কলকাতা, 15 অগাস্ট : খাদি বলতে একসময় লোকে বুঝতো শুধু জামা-কাপড় । এখন কিন্তু খাদি মানে কেবল জামা-কাপড় নয় । বাঁকুড়ার বালুচরির পাশাপাশি খাদি বলতে বাঁকুড়ার পাথরের কাজ, মধু, ডোকরা ও শালপাতার হস্তশিল্পকেও বোঝায় । আর এই খাদি শিল্প এখন পৌঁছে গেছে কলকাতার ও দেশের বিভিন্ন শপিং মলে । তন্তুজ, মঞ্জুষার পণ্যকে ক্রেতাদের কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার । এর ফলে তাদের শোরুম এখন কোয়েস্ট ও সাউথ সিটির মতো মলে । মানুষের কাছে তন্তুজ ও মঞ্জুষার পণ্যকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য সরকার । দপ্তরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ এবং পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রি বোর্ডের চেয়ারম্যান গৌরী শঙ্কর দত্ত জানিয়েছেন, ঢেলে সাজানো হচ্ছে তন্তুজ ও মঞ্জুষাকে ।
এক সময় শোনা যেত আঙ্গুলের আংটির ভিতর দিয়ে ঢাকাই মসলিন শাড়ি ঢুকে যেত । সেই শাড়ি যে সত্যি তৈরি করা সম্ভব তা এখন দেখাচ্ছেন খাদির শিল্পীরা । খাদিতে এখন পাওয়া যাবে মসলিন শাড়ি । গ্রাম বাংলার শিল্পীরাই তৈরি করছেন সেই শাড়ি । আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তুলো থেকে সুতো বের করে মসলিন শাড়ি তৈরি করছে খাদি গ্রামোদ্যোগ । আর ক্রেতাদের সেই শিল্পীদের তৈরি মসলিন সহ অন্যন্য সামগ্রী কিনতে উৎসাহিত করতে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে 50 শতাংশ ছাড় দেওয়া হচ্ছে । বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, মালদা সহ সাত-আটটি জেলায় একগুচ্ছ কারিগর তৈরি করছেন মসলিন শাড়ি । ইতিমধ্যেই সারা পৃথিবীতে রপ্তানি করা হচ্ছে বাংলার মসলিন ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তৈরি হচ্ছে মসলিন শাড়ি । তবে শুধু মসলিন শাড়ি নয় । ঝাড়গ্রামের শালপাতার সামগ্রীও পাওয়া যাচ্ছে খাদির শোরুমগুলিতে । শালপাতা সংগ্রহ করে রাজ্য সরকার কিনে নিচ্ছে । IIT খড়গপুরের সহযোগিতায় রাজ্য সরকার শালপাতা থেকে আকর্ষণীয় সামগ্রী তৈরি করছে । স্বনির্ভর সংস্থার মহিলারা তৈরি করছেন শালপাতার থালা ।
চিরাচরিত ধারণা ছিল, সুতো থেকে কাপড় কেটে খাদির সামগ্রী তৈরি হয় । এবার তার বাইরে নলেন গুড় ও মধু মিলছে খাদি উদ্যোগের মাধ্যমে । ডোকরা, কাঠের কাজ, সবংয়ের মাদুর তৈরি হচ্ছে খাদিতেই । প্রতি জেলায় এরকম বিভিন্ন খাদি সামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খাদির নিজস্ব ভবন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থার চেয়ারম্যান গৌরীশঙ্কর দত্ত । শুধুমাত্র পরিধান সামগ্রী নয়, টিউবে পাওয়া যাচ্ছে নলেন গুড়, যার মেয়াদ দীর্ঘস্থায়ী । পাশাপাশি মধুও আনা হয়েছে বাজারে । ডাবরের সঙ্গে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা করে বাজারে এখন টিকে থাকাটাই তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান । খাদির তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাচ্ছে খাদি উদ্যোগের দৌলতে ।
মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, "তন্তুজ একসময় রুগ্ন প্রতিষ্ঠান ছিল ।" আগের বাম সরকারের উপর দায়ভার চাপিয়ে তিনি বলেন, "তনুশ্রীর মতো (বাম সরকার) গুটিয়ে দিতে চেয়েছিল তন্তুজকে । কিন্তু বর্তমান সরকার সে কাজ করতে দেয়নি । বর্তমান সরকার আসার আগে 149 কোটি টাকা দেনা ছিল তন্তুজের । তবে সে সব পিছনে ফেলে তন্তুজ এখন লাভের মুখ দেখছে । 2018-19 আর্থিক বর্ষে 14 কোটি 16 লাখ টাকা লাভ করেছে তন্তুজ । পাশাপাশি তন্তুজের কোনও ব্যাংক ঋণও নেই বর্তমানে । যদিও নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে এখনও এক বছর সময় লাগবে । ইতিমধ্যেই অ্যামাজ়ন, ফ্লিপকার্টের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা তন্তুজ সামগ্রী কিনে বিক্রি করছে বিশ্বব্যাপী ।"
স্বপন দেবনাথ বলেন, "আমাদের রাজ্যের কাপড় যাচ্ছে অন্য রাজ্যে । বিনিময় প্রথার মাধ্যমে অন্য রাজ্যের কাপড় এই বাংলায় বিক্রি করা হচ্ছে তন্তুজের মাধ্যমে । সারা বছর তন্তুজের সমস্ত সামগ্রীতে ছাড় পাওয়া যায় । আলোছায়া, রোদ বৃষ্টি, নামে নতুন দুটি শাড়ি তৈরি করেছিল তন্তুজ । প্রচুর মানুষ সেই শাড়ি কিনেছেন । ভালো বিক্রি হয়েছে । বিদেশও বিক্রি হচ্ছে তন্তুজের শাড়ি । তন্তুজের শোরুমগুলিকে সাজানো হয়েছে । বাংলার তাঁতের শাড়ির সঙ্গে অন্য রাজ্যের কাপড় বিক্রি হচ্ছে সেখানে । নতুন নতুন নকশায় তৈরি হচ্ছে আধুনিক প্রজন্মের মনের মতো শাড়ি । তন্তুজ ভালো অবস্থায় আছে । খাদি মানে তুলো সুতো নয় । এখন খাদিতে নিত্যনতুন জিনিস পাওয়া যায় । বাতাসা, মিছরি, নকুলদানা এমন কী দুলালের তাল মিছরি খাদির দোকানে পাওয়া যাচ্ছে । রাখি শিল্পীরাও তাদের রাখি বিক্রি করে অর্থের মুখ দেখতে পাচ্ছেন । 260 জন কর্মীর স্থায়ী চাকরি হয়েছে রাখি শিল্পী হিসাবে । মসলিন শাড়ি তৈরির শিল্পে প্রায় 700 জন শিল্পী কাজ করছেন । তন্তুজ, মঞ্জুষা এখন আর অলাভজনক প্রতিষ্ঠান নয় । খাদি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে । কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হচ্ছে ।"
বিরোধীদের সমালোচনা প্রসঙ্গে স্বপন দেবনাথ বলেন, "এই মেলাতেই তো গ্রামীণ শিল্পীরা সুবিধা পায় । বর্ধমানের প্রত্যন্ত গ্রামের কাঠ শিল্পের সামগ্রী সল্টলেকের মেলায় বিক্রি হয় । কোনওদিনও গরিব শিল্পীরা ভাবেনি তাদের হাতের কাজের কদর শহরে এ ভাবে দেবে । গ্রামীণ শিল্পীরা সুবিধা পায় । গ্রামের পণ্য শহরে আসে । তন্তুজে তৃণমূলস্তরের মানুষ কাজ করছে । আধুনিক ডিজ়াইন দেখেই রাজ্য সরকারের তন্তুজ গ্রামীণ শিল্পীদের কাছ থেকে কাপড় কেনে । গরিবের শাড়ির ক্ষেত্রে 99 টাকা সরকার ভর্তুকি দেয় । এর ফলে মাত্র 6 টাকায় গরিবের শাড়ি পাওয়া যায় তন্তুজ থেকেই । শহরের বিভিন্ন রেশন দোকান সেই শাড়ি বিক্রি করছে গরিব মানুষের জন্য ।"