রায়দিঘি, 3 এপ্রিল : দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব যে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে, এই জল্পনা বহু দিনের ৷ এমনকী, একটা সময় তাঁর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও শুরু হয়েছিল নানা আলোচনা ৷ আর এবার সেই দেবশ্রী রায়ের নাম নিয়েই তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের কথা স্বীকার করে নিলেন স্বয়ং তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ৷ সাফ জানিয়ে দিলেন, মানুষ চায় না বলেই এবার আর দেবশ্রী রায়কে রায়দিঘি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করেনি তাঁর দল ৷ যা নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে কাটাছেঁড়া ৷ তবে কি এবার ফের একবার গেরুয়া পথের দিকেই হাঁটা লাগাবেন তৃণমূলের দু’বারের বিধায়ক ? আর সেটা বুঝেই কি প্রকাশ্য মঞ্চে বিধায়ককে নিয়ে আমজনতার ক্ষোভের কথা স্বীকার করে নিলেন তৃণমূল নেত্রী ?
দু’হাজার এগারোয় রাজ্য়ে পালাবদলের আগে থেকেই তৃণমূল শিবিরের সঙ্গে সখ্য বাড়তে শুরু করে সমাজের বিশিষ্টদের একাংশের ৷ নামজাদাদের এই তালিকায় অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় অন্যতম ৷ তাঁর জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই নবগঠিত বিধানসভা কেন্দ্র দক্ষিণ 24 পরগনার রায়দিঘিতে দেবশ্রীকে দলের প্রার্থী করেন মমতা ৷ আগে এই এলাকা ছিল মথুরাপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ৷ বিধায়ক ছিলেন সিপিএমের ডাকসাইটে নেতা তথা মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্য়ায় ৷ মেঠো নেতা হিসাবে যাঁর সুনাম আজও অক্ষত ৷ মানুষের বিপদে ছুটে যাওয়া যাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ৷ তাই অনেকেরই মনে হয়েছিল, এহেন কান্তির বিরুদ্ধে দেবশ্রীর পক্ষে জেতা কার্যত অসম্ভব ৷ কিন্তু রাজ্যজুড়ে তখন পালাবদলের হাওয়া বইছে ৷ সেই হাওয়ায় ভেসেই ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করে যান রাজনীতিতে আনকোরা দেবশ্রীও ৷ কান্তিকে হারিয়ে বিধায়ক হন রায়দিঘির ৷
স্থানীয় সূত্রে খবর, তারকা প্রার্থীকে বিধায়ক নির্বাচন করলেও পরবর্তীতে মোহভঙ্গ হয় রায়দিঘির বাসিন্দাদের ৷ তাঁদের অধিকাংশেরই অভিযোগ, বিধায়ক হওয়ার পর নিজের এলাকার কোনও খোঁজই রাখেননি দেবশ্রী ৷ আপদে-বিপদে তাঁর দেখাটুকুও পাননি স্থানীয়রা ৷ অথচ তারপরও 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনে ফের একই কেন্দ্রে ভোটে জেতেন দেবশ্রী ৷ এর পর পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হয়ে ওঠে ৷ তারকা বিধায়ককে নিয়ে ক্ষোভ বাড়তে শুরু করে এলাকাবাসীর মনে ৷ একথা মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়-সহ তৃণমূল নেতৃত্বেরও অজানা নয় ৷
এদিকে, 2019 সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন শোভন চট্টোপাধ্য়ায় ৷ বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্য়োপাধ্য়ায়কে সঙ্গে নিয়ে সটান দিল্লিতে বিজেপির সদর কার্যালয়ে পৌঁছে যান তিনি ৷ সেই দিনই দিল্লিতে হাজির হন দেবশ্রী ৷ একদিকে যখন শোভন-বৈশাখী বিজেপির পতাকা হাতে তুলে নিচ্ছিলেন, অন্যদিকে তখন একটা ঘরে বসে দীর্ঘ অপেক্ষা শুরু হয় দেবশ্রীর ৷ ঘটনা নিয়ে শুরু হয় কানাঘুষো ৷ ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের দাবি, শোভন-বৈশাখীর আপত্তিতেই সেদিন নাকি বিজেপিতে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি দেবশ্রীর ৷ যদিও তৃণমূল, বিজেপি বা দেবশ্রী রায় স্বয়ং, কোনও পক্ষই এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও কথা স্বীকার করেনি ৷
আরও পড়ুন : রায়দিঘিতে টিকিট পেলেন না দেবশ্রী রায়, প্রার্থী অলোক জলদাতা
একুশের বিধানসভা ভোট আসতে আসতে প্রেক্ষাপটে বদল শুরু হয় আবার ৷ নানা কারণে শোভন-বৈশাখীকে নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয় গেরুয়া শিবিরকে ৷ শেষমেশ বেহালা পূর্ব আসনে বিজেপির টিকিট না পেয়ে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন শোভন ৷ দল ছাড়ার কথা চিঠি দিয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতিকে জানান বৈশাখীও ৷ অনেকেরই মনে হয়েছিল, শোভন-বৈশাখীর ‘এগজিট’ দেবশ্রীর বিজেপিতে ঢোকার পথ পরিষ্কার করবে ৷
এদিকে, এবারের বিধানসভা নির্বাচনে দেবশ্রী রায়কে টিকিট দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস ৷ তাঁর কেন্দ্র রায়দিঘিতে প্রার্থী করা হয় ডাঃ অলোক জলদাতাকে ৷ শনিবার রায়দিঘিতে ভোট প্রচারে যান তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় ৷ সভামঞ্চেই প্রার্থী বদল নিয়ে মুখ খোলেন তিনি ৷ স্বীকার করে নেন মানুষের ক্ষোভের কথা মাথায় রেখেই দেবশ্রীকে ভোটে দাঁড় করানো হয়নি ৷ বদলে এলাকাবাসীর দাবি মেনে প্রার্থী করা হয়েছে ঘরের ছেলে অলোককে ৷ পাশাপাশি, রায়দিঘির বিজেপি প্রার্থীকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি মমতা ৷ তাঁর দাবি, তৃণমূলের টিকিট না পেয়েই রং বদলে গেরুয়া প্রার্থী হয়েছেন শান্তনু বাপুলি ৷ প্রসঙ্গত, এই শান্তনু বাপুলি আবার সত্যরঞ্জন বাপুলির ছেলে ৷ রায়দিঘি বিধানসভা গঠনের আগে মথুয়াপুরের বিধায়ক ছিলেন এই সত্যরঞ্জন ৷ পরবর্তীতে তাঁকে হারিয়ে বিধায়ক হন কান্তি গঙ্গাপাধ্য়ায় ৷ যাঁকে হারতে হয় দেবশ্রীর কাছে ৷
এদিন মমতার মন্তব্য নিয়ে দেবশ্রীর মতামত জানতে চেয়ে তাঁকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন ইটিভি ভারতের প্রতিনিধি ৷ কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি ৷ আমাদের করা হোয়াট্স অ্যাপ বার্তারও কোনও জবাব দেননি রায়দিঘির প্রাক্তন বিধায়ক ৷