়তো এতে প্যানডেমিকেরও কোনও হাত রয়েছে । কিন্তু বিদ্বেষের আলোচনা শেষপর্যন্ত যে হচ্ছে, সেটাই উপজীব্য । আর এটা করছে শ্বেতাঙ্গরা, যারা নিজেরাই বোঝার চেষ্টা করছে কীভাবে এই সমস্যার মুখোমুখি তারা দাঁড়াবে এবং মোকাবিলা করবে ।”
নিক্কি হ্যালি যেখানে বলছেন, অ্যামেরিকায় জাতিবিদ্বেষ নেই, সেখানেই ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডসরা উইসকনসিনের কেনোশার রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংঘর্ষ এবং হিংসাকে বাগে আনার জন্য । বর্তমান পরিস্থিতির কারণ তিন শিশু সন্তানের সামনেই 29 বছরের কৃষ্ণাঙ্গ জেকব ব্লেককে, শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারদের গুলি করার ঘটনা । ওই ঘটনার পরই অবশ্য পুলিশ আধিকারিকদের প্রশাসনিক ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় । ব্লেক প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন কিন্তু এই ঘটনা উসকে দিয়েছে #ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার-এর স্মৃতি । যেখানে তিন মাস আগে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পুলিশ আধিকারিক ।
অতীতে অনেক নির্বাচনের আগেই প্রচারে এবং রাজনৈতিক আলোচনায় বর্ণ-জাতি বিদ্বেষের ঘটনা এবং কৃষ্ণাঙ্গদের খুনের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছিল । কিন্তু এবার এই আলোচনা জাতীয় স্তরে হচ্ছে এবং পর্যায়ক্রমিকভাবে চলে আসা বিদ্বেষের ঘটনা নিয়ে হচ্ছে । এমনটাই মনে করেন রিলিজিয়াস ফ্রিডম ইনস্টিটিউট এবং উইলসন সেন্টারের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ফরাহনাজ় ইসপাহানি । ওয়াশিংটন ডিসি থেকে তিনি জানিয়েছেন, “অতীতে আমরা জাতিবিদ্বেষ নিয়ে কথা বলেছি । সংবিধান হোক বা দাসত্ব বা নাগরিক অধিকার বা মার্টিন লুথার কিং । এমনটা কখনওই নয় যে, আমরা অ্যামেরিকায় জাতিবিদ্বেষ নিয়ে কখনও আলোচনা করিনি বা গুরুত্ব দিয়ে সেই চর্চা হয়নি । কিন্তু এবার যে বিষয়টা প্রথম বার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে, তা হল পর্যায়ক্রমে জাতিবিদ্বেষ, যা বর্তমানে অ্যামেরিকার ইতিহাস, ভূগোল, অ্যামেরিকার বর্তমান এবং চিরকালীন স্বত্ত্বার নিত্যনৈমিত্তিক অঙ্গ হয়ে উঠেছে । আর আমার চোখে এটাই হল পার্থক্য ।”
ইসপাহানি আরও জানিয়েছেন যে, “এই প্রথম অ্যামেরিকার কোনও প্রধান রাজনৈতিক দল (ডেমোক্র্যাট) পর্যায়ক্রমিক জাতিবিদ্বেষের ঘটনা নিয়ে কথা বলছে । রাজনৈতিক আবর্তে বর্তমানে এটা এমন একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, হয় আপনি এটা মানবেন বা মানবেন না । কিন্তু এই চর্চার মাধ্যমেই এটি রাজনৈতিক আবর্ত ও রাজনীতিকদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সংবাদমাধ্যম এমনকী অ্যামেরিকাবাসীদের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে । ফলে মানুষ এটা নিয়ে জানছেন, মতামত দিচ্ছেন । আর এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই ।”
তবে রিপাবলিকানরা তাদের প্রচারে ডেমোক্র্যাটদের চরম বামপন্থী, মৌলবাদী বলে কটাক্ষ করেছেন এবং কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকার কর্মী এবং কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার প্রতিবাদকারীদের ‘হিংসা ছড়ানো উন্মত্ত জনতা’ বলে গণ্য করে ভোটারদের বলেছেন ‘এই DC সোয়াম্পদের’ দূর করে দাও । তাই এই আলোচনায় স্মিতা প্রশ্ন করেছেন, পর্যায়ক্রমিক জাতিবিদ্বেষের ঘটনা নিয়ে জাতীয় স্তরে আলোচনা কি অ্যামেরিকানদের আরও বেশি মেরুকরণের পথে ঠেলতে পারে? এর জেরে কি শ্বেতাঙ্গ রক্ষণশীল অ্যামেরিকানরা একজোট হবেন? ট্রাম্প-পেন্স জুটির তুলনায় বিডেন-হ্যারিসের জুটি কি তাহলে এই ইশুতে আলোচনার ক্ষেত্রে একেবারে আলাদা কোনও মোড় পেশ করবে?
ব্ল্যাজাক বলছেন, “চলতি সপ্তাহে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে আমরা যা দেখেছি, তা হল বাস্তব বৈপরীত্য । একটা দল আতঙ্ক ছড়াচ্ছে আর অপর দল প্রতিবিম্ব দেখাচ্ছে । অ্যামেরিকা নিত্য পরিবর্তশীল দেশ । আমরা ধীরে ধীরে আরও বেশি করে কৃষ্ণাঙ্গদের দেশ হয়ে পড়ছি । আমরা তা আটকাতে পারব না । তাই সম্ভবত আমরা কোনও না কোনওভাবে তাদের দেশ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়বই ।" প্রেসিডেন্টের টুইট, “শহরতলির গৃহবধূরা আমাকেই ভোট করবেন কারণ আমি তাদের আপনাদের এলাকা থেকে সবসময় দূরে রাখব”–এই ধরনের মন্তব্য 1950 সালে শোভা পেত । ফলে আলাদা করে শুধু কর্মসূচিতে নয় । এই মুহূর্তে আমাদের চিন্তাধারাতেও বদল এসেছে ।” জাতিবিদ্বেষের ঘটনায় নবীন এবং প্রবীণ প্রজন্ম কী ভাবছে, এই প্রশ্নের উত্তরে ব্ল্যাজাক বলছেন, “প্রজন্মগত মতাদর্শে আমরা বাস্তবিক অর্থেই পার্থক্য দেখছি । মার্কিন আদমসুমারি বু্যরোর পূর্বাভাস, ২০৫০ সালের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা কৃষ্ণাঙ্গদের থেকে কমবে । ফলে তখন এখানে সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে । এটা ভেবে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই উচ্ছ্বসিত । কিন্তু অন্যদিকে, বয়স্ক শ্বেতাঙ্গদের অনেকে ভয়ে কাঁপছেন । কারণ তাঁদের মনে হচ্ছে, যে দেশ তাঁরা 1776 সালে গড়েছিলেন সেটা কেউ তাঁদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে । তাই তাঁরা রক্ষণশীলভাবে দেওয়াল গড়তে, অভিবাসীদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে চাইছেন এবং যেভাবে হোক সময়কে পিছিয়ে নিয়ে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, যেখানে কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ পুরুষদেরই প্রাধান্য ছিল । কোনও রূপান্তরকামী, অভিবাসী, মুসলিম কিংবা এমন কেউ যাঁরা শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে, তা তাঁরা চান নান ।”
ফরাহনাজ় ইসপাহানি জানাচ্ছেন, তাঁর শিকড় পাকিস্তানে । তিনিও অভিবাসী । নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেছেন, “35 বছর আগে 18 বছর বয়সে যে অ্যামেরিকায় আমি এসেছিলাম সেটা আজকের থেকে অনেকটাই অন্যরকম ছিল । সেখানে অভিবাসীদের স্বাগত জানানো হত । কিন্তু সেই সময় আমরা যাঁরা এসেছিলাম তাঁদের বেশিরভাগই এখানে পড়তে এসেছিল এবং বেশিরভাগই ছিল শিক্ষিত পরিবারের সন্তান । আজকের দিনে অভিবাসনের ধাঁচ অনেকটাই বদলে গিয়েছে । আর তাই তাঁদের অভ্যর্থনার কায়দাও বদলেছে । প্রজন্মগতভাবে এই পরিবর্তন খুব চোখে পড়ে । আপনি দেখবেন, এখানকার বয়স্ক মানুষরা নিজেদের জীবন, ঈশ্বর, গির্জা, জমি, আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকার কোনও কিছুই ছাড়তে চান না । আর তাঁরা অ্যামেরিকায় কোনওরকম পরিবর্তনেরও বিপক্ষে । আর এঁদেরই একটা বড় অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিল । কাজেই কোনও বিচারেই সেই ভোট ইতিবাচক ছিল না ।