মালদা, 19 সেপ্টেম্বর : কোরোনার প্রভাব পড়তে চলেছে শিশুদের টিকাকরণ কর্মসূচিতে । প্যানডেমিকের জেরে 20 সেপ্টেম্বর পালস পোলিও কর্মসূচি ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে । এবছর কোথাও পালস পোলিও বুথ করা হবে না । এমনকী যে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের পোলিও ড্রপ খাওয়ান, তাঁরাও এবার আর কোনও বাড়ির ভিতরে ঢুকবেন না । এর ফলে অনেক শিশু এবার এই কর্মসূচির আওতার বাইরে থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে । বিশেষত গ্রামীণ এলাকার শিশুদের এর ফল ভোগ করতে হতে পারে । এই নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকসহ চিকিৎসকদের একাংশ । এমনকী খোদ স্বাস্থ্য দপ্তর বিষয়টি নিয়ে চিন্তায় রয়েছে ।
ভারতকে পোলিওমুক্ত করতে 1978 সালে শুরু হয় পালস পোলিও কর্মসূচি । মূলত একদিন থেকে পাঁচ বছরের বাচ্চাদের এই কর্মসূচিতে শামিল করা হয় । প্রথমদিকে এই কর্মসূচি রূপায়ণে কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হয় কেন্দ্রীয় সরকারকে । কিন্তু 1999 সালে দেশের 60 শতাংশ শিশু এই প্রকল্পের আওতায় আসে । 2011 সালে দেশে দু'টি পোলিও সংক্রমণের হদিস মিলেছিল । 2014 সালের 27 মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারতবর্ষকে পোলিওমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করে । তবে এখনও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে পোলিও সংক্রমণের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, তাই প্রতিবেশী দেশ হিসাবে এদেশে এখনও পোলিও কর্মসূচি চালু রয়েছে । জানুয়ারিতে দেশে শেষ পালস পোলিও কর্মসূচি পালিত হয় । 20 সেপ্টেম্বর ফের কর্মসূচি পালিত হবে । কিন্তু কোরোনা আবহে এই কর্মসূচি এবার ব্যাহত হতে চলেছে । জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ভূষণ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, "20 সেপ্টেম্বর সাব ন্যাশনাল ইমিউনাইজ়েশন ডে পালিত হবে । এটা ইনটেন্সিফায়েড পালস পোলিও ইমিউনাইজ়েশন কর্মসূচি নয় । 20 তারিখ থেকে চারদিন ধরে এই কর্মসূচি চলবে । কোরোনার বিধি-নিষেধের জন্য এবার আমরা আগের মতো এই কর্মসূচি পালন করতে পারছি না । আমার ধারণা, এর ফলে সামান্য হলেও কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত হবে । তবু আমরা যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় আনার চেষ্টা করব ।" পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিয়ে বাড়িতে বাড়িতে যাবেন । তাঁরা PPE কিট না পেলেও মাস্ক, গ্লাভস ও স্যানিটাইজ়ার পাবেন । তবে এবার তাঁরা কারওর ঘরে ঢুকবেন না । বাড়ির বাইরে বাচ্চাদের পোলিও ড্রপ খাওয়ানো হবে ।"
এবার গোটা জেলায় পোলিও টিকাকরণ কর্মসূচি পালিত হবে না । দু'টি শহর সহ কিছু ব্লকে তা পালিত হবে । পোলিও বুথ না হলে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের অনেকে যে এই কর্মসূচির বাইরে থাকবে, তা মেনে নিচ্ছেন পুরানো মালদা সাহাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান উকিল মণ্ডল । তিনি বলেন, "পঞ্চায়েতে প্রতি সপ্তাহে স্বাস্থ্য বিষয়ক সভা হয় । সেই সভাতে পোলিও কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয় । তবে কোরোনার জন্য এখন সেই সভা বন্ধ রয়েছে । 20 সেপ্টেম্বর যে পালস পোলিও কর্মসূচি পালিত হবে, সেটা আমার জানা ছিল না । এই কর্মসূচি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিয়ে যেতে হবে । তা না হলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে । শিশুরা পোলিও ড্রপ না পেলে গোটা সিস্টেমটা ভেঙে যাবে ।" প্রত্যন্ত গ্রামের অভিভাবকরা সাধারণত কাছাকাছি বুথে গিয়ে বাচ্চাদের পোলিও ড্রপ খাওয়ান । কারণ, অনেক জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি পোলিও টিকা খাওয়াতে যান না বলে অভিযোগ ওঠে । তাই বুথ না হলে প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুরা খুব বিপদে পড়ে যাবে ।
ইংরেবাজারের নরহাট্টা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা সরিফুন খাতুন জানান, "জন্মের পর থেকে বাচ্চাকে পোলিও ড্রপ খাওয়াই । আমাদের গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি পোলিও টিকা দিতে আসেন না । এবার যদি বুথ না হয় তবে আমার মেয়ে পোলিও টিকা পাবে না । বুথ ছাড়া আমাদের উপায় নেই ।" আরেক অভিভাবক নাজ়েরা খাতুন বলেন, "আমার ছেলের বয়স দুই বছর । জন্মের পর থেকে তাকে পোলিও ড্রপ খাওয়ানো হয় । এখনও পর্যন্ত তার ব্যতিক্রম হয়নি । আমি বাচ্চাকে স্থানীয় বুথে নিয়ে যাই । তাই বুথ না হলে এবার আমারও অসুবিধে হবে । কোরোনা আবহে বাচ্চাকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক ।"
জেলার চিকিৎসক তথা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নীলরতন সাহা বলেন, "2011 সালে পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাতে শেষ পোলিও আক্রান্তের সন্ধান মিলেছিল । তারপর থেকে আর কোনও আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায়নি । প্রথমে বছরে ছ'বার, তারপর চার বার এই ড্রপ দেওয়া হত । এখন সেটা দু'বারে নামিয়ে আনা হয়েছে । সেটাও যদি আমরা শিশুদের দিতে না পারি, তবে পোলিও ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে ।" প্রসূতিদেরও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন টিকা দিতে হয় । এখন সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে । ফলে কোরোনার জন্য অন্যান্য রোগ যদি ফের মাথাচাড়া দেয়, তা আরও খারাপ হবে বলে মনে করছেন চিকিৎসক । লকডাউনের জন্য কিছু কর্মসূচি বাতিল করতে হয়েছে । পাশাপাশি এই ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় লোকের অভাব দেখা দিয়েছে । মালদা জেলার জনসংখ্যা প্রায় 45 লাখ । এর মধ্যে গ্রামীণ এলাকাতে বসবাস করে প্রায় 40 লাখ মানুষ । এই অবস্থায় 20 সেপ্টেম্বর পালস পোলিও বুথ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে ।