কলকাতা, 18 জুন : কোরোনা মহামারী ও তার মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরে চলা লকডাউনের প্রভাব সর্বত্রই পড়েছে। ব্যতিক্রম নয় শিক্ষা ব্যবস্থাও। কিন্তু, কোরোনা আবহে থমকে থাকেনি সর্বভারতীয় স্তরের প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি। JEE, NEET-এর প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য পড়ুয়াদের প্রস্তুত করতে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কোর্স করায় এমন নামী দুটি প্রতিষ্ঠান জানাচ্ছে, মহামারী বা লকডাউনের কারণে পড়ুয়া সংখ্যা কমেনি । উলটে গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি পড়ুয়া কোর্সে ভরতি হচ্ছে । লকডাউন শুরুর পরেই প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতির দীর্ঘমেয়াদি কোর্স অফলাইন থেকে সরিয়ে এনে অনলাইনে করানো হচ্ছে । তবে, কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে স্বল্পমেয়াদি ক্র্যাশ কোর্স এবছর চালু করা সম্ভব হয়নি । আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে JEE মেইন পরীক্ষার ঘোষিত দিনকে সামনে রেখে আর কিছুদিনের মধ্যেই ক্র্যাশ কোর্স চালু করা হবে।
চলতি বছরে 5 এপ্রিল সর্বভারতীয় জয়েন্ট প্রবেশিকা পরীক্ষা JEE মেইনের দিন ঘোষণা করে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি। কিন্তু, COVID-19 মহামারীর কারণে তা পিছিয়ে দেওয়া হয় । 22 মে সেই পরীক্ষার নতুন নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে NTA । সেই অনুযায়ী আগামী 18-23 জুলাই পর্যন্ত হবে JEE মেইন পরীক্ষা । একইভাবে 2020 সালের JEE অ্যাডভান্সড পরীক্ষা, যা 17 মে হওয়ার কথা ছিল তাও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গত 8 মে-তে পরীক্ষার নতুন দিন ঘোষণা করা হয়েছে । সেই অনুযায়ী, আগামী 23 অগাস্ট JEE অ্যাডভান্সড 2020-র পরীক্ষা হবে । ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার মতো ভারতের বিভিন্ন কলেজ, প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল কোর্সের জন্য ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট (NEET) 2020-ও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। NTA ঘোষণা করেছে, NEET (UG)-2020-র পরীক্ষা 3 মে-র বদলে 26 জুলাই হবে ।
সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলির প্রস্তুতির জন্য যেসব কোর্স করায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, তা যেমন দীর্ঘমেয়াদি হয় তেমনি স্বল্পমেয়াদিও হয় । মূলত, সপ্তম শ্রেণি থেকে কোচিং ক্লাসের জন্য এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য পড়ুয়ারা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আসে । ধাপে ধাপে কেউ অষ্টম শ্রেণিতে, কেউ নবম শ্রেণিতে, কেউ দশম শ্রেণিতে, আবার কেউ বোর্ড পরীক্ষার প্রস্তুতির সঙ্গে, কেউ বা বোর্ড পরীক্ষা দেওয়ার পরে ভরতি হন প্রতিষ্ঠানগুলিতে। কোরোনা মহামারী ও তার জেরে চলা লকডাউনে পরীক্ষাগুলি পিছিয়ে গেলেও থমকে ছিল না প্রস্তুতি । তবে, স্বাভাবিকভাবেই কোর্সগুলির উপর লকডাউনের প্রভাব পড়েছে । প্রতিষ্ঠানগুলি জানাচ্ছে, এই কোর্সগুলির জন্য লকডাউনের কারণে অফলাইন ব্যবস্থা থেকে তাদেরকে অনলাইনে কোর্সে চলে আসতে হয়েছে । প্রথম প্রথম তাতে সমস্যা হচ্ছিল । কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন ব্যবস্থায় শিক্ষকরা ও পড়ুয়ারা নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন ।
শহরের এক নামী প্রতিষ্ঠানের আধিকারিক দেবদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের ক্ষেত্রে যে অফলাইন ক্লাস তা আমরা সম্পূর্ণ আলাদা একটা প্ল্যাটফর্মে শিফ্ট করে দিয়েছি। অনলাইন ক্লাস চালু করেছি । দীর্ঘমেয়াদি কোর্সগুলোর ক্ষেত্রে সেভাবে কোনও সমস্যা হচ্ছে না । তবে, ফিজ়িক্যাল ক্লাসরুমকে কোনওদিনও ভার্চুয়াল ক্লাসরুম রিপ্লেস করতে পারে না । ফিজ়িক্যাল ক্লাসরুমের চাপটা ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে পাওয়া যাবে না । ফিজ়িক্যাল ক্লাসে আমরা দেখি একটা বাচ্চা কত কম সময়ে একটা প্রবলেম সলভ করতে পারছে । অনলাইন ক্লাসে বাচ্চা একটা প্রবলেম সলভ করলেও সেটা কতক্ষণে করেছে আমরা বুঝতে পারছি না । তাই আমরা দুই ঘণ্টার ক্লাসের সময়সীমা বাড়িয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা বা চার ঘণ্টা করে দিচ্ছি । স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের উপর চাপ বেড়েছে । কিন্তু, ফিজ়িক্যালের মতোই ভার্চুয়াল ক্লাসে পড়ুয়াদের প্রস্তুত করতে গেলে এই চাপটা পড়ুয়া-শিক্ষক উভয়কেই নিতে হবে ।"
তবে, মহামারী ও লকডাউনে এবার ক্র্যাশ কোর্স চালু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি ।
দেবদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "আমরা শর্ট কোর্স চালু করি নভেম্বর মাসে । সেই শর্ট কোর্সগুলোকে বলা হয় ইন্টেন্সিভ কন্ট্যাক্ট প্রোগ্রাম । এই প্রোগ্রাম করানো হয় যারা এই বছর বোর্ড পরীক্ষা দিচ্ছে এবং তার সঙ্গে JEE মেইনের জন্য প্রস্তুতি নিতে চাইছে তাদের জন্য । এই ক্র্যাশ কোর্সগুলো নভেম্বরে শুরু হয়ে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলে । জানুয়ারিতে যে JEE মেইন পরীক্ষা হয় তার আগে আমরা এই কোর্সগুলো শেষ করি । তারপরে আবার রিক্যাপ কোর্স চালু করা হয় মার্চে বোর্ড পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর । যা পরবর্তী JEE মেইন সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত চলে । JEE মেইনের ফল প্রকাশের পর ও অ্যাডভান্সড পরীক্ষার মধ্যে একটা গ্যাপ থাকে । তখনও আমরা এই শর্ট কোর্স চালিয়ে যাই । বহুসংখ্যক পড়ুয়া যারা এই শর্ট কোর্সগুলোতেই অংশগ্রহণ করত তারা এখন তা করতে পারছে না । এই বছর ICP-র মতো প্রোগ্রাম আমরা করতে পারিনি শুধুমাত্র এই মহামারীর কারণে ।"
আর একটি নামী প্রতিষ্ঠানের আধিকারিক নিবেদিতা দাস বলেন, "মার্চ মাসের শেষে লকডাউন যখন হল তখন আমাদের অ্যাডমিশনের একটা ফ্লো চলে । আমরা ভেবেছিলাম, এই জায়গাটায় এই বছর অসুবিধা হতে পারে । কিন্তু, দেখলাম যে, পড়ুয়ারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে । আমরা ওয়ার্ক ফ্রম হোমে আছি । ফিজ়িক্যাল ক্লাস নিতে পারছি না। কিন্তু, অনলাইন ক্লাসগুলো নিচ্ছি । এবং ফিজ়িক্যাল ক্লাসে পড়ুয়ারা যে সুবিধাগুলো পেত অনলাইন ক্লাসে সেগুলো তো রাখছিই, পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু রাখছি । অ্যাডমিশন ভালোভাবেই চলছে। অসুবিধা হচ্ছে না।"
এই প্রতিষ্ঠানে সাধারণত স্বল্পমেয়াদি ক্র্যাশ কোর্স করানো হয় পরীক্ষার দিনের এক দেড় মাস আগে থেকে । JEE মেইন ও NEET 2020-র পরিবর্তিত দিনকে মাথায় রেখে আগামী 20 জুন থেকে সেই কোর্স চালু করতে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি । তবে, তা অনলাইনেই । COVID-19 পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে পড়ুয়া সংখ্যায় কোনও প্রভাব পড়ছে না বলে দাবি করছে প্রতিষ্ঠানগুলি।
দেবদীপবাবু বলেন, "প্রতিবছর হাজার হাজার পড়ুয়া আমাদের কাছে আসে, ভরতি হয় । তবে, আমরা সবাইকে ভরতি নিই না । অনলাইন এন্ট্রান্স টেস্টের মাধ্যমে ভরতি নিই । মহামারীর এই সময়ে আমরা একটা অদ্ভুত জিনিস দেখছি । ভেবেছিলাম, পড়ুয়ার সংখ্যা হয়ত কমে যাবে । কিন্তু, তার উলটো হয়েছে। গত বছর যে সময়ে যত সংখ্যক পড়ুয়া ভরতি হয়েছিল, এই বছর সেই সময়ে তার থেকে বেশি পড়ুয়া ভরতি হয়েছে । 45 শতাংশ বেড়েছে ভরতি ।"
নিবেদিতা দাসও বলেন, "এবার স্টুডেন্ট সংখ্যা বেড়েছে।"
শহরের নামী এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কেমিস্ট্রির শিক্ষক কিশোর পাত্রর কথায়, "অনলাইন ক্লাসে স্টুডেন্ট-টিচার বন্ডিংয়ের জায়গাটা একদম নেই । প্রথম প্রথম পড়ুয়ারাও বিভ্রান্ত হচ্ছিল । পরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে ।"
পাঁচ বছর ধরে একটি প্রতিষ্ঠানে প্রস্তুতির কোর্স করা পড়ুয়া পৃথুর কথায়, "প্রথমে চেঞ্জটা খুব অ্যাবরাপ্ট ছিল। তবে, তেমন কোনও অসুবিধা হয়নি । কারণ, ততদিনে আমাদের রিভিশন ক্লাস শুরু হয়ে গেছিল । মক টেস্টগুলো অনলাইনেই হয়। এখন মক টেস্টগুলো নিয়মিত দিচ্ছি । পরীক্ষা তো একটা না একটা সময়ে হবেই । প্রস্তুতির জন্য আরও কিছুটা সময় পাওয়া গেল। শেষ পর্যন্ত সেটা একটা ভালো জিনিস।"
আরেক পড়ুয়া সাহিল আখতার বলেন, "প্রস্তুতি তো চলছেই৷ এটা আমাদের কাছে আরও অ্যাডভান্টেজ যে আমরা আরও বেশি সময় পাচ্ছি প্রস্তুতির জন্য । এছাড়া, এখন অনলাইনে হওয়ার জন্য ট্রাভেলিং টাইম অনেকটা বেঁচে যাচ্ছে । ঘরে বসেই আমরা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছি।"