কলকাতা, 31 অগস্ট: সিনেমার পর্দায় গল্প বলা সহজ নয় ৷ রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, 'সহজ কথা, যায় না বলা সহজে ৷' ঠিক তেমনই সিনেমার মাধ্যমে গল্প বলাটা আপাত দৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও আসলে বেশ জটিল ৷ আর সেই জটিল কাজটাই অনায়াসে করতে পারতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ ৷ প্রয়াত পরিচালকের আজ 60তম জন্মদিন ৷ কিংবদন্তি এই মানুষটির সঙ্গে দু'টি পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি এবং একটি টেলিফিল্মে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী লাবণী সরকার। এই বিশেষ দিনে প্রয়াত পরিচালকের স্মৃতিতে ডুব দিলেন অভিনেত্রী।
ঋতুপর্ণর 'নৌকাডুবি' এবং 'আবহমান' ছবিতে অভিনয় করেছিলেন লাবণী। পাশাপাশি প্রয়াত পরিচালক নাকি তাঁকে 'বাড়িওয়ালি' ছবিতে মালতী চরিত্র এবং 'ঊনিশে এপ্রিল' ছবিতেও কাজের প্রস্তাব দিয়েছিলেন । অন্য কাজে ব্যস্ত থাকার ছবি দুটি করা সম্ভব হয়নি অভিনেত্রীর। সেই আফশোস আজও পিছু ছাড়েনি তাঁকে।
সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র ধারক ও বাহক ঋতুপর্ণ ঘোষ: মাত্র তিনটে কাজ করেছি ওঁর সঙ্গে। এর পাশাপাশি 'বাড়িওয়ালি' ছবির মালতী চরিত্রের জন্য়ও প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন অশোক ধানুকার অন্য একটি ছবির জন্য চরম ব্যস্ততা চলছিল ৷ সেই কারণে সময় করে উঠতে পারিনি। প্রস্তাব ছিল 'ঊনিশে এপ্রিল'-এর একটি চরিত্রের জন্যও। তবে ওঁর কাজ শেখানোর এবং কাজ করার যে ধরণ দেখেছি তাতে একটা কথা বলতে হয়, সত্যজিৎ রায়ের একমাত্র ধারক ও বাহক ঋতুপর্ণ ঘোষ। মানসপুত্র বললেও বেশি বলা হয় না। আমি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করিনি । কিন্তু ওঁর সব ছবি দেখেছি । সেই দিক থেকে আমার মনে হয়েছে ঋতুপর্ণই মানিকবাবুর ধারক-বাহক ।
ঋতুর সঙ্গে কাজ করে আমি অচেনা লাবণীকে চিনেছি: আমি হাতে কলমে কাজ শিখেছি রমাপ্রসাদ বণিক, বিভাস চক্রবর্তী এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে । এরপর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তপন সিনহার ছবি 'হুইলচেয়ার'-এ অভিনয় করি । এঁরা সকলেই দিকপাল। এঁদের পাশাপাশি ঋতুপর্ণর সঙ্গেও কাজ করেছি। ঋতুর সঙ্গে কাজের পর আমি নিজের মধ্যে এক অন্য লাবণীকে খুঁজে পাই । দর্শকরাও 'আবহমান' দেখে আমাকে আলাদা করে চিনতে পেরেছেন। আজও মনে রেখেছেন। তার আগে আমি আরও শ'দুয়েক ছবিতে অভিনয় করেছি। কিন্তু 'আবহমান' আমার কাছে নানা কারণে বিশেষ।
আরও পড়ুন: ওটিটি'তে আসছে 'বাড়িওয়ালি', ঋতুপর্ণর ছবির ডিজিটাল প্রিমিয়ার চলতি মাসেই
বাংলা ছবিতে নারী চরিত্রের ব্যবহার শিখিয়েছেন ঋতু: সাত মাসের গর্ভবতী কীভাবে হাঁটবেন, কীভাবে দাঁড়াবেন, কীভাবে বসবেন, বসলে শরীরে কতটা ভাঁজ পড়বে সবটাই উনি করে দেখিয়ে দিতেন । আমরা মেয়েরা যতটা না নিজেদের বুঝি তার থেকেও বেশি বুঝতেন ঋতুপর্ণ। বাংলা ছবিতে নারী চরিত্রের ব্যবহারকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন তিনি। 'চিত্রাঙ্গদা' দেখে মনে হয়েছিল এ যেন ঋতুর নিজের যন্ত্রণার গল্প । ওঁর লড়াই আর না-পাওয়ার কাহিনী ধরা পড়েছে 'চিত্রাঙ্গদা' ছবিতে ।
আরও পড়ুন: আট বছর পর আবার, এক ফ্রেমে বন্দি দেব সোহম
কিছুক্ষণ আরও না-হয় রহিতে কাছে : 'নৌকাডুবি'র কাজ চলার সময় আমার গলার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। যাত্রা করে করে গলা বসে গিয়েছিল। ঋতুপর্ণর সেটা একদম পছন্দ ছিল না। আমায় ডেকে বললেন, "গলাটা আমার ভালো লাগছে না লাবু । আমি রেকর্ডিং করে দিয়ে যাচ্ছি, ওভাবেই বলিস ।" আমি সেটাই করেছিলাম । মুম্বই থেকে ফিরে এসে রেকর্ডিং শুনে খুশি হয়েছিলেন। ছবিটাও সকলের ভালো লেগেছিল। প্রত্যেকদিন কত কিছু যে শেখাতেন ঋতু! আর অনেক কিছু শেখার ছিল ওঁর কাছ থেকে। সিনেমাকে আরও অনেককিছু দেওয়ার ছিল ওঁর। এই সব মানুষ বেশিদিন থাকে না। এঁরা স্বপ্নের দেশ থেকে আসে আর স্বপ্নের দেশেই হারিয়ে যায়। তবে ঋতু বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে গিয়েছেন।