কলকাতা, 23 জুলাই: উভয়সংকট থেকে মুক্তি খুঁজছে বিশ্ব ৷ মহামারী যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনই সচল রাখতে হবে অর্থনীতি ৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতদিন না ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগ হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত বাড়তি সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউনই একমাত্র পথ ৷ কিন্তু, লকডাউন মানেই নিশ্চিত অর্থনৈতিক বিপর্যয় ৷ ব্যক্তির হোক বা রাষ্ট্রের ৷ টানা লকডাউনে কাজ হারিয়েছে অসংখ্য মানুষ ৷ গরিব আরও গরিব হয়েছে ৷ ধ্বংস হয়েছে ছোটো ও মাঝারি বাণিজ্য ক্ষেত্র ৷ পরিজনকে বাঁচাতে পেশা বদলেছে অসংখ্য মানুষ ৷ এমন একটা সময়ে নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৷ তবে, এই লকডাউন নতুন ধাঁচের ৷ এর আগে রেড-অরেঞ্জ-গ্রিন জ়োনে ভাগ করা হয়েছে সংক্রমিত জেলাগুলিকে ৷ সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে হটস্পট ও কনটেনমেন্ট জোন ঘোষণা করা হয়েছে নির্দিষ্ট এলাকাকে ৷ এবার আর এলাকা ভিত্তিক নয় ৷ নতুন করে গোটা রাজ্যেই লকডাউন ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার ৷ তবে সপ্তাহে দু'দিন ৷ চলতি সপ্তাহে বৃহস্পতি ও শনিবার সম্পূর্ণ লকডাউন ৷ আগামী সপ্তাহে লকডাউনের প্রথম দিন বুধবার, দ্বিতীয় দিন ঘোষিত হবে ৷ এই দু'দিন শুধুমাত্র জরুরি পরিষেবা পাবে জনতা ৷ কিন্তু, প্রশ্ন উঠছে ৷ COVID-19 প্রতিরোধে প্রতি সপ্তাহে দু'দিনের লকডাউন কি বিজ্ঞানসম্মত ? এভাবে কি মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ রোখা সম্ভব?
প্রশ্ন যেমন রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তুলছে, তেমনই সাধারণ নাগরিকেরও কৌতূহল ৷ যদিও রাজ্যের তরফে জানানো হয়েছে, বিশেষজ্ঞের পরামর্শেই এই সিদ্ধান্ত ৷ এতে ভাঙবে সংক্রমণের শৃঙ্খল ৷ যখন কোথাও কোথাও গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে ৷ তখন সম্পূর্ণ লকডাউন ছাড়া উপায় নেই ৷ অন্যদিকে বিপর্যস্ত রাজ্যের অর্থনীতি ৷ ফলে টানা লকডাউন সম্ভব ছিল না ৷ সবদিক ভেবেই সপ্তাহে দু'দিনের লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ সম্প্রতি এবিষয়ে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও'ব্রায়েন জানান, এপিডেমিলজিস্টরা দু'সপ্তাহ কড়া লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছিলেন ৷ অর্থনীতিবিদরা যা পুরোপুরি মানতে পারেননি ৷ এই প্রেক্ষিতে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সেস-এর (IISc) একটি গাণিতিক মডেলের সাহায্য নেওয়া নিয়েছে রাজ্য ৷ বিশেষজ্ঞদের সেই মডেল কেমন?
গত মে মাসেই চেন্নাই ম্যাথেমেটিক্যাল ইনস্টিটিউট ও বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সেস-এর (IISc) দুই বিশেষজ্ঞ জানিয়েছিলেন, প্রক্ষিপ্ত লকডাউনেও কমতে পারে সংক্রমণের পরিমাণ ৷ কমানো সম্ভব মহামারীর মেয়াদও ৷ IISc-র অধ্যাপক চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য ও ভি বিনয় সে সময় জানান, সপ্তাহে পাঁচ দিন লকডাউন ও দু'দিন কাজের জন্য নির্ধারিত করা গেল 30% সংক্রমণ কমানো সম্ভব ৷ সরকারকে TC2S (ট্রেসিং কনটাক্টস অ্যান্ড দেয়ার কনটাক্ট অ্যান্ড সিলিং) প্রক্রিয়ায় লকডাউনের পরামর্শ দেন তাঁরা ৷ অর্থাৎ কিনা, সংক্রমিতের সংস্পর্শে এসেছে যারা তাদের চিহ্নিত করা, সেই তাদের সংস্পর্শে এসেছেন কারা তাও চিহ্নিত করা ৷ এবং সেইমতো সেই অঞ্চলে কড়া লকডাউন জারি করা ৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, দু'দিন হোক বা সাতদিন TC2S পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে ৷ না হলে সমস্তই বৃথা যাবে ৷ তাদের কথায়, একটি সংখ্যতত্ত্ব অনুযায়ী TC2S সঠিকভাবে কার্যকর হলে তুলনায় শিথিল লকডাউনেও মহামারীর মেয়াদ হতে পারে 274 দিন ৷ অন্যদিকে, TC2S ছাড়া সেই মেয়াদ বেড়ে হবে 480 দিন ৷ তবে, এলাকাভিত্তিকভাবে সমস্ত অঙ্কই বদলে যেতে পারে ৷ কারণ, সংক্রমণের মাত্রা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপরে ৷ যার মধ্য রয়েছে কোনও একটি অঞ্চলের জনঘনত্ব ও জনতার গড় বয়স ৷ এই দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে কোথাও সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায়, কোথাও তুলনায় শ্লথ গতিতে ৷
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সেস-এর (IISC) দুই সংখ্যা বিজ্ঞানী শশীকুমার গণেষণ ও দীপক সুব্রামণ্যমের গবেষণাও বলছে, প্রক্ষিপ্ত লকডাউনে সংক্রমণে শৃঙ্খলা ভাঙা সম্ভব ৷ তাঁদের মতে, সপ্তাহে দু'দিন, ধরা যাক, রবিবার ও বুধবার সম্পূর্ণ লকডাউন করা গেল ৷ এতে করে সংক্রমণের মাত্রা অনেকটা কমে যাবে ৷ ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সেস-এর গাণিতিক মডেলের পূর্বাভাস, অক্টোবরের মধ্যে রাজ্যে 1 লাখ মানুষ কোরোনায় সংক্রমিত হতে পারেন ৷ সপ্তাহে একদিন লকডাউন হলে সংক্রমিতের সংখ্যা কমে হবে 40 হাজার ৷ সপ্তাহে দু'দিন লকডাউন হলে সংখ্যাটা 20 হাজারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে ৷ তবে, গাণিতিক মডেলের গ্যারান্টি দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা ৷ যেহেতু সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কি না, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ইত্যাদির উপর অনেকটাই নির্ভর করছে ৷ তবে, বর্তমান অবস্থায় রাজ্যের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন রাজ্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও ৷
একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডাঃ নিবেদিতা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, "ইতিবাচক পদক্ষেপ । রাজ্যে যেভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তাতে অন্তত সপ্তাহে দু'দিন মানুষের মুভমেন্ট কমানো যাবে ৷ বৃহস্পতিবার যেমন সফল লকডাউন হয়েছে, এটা যদি হয় তাহলে সংক্রমণের হার কমবে ।"
তবে তিনি এও বলেন, "COVID-19-এর যেটা ইনকিউবেশন পিরিয়ড তা 14 দিন ৷ সেটা কভারড হচ্ছে না । দু'দিনের লকডাউনের নেতিবাচক দিক হল, একদিনের লকডাউনে অন্য দিন মানুষের মুভমেন্ট বেড়ে যায় । আইডিয়ালি 14 দিন লকডাউন করা উচিত । অথবা সাত দিন লকডাউন, সাত দিন আনলক । সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যা হবে । সেদিক থেকে দু'দিনের লকডাউন ইতিবাচক পদক্ষেপ । "
জোকা ESI হাসপাতালের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর রঞ্জয় মজুমদার বলেন, "মানুষ সচেতন না হলে কিছু হবে না ৷ আমার মতে, অনেক বেশি ভালো হত যদি পর পর দু'দিন লকডাউন করা যেত । কারণ, প্রকৃত উদ্দেশ্য, যাতে করে একজনের থেকে আর একজনে ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে । এক্ষেত্রে টানা যত বেশি দিন লকডাউন হবে তত ভালো ৷"
পুরুলিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সূর্যজ্যোতি চৌধুরি খানিক সন্দিগ্ধ ৷ তিনি বলেন, "এভাবে সংক্রমণ রুখে দেওয়া সম্ভব কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না । তবে, এখন যদি টানা লকডাউন হয় তবে অর্থনৈতিক বিপদ হবে । তাই যতটা লকটাউন করা যায়, সেভাবেই হচ্ছে ।" তিনি আরও বলেন, "সরকার চাইছে মানুষ রোজগার ঠিক রেখে খেয়ে-পরে বাঁচুক ৷ তাই ইন্টারেপটেড লকডাউন ৷"
এদিকে স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী বলেন, "প্রথম কথা, এটা লোক দেখানো । লোকের দৃষ্টিকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া । এমন একটা ভাব দেখানো, দেখ আমি করছি । দ্বিতীয় কথা, এখন আর এই স্টেজে এসে লকডাউনের কোনও উপকারিতা নেই । লকডাউন মানে তো শুধু বন্ধ করা নয় । তার পাশাপাশি ব্যবস্থা নিতে হয় । সেগুলি না করে শুধুমাত্র লকডাউনের ঢাক বাজিয়ে কিছু লাভ হয় না ।"
দুর্গাপুজোয় ঢাকে যখন কাঠি পড়বে তখন আপনা থেকেই পা নড়ে উঠবে । সেই তালে তালে নাচ শুরু হয়ে যায় । তবে শুধু ঢাক বাজলেই হবে না । তার সঙ্গে কুড়কুড়ি আর কাসর-ঘণ্টা, এই তিনটে একসঙ্গে বাজতে হবে, তবেই পা নড়ে উঠবে, তালে তালে নাচটা হবে । এমন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, "এখানেও ঠিক তেমনই । লকডাউন হল ঢাক । শুধু ঢাক পেটালে লাভ নেই । COVID-19 তাড়ানোর নাচ, নাচতে হবে । COVID-19 তাড়ানোর নাচ নাচতে হলে, কুড়কুড়ি এবং কাসর-ঘণ্টা, এই দুটোও বাজতে হবে । কুড়কুড়ি এবং কাসর-ঘণ্টা অর্থাৎ, টেস্ট আর COVID-19-এর ত্রিস্তরীয় রোগী ম্যানেজমেন্ট । টেস্ট মানে অ্যাক্টিভ সার্ভেইলেন্স (ইনস্টিটিউশনাল এবং কমিউনিটি টেস্টিং) ।"
প্রকৃতপক্ষে মহামারী আর অর্থনীতির জটিলতম উভয় সঙ্কটে অন্য উপায় জানা নেই বিশেষজ্ঞদেরও ৷