মালদা, 14 অগাস্ট : কলকাতা থেকে সড়কপথে মালদা কিংবা শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে কালিয়াচক পেরোলেই দেখা যাবে, 34 নম্বর জাতীয় সড়কের দু'ধারে বর্জ্য প্লাস্টিকের স্তূপ। সুজাপুর এলাকায় সেই ছবিটা আরও বেশি দেখা যাবে। মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত বর্জ্য প্লাস্টিক এভাবে জাতীয় সড়কের ধারে রাখা কেন? কারণটা জানলে চমকে উঠতে পারে অনেকেই। এই বর্জ্য প্লাস্টিকের উপর প্রতি বছর প্রায় 250 কোটি টাকার অর্থনীতি নির্ভর করে ওই এলাকার। এর সঙ্গে জড়িত প্রায় এক লাখ মানুষের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান। কিন্তু কোরোনার জেরে এবার বিপর্যস্ত এই ব্যবসা। এই কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের অনেকেই এখন ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। কোরোনার আতঙ্কে যারা ভিনরাজ্যে যেতে পারেনি, তারা কার্যত অর্ধাহারে পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছে।
কালিয়াচক কিংবা সুজাপুরের নাম উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে জালনোট কিংবা দুষ্কৃতী কার্যকলাপের ছবি। কিন্তু এর মধ্যেও বর্জ্য প্লাস্টিককে কেন্দ্র করে এই এলাকায় যেভাবে অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে, তা সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন। শহর কিংবা শহরতলি এলাকায় প্রতিদিনই দেখা মেলে কাগজ কুড়ানি কিংবা পুরোনো বই-খাতা ক্রেতাদের। শুধু কাগজই নয়, তারা আবর্জনার স্তূপ থেকে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিসপত্র সংগ্রহ করে। অনেকে মানুষের বাড়ি থেকে সেসব কিনে নেয়। শুধু জেলা কিংবা রাজ্য নয়, এই ছবি দেখা যায় দেশের প্রায় সর্বত্রই। আর একেই এলাকার অর্থনীতির চাকা হিসাবে বেছে নিয়েছে একশ্রেণির মানুষ। বর্তমানে সুজাপুর এলাকায় রয়েছে প্রায় 300টি স্ক্র্যাপ প্লাস্টিক ইউনিট। রয়েছে বেশ কিছু প্লাস্টিক ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটও। এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে এলাকায় তৈরি হয়েছে প্লাস্টিক ইউনিট ওনার্স ইউনিয়ন। আপাতত সেই ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা 220 । ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা ক্রমবর্ধমান । যদিও কোরোনার প্রভাব গত কয়েক মাস ধরে নতুন কোনও সদস্য বৃদ্ধি পায়নি ।
কোরোনা আবহে কেমন রয়েছে এই শিল্প? জানতে সুজাপুর এলাকায় থাকা বিভিন্ন ইউনিটে ঢুঁ মেরেছিল ETV ভারত। ক্যামেরায় উঠে এসেছে এক দুঃসহ ছবি। 32 বছর আগে পুরাতন মালদার যাত্রাডাঙা এলাকা থেকে সুজাপুরে এসে স্ক্র্যাপ প্লাস্টিক ইউনিট খুলেছিলেন মহম্মদ রাইহান শেখ। এখন তাঁর ইউনিট বেশ বড়। বর্তমানে তাঁর ইউনিটে কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। রাইহান সাহেবের গলায় উঠে এসেছে দুর্দশার কাহিনি। তিনি বলেন, "আমরা অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজ়োরাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্য থেকে বর্জ্য প্লাস্টিক কিনে আনি। তার সঙ্গে জেলা কিংবা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকেও মাল আসে। সেই প্লাস্টিক এখানে ধুয়ে সাফ করে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে প্লাস্টিকের দানা তৈরি করি। সেই কাঁচামাল দিল্লি, কলকাতা, শিলিগুড়ি, নেপাল সহ বিভিন্ন জায়গায় থাকা প্লাস্টিক কারখানায় পাঠাই। স্থানীয় এলাকাতেও বেশ কিছু ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে। সেখানেও এই কাঁচামাল যায়। প্রতি বছর এখানে প্রায় 250 কোটি টাকার ব্যবসা হয়। বর্তমানে এখানে ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত 220টি ইউনিট রয়েছে। এই কাজের সঙ্গে জেলা, রাজ্য ও ভিনরাজ্য মিলিয়ে অন্তত এক লাখ মানুষের রুজি-রোজগার জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এবার কোরোনার দাপটে আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। 75 শতাংশ ব্যবসা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সিকিভাগ চলছে। এখন ভিনরাজ্য থেকে তো দূরের কথা, জেলা থেকেও মাল পাওয়া যাচ্ছে না। কোরোনার ভয়ে মানুষ এখন নিজেদের এলাকায় প্লাস্টিক কুড়ানি কিংবা ক্রেতাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে আমার ইউনিটে যেখানে প্রতিদিন প্রায় 20 জন শ্রমিক কাজ করত, এখন সেখানে মাত্র 6-7 জন কাজ করছে। যেসব শ্রমিক কাজ পাচ্ছে না, তারাও সমস্যায় রয়েছে। শুধু আমাদের স্ক্র্যাপ ইউনিটেই নয়, এখানে যেসব ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে, তারাও সমস্যায়। তারা উৎপাদিত মাল বাইরে পাঠাতে পারছে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা নিয়ে কোনওদিন কেউ লোকসভায় কিছু বলেননি। আমরা পরিবেশ থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করে পরিবেশকে সুস্থ রাখছি। কিন্তু এই ব্যবসা চালাতে গিয়ে আমাদের পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে হচ্ছে। বিশেষত রাস্তাঘাটে। আমরা সরকারের কাছে এই সমস্যা সমাধানে সহায়তা চাইছি। তার সঙ্গে কোরোনা আবহে ভেঙে পড়া এই ব্যবসাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সরকারের কাছে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণেরও আবেদন জানাচ্ছি।"
সুজাপুর প্লাস্টিক স্ক্রাপ ওনার্স ইউনিয়নের সম্পাদক মফিজুল শেখ বলছেন, "কোরোনা আমাদের ব্যবসা পুরোপুরি শেষ করে দিয়েছে। ভিনরাজ্য থেকে মাল আর আসছে না। মাত্র 10 শতাংশ মাল নিয়ে আসতে পারছি। ফলে এর সঙ্গে জড়িত মানুষজন, বিশেষত শ্রমিকদের অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে কাজ না পেয়ে কোরোনার ভয় নিয়েই তারা আবার ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাচ্ছে। সবাইকেই তো সংসার চালাতে হবে! এখন প্রায় সবাই কর্মহীন। এই ক্ষেত্রে বছরে প্রায় 250 কোটি টাকার ব্যবসা হয়। এখন তার সিকিভাগ হচ্ছে মাত্র। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদেরই কাজের সংস্থান হচ্ছে না। তাই শ্রমিকদের জন্য বিকল্প কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগও আমাদের কাছে নেই। যে শ্রমিকরা এখনও এখানে রয়েছে, তাদের আমরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করছি। তাতেও একজন শ্রমিক মাসে সর্বাধিক 10 দিনের বেশি কাজ পাচ্ছে না। শ্রমিকদের স্বার্থে আমরা এখনও সরকারের কাছে কোনও লিখিত আবেদন জানাইনি। তবে দ্রুত সেই আবেদন জানানো হবে।"
কোরোনা আবহে শ্রমিকদের পরিস্থিতি যে দুর্বিষহ তা বোঝা গিয়েছে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে। স্ক্র্যাপ প্লাস্টিক ইউনিটের এক শ্রমিক মহম্মাদ নুরুল ইসলাম বলেন, "খুব খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। মালিক ডাকলে কাজ জোটে, নয়তো কাজ বন্ধ। মাসে 6-7 দিনের বেশি কাজ জোটে না। আমরা কীভাবে দিন চালাব, বুঝতে পারছি না। ঘরে খাবার নেই। লকডাউনের শুরু থেকে বসে রয়েছি। প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। ঘরে যা ছিল, সব শেষ। বাইরে কোথাও কাজেও যেতে পারছি না। মহাজনের কাছে যা পেতাম, সব তুলে নিয়েছি। এখন আর করে সংসার চালাতে হচ্ছে। একদিন খাবার জুটলে পরের দিন না খেয়ে থাকতে হয়। আমি একা নই, এখানে আমার মত হাজার হাজার শ্রমিক রয়েছে। মালিকপক্ষ যতটা পারছে সাহায্য করছে। তবে তারাও তো চিরদিন সাহায্য করতে পারবে না! কোরোনা যতদিন না বিদায় নেবে, ততদিন আমাদের এভাবেই থাকতে হবে।" প্লাস্টিক গুডস প্রোডাকশন ইউনিটের এক শ্রমিক, মোথাবাড়ি এলাকার গঙ্গাপ্রসাদ গ্রামের বাসিন্দা সাফিউল শেখ বলেন, "আমরা এখন ঠিকমতো কাজই পাচ্ছি না। উৎপাদিত সামগ্রীও বাইরে পাঠানো যাচ্ছে না। তাই সংসার চালানোর দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সপ্তাহে দু'দিনের বেশি কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। এই ব্যবসার প্রতিটি ক্ষেত্রে একই দশা। মাল বিক্রি হচ্ছে না বলে অনেক মালিক নিজেদের ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছেন। দিনে আমরা 300 টাকা করে মজুরি পাই। অর্থাৎ এখন সপ্তাহে 600 টাকার বেশি রোজগার নেই। এই টাকায় কি সংসার চালানো যায়? মালিকরাও বা সাহায্য করবেন কীভাবে? তাদেরও ব্যবসা চলছে না। এখন গাড়িঘোড়া ঠিকমতো চলাচল না করায় অনেক শ্রমিক কাজ করতে বাইরে যেতে পারছে না। আমিও সেই কারণে ভিনরাজ্যে যেতে পারিনি। সুযোগ পেলেই ভিনরাজ্যে যাব।"
কোরোনার প্রভাবে ধস নেমেছে দেশের অর্থনীতিতে। কর্মহীন বহু মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। কিন্তু কবে কালিয়াচক-সুজাপুরের বর্জ্য প্লাস্টিকের ব্যবসা পুনরুজ্জীবিত হবে, কবে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা নিশ্চিন্তে দু'বেলা পেটের ভাত জোগাড় করতে পারবে, প্রতীক্ষা এখন তারই।