বিধাননগর, 22 জুলাই : একদিকে তখন এলাহি আয়োজন । দূর দূর থেকে আসা তৃণমূল কর্মীদের জন্য চলছে রান্না-বান্না । ঠিক উলটোদিকে, পেটে খিদে নিয়ে রোদে পুড়ে অবস্থান চালাচ্ছেন শিক্ষকরা । দেখতে দেখতে পার হয়েছে 9 দিন । প্রশাসন সদুত্তর দেয়নি । বেতন বাড়ানোর দাবিতে ঠায় বসেই আছেন সমাজ গড়ার কারিগররা । দাবি ? বেতন বাড়ান । তার জন্য কি না প্রশাসনিক প্রধানের কাছ থেকে শুনতে হল, "চাইলে দিল্লির চাকরি করুন ।"
গতকাল তৃণমূলের উদ্যোগে পালিত হয় শহিদ দিবস । শহিদ-মঞ্চ থেকে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি একপ্রকার হুঁশিয়ারি দেন অবস্থানরত শিক্ষকদের । বলেন, "হঠাৎ দেখছি, কাজ নেই-কর্ম নেই বসে পড়েছে রাস্তায় । সবাইকে টাকা দাও, আর কেন্দ্রীয় সরকারের সমান মাইনে দাও । যারা কেন্দ্রীয় সরকারের সমান মাইনে চান, তাঁরা কেন্দ্রে চলে যান, দিল্লির চাকরি করুন । আমার কোনও আপত্তি নেই, বরং খুশিই হব ।" মুখ্যমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যে ক্ষোভ বাড়ছে । শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন, "তাহলে কি যোগ্যতা অনুযায়ী মাইনে চাওয়ার অধিকার নেই ?"
বেতন বৃদ্ধি সহ একাধিক দাবিতে উসতি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (UUPTWA) ব্যানারে 12 জুলাই (শুক্রবার) বেলা 12টা নাগাদ করুণাময়ী থেকে মিছিল করে সল্টলেকের উন্নয়ন ভবনের সামনে অবস্থান শুরু করেন হাজারেরও বেশি প্রাথমিক শিক্ষক । পরদিন বেলা 12টা থেকে অবস্থানের পাশাপাশি অনশন কর্মসূচি শুরু করেন বেশ কয়েকজন । দেখতে দেখতে কেটেছে দিন । কিন্তু, প্রশাসনিক সদুত্তর মেলেনি । এমন কী, অবস্থানকারীদের সাহায্যার্থে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি সরকার । এরমধ্যে গতকাল পালিত হয় 21 জুলাইয়ের অনুষ্ঠান । তৃণমূল কর্মীদের জন্য সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্ক মেলা মাঠে 44টি তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল । আর প্রাথমিক শিক্ষকরা ? তাঁদের মাথায় ত্রিপলের ছাউনি ।
আরও খবর : শহিদ দিবসের অনুষ্ঠানের ফাঁকেই মদ্যপান!
এতদিন শিক্ষকদের আন্দোলন ছিল মৌন । কিন্তু, মমতার বক্তব্য আগুনে ঘি ঢেলেছে । ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা গান বেঁধেছেন...
"ন্যায্য দাবির জন্য যখন লাঠির বাড়ি হয়
বছর বছর সেই দিনটাতে শহিদ দিবস হয় ।
আমরা যখন অনশনে, ন্যায্য দাবি মনে মনে,
শুধু তোমার কানে কেন তুলো গোঁজা রয় ?
ও শিক্ষামন্ত্রী কীসের এত ভয় ?
ও মুখ্যমন্ত্রী কীসের এত ভয় ?"
অনশনকারী শিক্ষকদের প্রশ্ন, "সরকার যখন কোনও পোস্ট ঘোষণা করে তখন বেতনক্রম কি রাজকোষ দেখে নির্ধারিত হয়, নাকি যোগ্যতা দেখে হয় ? যোগ্যতামানটা দেওয়া হয় কেন ? আমরা তো বাড়তি বেতন দাবি করছি না । যদি কাল সরকারের কাছে টাকা না থাকে, তাহলে বলতে পারে 15 দিনের টাকা দেব না । সেটাও কি মেনে নেব ? তখনও কি শুনতে হবে শুধু শুধু রাস্তায় বসে অনশন করছে ? একটা তো যুক্তি আছে । আমরা ন্যায্য দাবি তুলেছি । আজ আপনি কেন্দ্রকে বলছেন । কেন্দ্র থেকে যখন বলা হয়েছিল, NCTE (The National Council for Teacher Education ) রুল অনুসারে যোগ্যতামান বিচার করতে হবে তখনই আপনার ভাবা উচিত ছিল, টাকা কোথা থেকে দেব ? আপনারা তখন কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করেননি কেন ? আজ কেন্দ্র বলছে, আমার কিছু করার নেই । রাজ্য বলছে, কেন্দ্রের কাছে চলে যান । কেন্দ্র-রাজ্যের খেলার মাঝে তো আমরা পড়ে গেছি । আমাদের কি দোষ ?"
রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি, শিক্ষকদের হুঁশিয়ারি দিতে গিয়ে কার্যত দলকেই বিপদে ফেললেন মমতা । বিরোধী নেতারা বলছেন, "ক্লাবে ক্লাবে দানছত্র খোলা হচ্ছে । মেলা-খেলার নামে কোটি কোটি টাকা অনুদান যাচ্ছে । আর শিক্ষকদের বেলায় কি না ভাঁড়ে মা ভবানী ? এ তো আজব ব্যাপার ।"
আরও খবর : মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখব, অনশনকারী শিক্ষকদের পাশে দাঁড়িয়ে জানালেন মুকুল
শিক্ষকরাই সুর-ছন্দ মিলিয়ে বলছেন, কতটা প্রয়োজনে তাঁরা অনশনে বসেছেন । কতটা প্রয়োজনে একজন মা তাঁর দুধের শিশুকে ছেড়ে এসে প্রতিবাদে নেমেছেন । তাঁর চান, মুখ্যমন্ত্রীর কানে পৌঁছাক তাঁদের স্বর । গানের মাধ্যমে..."কোলের শিশু দুধ পায় না, মাকে ছাড়া ঘুম আসে না । আসবে কবে ফিরবে চুমু দেবে আদরে, কবে হবে প্রতীক্ষার অবসান ! কতটা তীব্র হলে আবেদন, কতটা সত্যি হলে প্রয়োজন, রাস্তাতে ঘর করে পরিবার দূরে ফেলে অনশনে বসে পড়ে আমরণ ।"