কলকাতা, 21 জুন : হাতের ছাপ দিয়ে যায় চেনা । দশকের পর দশক ধরে কেবল অপরাধীদের হাতের ছাপ পরীক্ষা করে অপরাধের কিনারা করে চলেছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো । তবে ইতিহাসের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোর একাধিক হাতবদল হয়েছে । অপরাধীদের অপরাধের ধরনকে সামনে রেখে পাল্লা দিয়ে যুগের সঙ্গে উপযোগী হয়ে উঠেছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো । কালের বিবর্তন এবং অপরাধের ধরনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কীভাবে যুগোপযোগী এবং আপডেটেড হয়ে উঠেছে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো ? তার স্পষ্ট একটি ধারণা দিলেন রাজ্যের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোর প্রাক্তন ডাইরেক্টর (সিআইডি), দেবাশিস ঘোষ ।
দেবাশিস ঘোষ বলেন, ‘‘শুরুর দিকে হাতে কালি লাগিয়ে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ফটোকপি বার করে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হত । আর এটি ছিল অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ । ফলে অপরাধের কিনারা করতে হিমশিম খেতে হত গোয়েন্দাদের । কিন্তু যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরাধের প্রবণতা । ক্রমেই অপরাধের ধরন হয়ে উঠেছে ডিজিটাল ৷ ফলে অপরাধীদের শনাক্ত করতে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো নতুন রূপে সেজে উঠেছে । এসেছে একাধিক শক্তিশালী মেশিন । এসেছে একাধিক নতুন পদ্ধতি । তাছাড়াও এসেছে একাধিক বিজ্ঞানভিত্তিক দ্রব্য । তার ফলে এখন সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে এই ব্যুরো ৷’’
তিনি জানিয়েছেন, আগে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ‘এফিস’ নামে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে অপরাধ এবং অপরাধীদের শনাক্ত করা যেত । কিন্তু বর্তমানে তা আপডেট হয়ে সেই পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে এসেছে ‘ন্যাশনাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম’ বা ‘নাসিফ’ । এই পদ্ধতিটি সরাসরি ডিজিটাল রূপে কাজ করে । এই সফটওয়্যারের মেন সার্ভারটি রয়েছে এনসিআরবি অর্থাৎ, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র হাতে, যা দিল্লিতে অবস্থিত । মূলত দেশের প্রত্যেকে রাজ্যের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোকে তারা এই ‘ন্যাশনাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম’ নামক সফটওয়্যার এর মাধ্যমে কাজ করায় ৷
সিআইডি’র প্রাক্তন এই আধিকারিক জানিয়েছেন, ফিঙ্গারপ্রিন্ট যাচাইয়ের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করার আরও একটি বিশেষ ফর্মুলা রয়েছে ৷ যেটা হল 121 থেকে 32/32 ডিজিটের ফর্মুলা । এই ফর্মুলায় ফেলে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে আসল অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয় । তবে, আদালতের অনুমতিতে অভিযুক্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্টের বা আঙ্গুলের ছাপ পাঠানো হয় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোতে ৷ তার পরেই 121 থেকে 32/32 ডিজিটের ফর্মুলায় শুরু হয় অপরাধী চিহ্নিত করার কাজ।
দেবাশিস বাবু জানান, তদন্তে যদি ভিনরাজ্যের কোনও অপরাধীকে খুঁজতে হয় ৷ সেক্ষেত্রে এনসিআরবি (NCRB) বা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র থেকে একটি অনুমতি নিতে হয় । সেই অনুমতি দেওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে এনসিআরবি থেকে একটি বিশেষ পাসওয়ার্ড সংশ্লিষ্ট ব্যুরোতে পাঠানো হয় । আর সেই পাসওয়ার্ড দিয়ে সিস্টেম খুলতে হয় । সিস্টেম খুলে গেলে সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর যাবতীয় অপরাধের রেকর্ড ও আঙুলের ছাপ সহ একাধিক তথ্য কয়েক সেকেন্ডের মাধ্যমে ন্যাশনাল অটোমেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্ট আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম থেকে পাওয়া যায় । ফলে কাজটা অনেক সুবিধা হয় ৷ আর এই ফর্মুলাকে বলা হয় হেনরি ক্লাসিফিকেশন ।
কিন্তু, কেন এই সিস্টেমের নাম হেনরি ক্লাসিফিকেশন ? তা জানতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায় । ফিরে যেতে হবে 18 শতকের গোড়ায় । সেই সময় ভারতে ছিল ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা । ইতিহাস বলছে যে, ভারতের প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো তৈরি হয়েছিল এই বাংলাতেই । যা প্রথম সাফল্য পেয়েছিল জলপাইগুড়ি জেলায় ঘটে যাওয়া একটি অপরাধের কিনারা করতে গিয়ে । সালটা 1897, জলপাইগুড়ি জেলার কাঠালগুড়ি এলাকার একটি চা বাগানের এক কর্মীর মৃতদেহ উদ্ধার হয় । সেই ঘটনায় আততায়ীদের আঙুলের ছাপ নিয়ে গোটা ঘটনার যবনিকা পতন করেছিলেন তৎকালীন পুলিশ অফিসার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি । যদিও তাঁর সঙ্গে দুই বঙ্গসন্তান পুলিশ অফিসারও সাফল্যের সঙ্গে তদন্ত করেছিলেন । তাঁদের নাম হেমচন্দ্র ঘোষ এবং আজিজুল হক । যদিও ঐতিহাসিকদের অভিযোগ, যেহেতু সেই সময় ব্রিটিশ শাসনে কবলিত ছিল গোটা দেশ । ফলে দুই বাঙালি অফিসারের সাফল্য ঢাকতেই বেশি করে ফোকাস করা হয়েছিল এঢওয়ার্ড রিচার্ড হেনরির নাম । তার পর থেকেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো’র এই বিশেষ ফরমুলাকে বলা হয় হেনরি ক্লাসিফিকেশন ।
জানা গিয়েছে, 1897 সালে জলপাইগুড়ি জেলার কাঁঠালগুড়ি টি-এস্টেট এর ব্যবস্থাপককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল । স্যার রিচার্ড হেনরি এবং দুই বঙ্গসন্তান হেমচন্দ্র ঘোষ এবং আজিজুল হক ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন ওই টি-এস্টেট এর ব্যবস্থাপকের দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং তার গলা চেরা অবস্থায় ছিল । সেই সময়ই দেহের মধ্যে থাকা আঙুলের ছাপ বিশদভাবে পরীক্ষা করে প্রথম এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট টি-এস্টেট এর বাংলোর প্রাক্তন কর্মী রঞ্জন সিং ওরফে কাঙ্গালিকে শনাক্ত করেছিলেন ওই তিন গোয়েন্দা ৷ বলা হয় সেটিই ছিল প্রথম ভারতবর্ষে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোর মাধ্যমে অপরাধীকে শনাক্তকরণের কাজ । তবে, সেই সময় ব্রিটিশ আইনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্বীকৃত ছিল না । কিন্তু পরে তা মেনে নেয় তৎকালীন ভারত সরকার । আর সেটি হয়েছিল এই বাংলায় 1897 সালে ।
জানা গিয়েছে, সময়ের বিবর্তনের মাধ্যমে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো চলে যায় স্টেট ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর অধীনে । বেশ কয়েক বছর পর সিআইডি’র অধীনে চলে আসে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরো । তবে দীর্ঘদিন ধরে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোতে কর্মীর অভাব রয়েছে । এর ফলে বিভিন্ন মামলা ঝুলে রয়েছে । যেমন 1971 সাল পর্যন্ত পুলিশ কর্মীরাই আঙুলের ছাপ নেওয়ার দায়িত্ব সামলাতেন । তাঁদেরকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হত । বর্তমানে তার বদলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সেই কাজ করানো হয় ।
মূলত ফিঙ্গারপ্রিন্ট ব্যুরোর মধ্যে থাকেন একজন ডিরেক্টর, 12 জন সিনিয়র এক্সপার্ট এবং 28 জন জুনিয়র এক্সপার্ট । তবে, বর্তমানে সেই সংখ্যা অনেকটাই কম বলে জানান প্রাক্তন ডিরেক্টর ফিঙ্গারপ্রিন্ট (সিআইডি) দেবাশিস ঘোষ । এই বিষয়ে ডিআইজি (সিআইডি-অপারেশন) মিরাজ খালেদ বলেন, ‘‘এই বিভাগ সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে । এলাকার একাধিক অপরাধী ও আসামীদের হাতের ছাপ আমাদের কাছে থাকে । এলাকায় কোনও অপরাধ হলে সেই হাতের ছাপের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে সংগ্রহ করা হাতের ছাপ পরীক্ষা করে দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করা হয় ৷’’