কলকাতা, 13 এপ্রিল : বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ বয়কট করাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই উত্তাল কলকাতা হাইকোর্ট (Tensed Situation at Calcutta HC over Boycott Justice Avijit Ganguly Issue) । সকালে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে ঢুকতে গেলে তৃণমূল সমর্থিত আইনজীবীরা বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেস সমর্থিত আইনজীবীদের বাধা দেন বলে অভিযোগ ।
এরপর দু’পক্ষের হাতাহাতি, ধস্তাধস্তিও হয়৷ দীর্ঘ বাকবিতণ্ডাও চলতে থাকে । বিজেপি তরফের একাধিক আইনজীবী প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টি উল্লেখ করলে প্রধান বিচারপতি নিজেদের মধ্যে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার আর্জি জানান । কিন্তু তার পরেও কিছুই হয়নি ।
কিছুক্ষণ পরে দলে দলে আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে ভিড় করতে শুরু করেন । বাধ্য হয়ে শুনানি পর্ব বন্ধ রেখে দেন ছেড়ে উঠে যান প্রধান বিচারপতি । এরপর দীর্ঘ প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো সময় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে মামলার শুনানি বন্ধ থাকে ।
অন্যদিকে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই পরিস্থিতির মধ্যেও সিঙ্গেল বেঞ্চে নিজের শুনানির কাজ চালিয়ে যান । তবে তিনি পরিষ্কার জানান, এই মুহূর্তে তিনি দুই পক্ষের কোনও এক পক্ষ যদি উপস্থিত না থাকে, তাহলে কোনও মামলায় তিনি নির্দেশ দেবেন না ।
ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতি রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল সৌমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বর্ষীয়ান আইনজীবী অনিন্দ্য মিত্র ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ও অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেল বিল্বদল ভট্টাচার্যর এই সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন ৷ তার পর সমাধানের বিষয়টি নিয়ে মতামত দেবেন বলে জানা গিয়েছে ৷
এদিকে আদালতের প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার পরই কলকাতা হাইকোর্টের (Calcutta High Court) বি গেটের সামনে সব রাজনৈতিক দল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে । সিপিআইএমের তরফের বিক্ষোভে উল্লেখ করা হয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বলে শাসক দল বিচারপতিকে বাকরুদ্ধ করতে চাইছে । আসলে আদালতকেও নিজেদের কব্জায় নিতে চাইছে শাসক দল । সকালবেলা বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে শাসকদলের আইনজীবীরা হেনস্তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা ৷
বিজেপির তরফেও মোটামুটি একই অভিযোগ করা হয় । বিজেপি সমর্থিত আইনজীবীরা জানান, কলকাতা হাইকোর্টকে পার্টি অফিস বানাতে চাইছে শাসক দল । কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা এতদিন পর্যন্ত দলমত নির্বিশেষে নিজেদের কাজ করতেন ৷ কিন্তু বর্তমান শাসক দলের কিছু পেটোয়া বাহিনী কলকাতা হাইকোর্টকে নিজেদের পার্টি অফিস বানিয়ে নিতে চাইছে । কলকাতা হাইকোর্টের ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন ।
অন্যদিকে রাজ্যের শাসক দল সমর্থিত আইনজীবীদের তরফে বিশ্ব বসুমল্লিক জানান, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ বয়কট করা নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত বার অ্যাসোসিয়েশনের হয়েছে । যদি সিদ্ধান্ত না নেওয়া হত, তাহলে এত ঝামেলা হত না । একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই এখন তার বিরোধিতা করছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো । নিজেদের প্রচার পাওয়ার স্বার্থে শাসকদলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে ।
কলকাতা হাইকোর্ট বার অ্যাসোসোসিয়েশনের সভাপতি অরুণাভ ঘোষ বলেন, "বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে রাজ্যের শাসক দল । হাইকোর্টকেও কবজা করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ।" পাশাপাশি বার অ্যাসোসিয়েশনে সহ-সভাপতি কল্লোল মণ্ডল বলেন, "সকালে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গেল বেঞ্চে প্রবেশ করা নিয়ে শাসক দলের পেটোয়া আইনজীবীরা চূড়ান্ত হেনস্তা করেছে আমাকে । মারার চেষ্টা ও করা হয় । কোনও রকমে বেঁচে গিয়েছি । আসলে শাসক দল হাইকোর্টকে তাদের পার্টি অফিস বানাতে চাইছে ।"
অন্যদিকে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, যাকে নিয়ে এই মুহূর্তে কলকাতা হাইকোর্ট চত্বর উত্তাল, সেই বিচারপতি একটি মামলার শুনানির সময় তাঁর বিরুদ্ধে যে চিঠি শাসক দলের তরফে দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যাপারে তিনি বর্ষীয়ান আইনজীবী চণ্ডীচরণ দে-কে বলেন, "আমার বিরুদ্ধে লেখা চিঠিতে আপনি স্বাক্ষর করেছেন৷ এটা আমার খুব খারাপ লেগেছে ৷ চিঠিতে স্বাক্ষর করতে গিয়ে আমার কথা মনে পড়ল না আপনার ?"
চণ্ডীচরণ দে বিচারপতিকে বলেন, ‘‘আমি আপনার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ নই ৷ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ নিয়ে আমার আপত্তি ।’’ তখন বিচারপতি পালটা বলেন, ‘‘আমি তো তার বিস্তারিত বিবরণ নির্দেশিকাতে দিয়েছি । আপনারা রাজনীতি করছেন করুন । কিন্তু আমি রাজনীতি করছি না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে বিচার করছি । কিছুদিন আগে অশোক দেবের সঙ্গে আমার দেখা হয় । তার সঙ্গে একসঙ্গে বসে আমি চা খেয়েছি। আমি বলি অশোকদা আপনি আমার বিরুদ্ধে যা বলছেন সেটা আপনি মন থেকে মেনে নিতে পারছেন? অশোকদা আমাকে অনেক কথা বলেন । জানি না আজ উনি নবান্নে গিয়ে কি বলবেন । অশোকদা যে চিঠি দিয়েছেন, সেই চিঠি কে লিখেছেন আমি জানি । তিনি আমার কাছে নমস্য ব্যক্তি।’’
চণ্ডীচরণ দের উদ্দেশ্যে বিচারপতি আরও বলেন, ‘‘চন্ডীবাবু আপনি এবং অশোক দেব আমার বিরুদ্ধে যখন সই করেছেন, আমি খুব দুঃখ পেয়েছি । আমি দুর্নীতি দেখলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো । তাতে আমার মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি থামবো না । কোনও আমলেই দুর্নীতির শেষ নেই । দুর্নীতি বন্ধ করতে আপনারা আদালতকে সহযোগিতা করুন ।"
আরও পড়ুন : SSC Recruitment Case : শিক্ষক নিয়োগ মামলায় চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ হাইকোর্টের, স্বস্তিতে পার্থ