কলকাতা, 2 অগাস্ট: এ-দেশে বাইক আরোহী হেলমেট পরেন, কারণ হেলমেট ছাড়া রাস্তায় বের হলে পুলিশ ধরবে ৷ হেলমেট না পরা অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটলে তিনি আহত বা নিহত হতে পারেন, তার জন্য নয় ! কোরোনা আবহে মাস্ক পরার ব্যাপারটাও যেন এক ! হাজার বোঝালেও বুঝছেন না একশ্রেণির মানুষ ৷ এই অবস্থায় “এখনও কোরোনা, রয়েছে দাপট; বাইরে বেরোলে মাস্কে সাপোর্ট ৷" এই মর্মে প্রচার শুরু করেছে কলকাতা পুলিশ । কলকাতা পুলিশের "মাস্ক আপ কলকাতা" উদ্যোগে সামিল হয়েছেন সেলেবরাও । সোশাল মিডিয়ায় ভিডিয়ো প্রচারে অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় থেকে সাংসদ অভিনেতা দেব । পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, সাংসদ অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী ও নুসরত জাহানরা মাস্কের পক্ষে সওয়াল করেছেন । হায় ! শহর প্রশাসনের নয়া উদ্যোগের পরেও হুঁশ ফিরল কই? ETV ভারতের ক্যামেরায় তো দেখা গেল অন্য চিত্র !
মাস্কের পক্ষে সোশাল মিডিয়ার ভিডিয়ো ক্যাম্পেনে নুসরত জাহানের আহ্বান জানান, “বাড়ির বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরুন । আমি পড়ছি, আপনি পড়েছেন তো?" মিমি চক্রবর্তীকে বলতে শোনা গেছে, “মাস্ক পরছেন তো? মনে রাখবেন, কোরোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মাস্ক আপনাকে অনেকটাই সুরক্ষিত করবে । সম্প্রতি কলকাতা পুলিশ একটি প্রচার শুরু করেছে, যার নাম মাস্ক আপ কলকাতা । তাতে সামিল হোন । অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন ।" পরিচালক রাজ চক্রবর্তী, অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়ও সাধারণ নাগরিককে মাস্ক পরতে অনুরোধ করেছেন । সর্বোপরি কলকাতার পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মার বক্তব্য, “মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়েছে । তার পরেও অনেককেই দেখা যাচ্ছে মাস্ক পরছেন না । অনেকের কাছে মাস্ক থাকলেও তা থাকছে পকেটে কিংবা নামিয়ে রাখা হচ্ছে থুতনির নিচে । সেটা ঠিক নয় । সেই কারণেই কলকাতা পুলিশের তরফে আমরা মাস্ক আপ কলকাতা নামে একটি ক্যাম্পেনের আয়োজন করেছি । " পুলিশ কমিশনার সতর্ক করে দিয়েছেন, "মাস্ক না পরলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।"
গত 12 এপ্রিলেই মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে নির্দেশিকা জারি করেছিল রাজ্য সরকার । তাতে বলা হয়, মাস্কের ব্যবহারে অনেকটাই কমানো যায় সংক্রমণ । অতএব, মাস্ক ব্যবহার বাঞ্ছনীয় । আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, স্বাস্থ্যবানদের মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই । যারা অসুস্থ, যারা চিকিৎসা কিংবা পরিচর্যা করছেন তাদের মাস্ক পরা দরকার । কিন্তু, গত জুন মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা বদলে যায় ৷ নতুন গাইডলাইনে বলা হয়, জনসমক্ষে সকলকেই মাস্ক পরতে হবে । মাস্কে তিনটি স্তর থাকতে হবে ৷ এরপরই সব দেশ মাস্ক পরার পক্ষে নির্দেশিকা জারি করে । চিকিৎসকরা বলছেন, হাসলেও ক্ষুদ্রতম জলকণা মুখ থেকে বেরিয়ে বাতাসে ছড়ায় । কথা বললেও অনেক সময় থুতু ছিটকে বের হয় । খালি চোখে যা দেখা যায় না । অতএব, মুখে মাস্ক না থাকলে এই পথে ছড়াতে পারে সংক্রমণ ৷ এই অবস্থায় মাস্ক পরায় জোর দিয়েছে পুলিশ প্রশাসন । কিন্তু, এই জরুরি তথা কঠিন সত্যি বুঝেছে কলকাতা?
সম্ভবত বোঝেনি ! কারণ শহরের পথে ঘাটে এখনও মাস্ক ব্যবহার না করা মানুষের ভিড় দেখা গেল ! যাঁরাও বা পরছেন তাঁদের মাস্ক ঝুলছে থুতনির নিচে । এই যেমন কলকাতা পৌরনিগমের এক সাফাই কর্মীর কথাই ধরা যাক । কোরোনার বাজারে যার কাজ বাস্তবিক ঝুঁকিপূর্ণ ৷ সেই তাঁকে দেখা গেল নাকের নিচে মাস্ক নামিয়ে কাজ করছেন রাস্তায় । “মাস্ক ব্যবহার করছেন না কেন?" এই প্রশ্নে হাত না ধুয়েই নাকের উপরে মাস্ক টেনে তুললেন মহিলা সাফাই কর্মী । বললেন, “গরম লাগছে, মুখ-নাক ঘেমে যাচ্ছে । তাই নামিয়ে রেখেছিলাম ।"
গণ পরিবহন ও গণ পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের মাধ্যমে দ্রুত ছড়াতে পারে সংক্রমণ ৷ সেই কারণেই গাড়ি নিয়মিত স্যানিটাইজ করা, মাস্কের ব্যবহার ও যাত্রীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে সরকার । কিন্তু, রাজপথে এখন এমন কিছু ট্যাক্সিচালককে দেখা গেল যাঁরা মাস্ক না পরে দিব্য রাস্তায় । কেন? প্রশ্নটা করতেই যাত্রীর অপেক্ষায় রাস্তার দাঁড়িতে থাকা এক ড্রাইভার তড়িঘড়ি মাস্ক চাপালেন মুখে ৷ হেসে বললেন, “পরছি তো । সব সময় পরে থাকা যাচ্ছে না ।" পাড়ার গলির মোড়ে আড্ডা দেওয়া মানুষজনের অবস্থাও তথৈবচ । এক যুবক খালি গায়ে বসেছিলেন রাস্তায় পাশে । মাস্কের কথা জিজ্ঞেস করতেই দৌড় ! একজন হাতে করে টিফিন কেরিয়ার ঝুলিয়ে পার হচ্ছিলেন রাস্তা । মাস্ক নেই ! প্রশ্ন করতেই বললেন, “ভুল হয়ে গেছে । চা আনতে বেরিয়েছিলাম তো ।" কথা শেষ করতে না করতেই পালিয়ে বাঁচলেন ভদ্রলোক ! এ তবুও ভালো ৷ কিন্তু, অসচেতন শহরবাসী মাস্ক পরছেন না, এই মর্মে প্রতিবেদন করতে গিয়ে হুমকির মুখে পড়তে হল ETV ভারতকে ! এক যুবক থুতনির নিচে মাস্ক নামিয়ে রাস্তায় ঘুরছিলেন । তাঁকে সে বিষয়ে প্রশ্ন করতেই মাস্ক নাকে টেনে তুলে সে বলল, “ তোমরা বহুত বেশি করো ! আমি চোর আছি ! চুরি করতে বেরিয়েছিলাম !" এরপর ETV ক্যামেরায় দিল এক ঠেলা । মাস্ক না পরলেও হুঁশ আছে যে ছবি উঠছে ক্যামেরায় । অতএব, সাংবাদিককে থ্রেট, "পাশের বস্তিতে এলে কাটারি দিয়ে কুপিয়ে খুন করব ।" তবু, আশার আলো বলতে কর্তব্যে অবিচল কলকাতা পুলিশ ৷ পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি । সেক্ষেত্রে আইনি পদক্ষেপ করছি আমরা ।"
তথ্যও তাই বলছে, লকডাউন অমান্য করায় শুধুমাত্র জুলাই মাসে 11,850 জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কলকাতা পুলিশ । মামলা রুজু হয়েছে 2,453 টি । মাস্ক না পরায় 14 হাজার 398 জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে । প্রকাশ্যে থুতু ফেলার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে 1,111 জনকে । এছাড়াও লকডাউন বিধি ভাঙায় 576 টি গাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে । যদিও এরপরও শহরের যে চিত্র উঠে এল ETV ভারতের ক্যামেরায় তা কিন্তু ভয়াবহ, রীতিমতো উদ্বেগের ৷ যে মাস্ক পরছে না, স্বাস্থবিধি মানছে না, শুধু তার জন্যই নয় ৷ যিনি মানছেন তাঁর জন্যও ৷