কলকাতা, ১4 অক্টোবর: বেসরকারি স্কুলগুলিকে 2019-2020 শিক্ষাবর্ষে অন্তত 20 শতাংশ টিউশন ফি ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। পাশাপাশি, কোনও রকম ল্যাবরেটরি ফি, স্পোর্টস ফি, পিকনিক ফি চলতি বছরে নেওয়া যাবে না বলে মঙ্গলবার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও মৌসুমি ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। বেসরকারি স্কুলের ফি ইশুতে হাইকোর্টের আজকের নির্দেশে স্বাভাবিকভাবেই খুশি বেসরকারি স্কুলের অভিভাবকরা। অন্যদিকে, হাইকোর্টের নির্দেশ সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করছে একাধিক বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাঁরা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন বলেই জানাচ্ছেন।
গোটা রাজ্যের প্রায় 140টির বেশি বেসরকারি স্কুলের বিরুদ্ধে গত 7 জুলাই কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়। অভিভাবকদের দাবি ছিল, কোরোনার জেরে চলা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ থাকলেও স্বাভাবিক ফি দাবি করা হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে। তাঁদের বক্তব্য, কিছু ফি মকুব করুক স্কুলগুলি। তারপর থেকে একাধিকবার এই মামলার শুনানি হয়। শেষ পর্যন্ত 18 অগাস্ট কলকাতা হাইকোর্ট ফি-র বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়। যদিও সেই কমিটিও ফি সংক্রান্ত সমস্যা মেটাতে পারেনি। এরপর মঙ্গলবার টিউশন ফি-তে 20 শতাংশ ছাড়ের নির্দেশ দিল হাইকোর্ট ৷ আরও বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্কুলগুলি সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশের বেশি লাভ রাখতে পারবে না। একইসঙ্গে ডিভিশন বেঞ্চ নতুন তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছে। যে সকল ছাত্র-ছাত্রী ফি দিতে পারবে না তাঁদের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে এই কমিটি।
হাইকোর্টে ফি নিয়ে এই মামলা দায়ের হওয়ারা আগে থেকেই চলতি বছর কোরোনা আবহে ফি মকুবের দাবি জানিয়ে আসছিলেন বিভিন্ন বেসরকারি স্কুলের অভিভাবকরা। আলাদা আলাদাভাবে এক একটি স্কুলের অভিভাবকদের বিক্ষোভের পাশাপাশি সংঘবদ্ধভাবে ইউনাইটেড গার্জিয়ানস অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারেও জুন মাস থেকেই আন্দোলন করছেন অভিভাবকরা। তাঁদের দাবি ছিল, টিউশন ফি ছাড়া অন্যান্য সব যে সব পরিষেবা এখন পড়ুয়াদের দেওয়া হচ্ছে না সেই সব খাতের ফি মকুব করা হোক। যে সব স্কুলে টিউশন ফি হেডেই সমস্ত ফি নেওয়া হয় সেক্ষেত্রে 50 শতাংশ টিউশন ফি মকুব করা হোক। সম্পূর্ণ দাবি না মিটলেও আজ হাইকোর্টের নির্দেশে সন্তুষ্ট বেসরকারি স্কুলের অভিভাবকরা।
মঙ্গলবার হাইকোর্টের নির্দেশের পর ইউনাইটেড গার্জিয়ানস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, "এখনও কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ আমাদের হাতে আসেনি। সংবাদমাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তার ভিত্তিতে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা জানাতে চাই যে, যদি কলকাতা হাইকোর্ট এই রায় দিয়ে থাকেন যে, নন-অ্যাকাডেমিক কোনও ফি নেওয়া যাবে না এবং 2019-20 শিক্ষাবর্ষের ফি-র উপর 20 শতাংশ ছাড় দিতে হবে তাহলে ইউনাইটেড গার্জিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন মনে করে যে, কোরোনা পরিস্থিতিতে, কোরোনা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি এবং আন-এডেড স্কুলের অভিভাবকরা যে দাবিতে লড়াই করেছিল, আজকে কোর্টের রায় তাঁদের সেই দাবির মান্যতা দিল। এই সফলতা সমস্ত পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলের অভিভাবকদের আন্দোলনের সফলতা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে আজকে কোর্টের কাছেও আমরা আমাদের এই সমস্যাকে তুলে ধরতে পারতাম না।" তবে, পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি এবং আন-এডেড স্কুলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অন্য রাজ্যের মতো এই রাজ্যেও একটি আইন প্রণয়ন এবং একটি রেগুলেটরি বোর্ড গঠনের দাবিও এদিন রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্যে রেখেছে এই সমিতি। শুধু ইউনাইটেড গার্জিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন নয়, ফি মকুবের দাবি জানিয়ে আসা সব অভিভাবকরাই কম-বেশি খুশি আজকের নির্দেশে। তবে, স্কুলগুলি এই নির্দেশ কার্যকর করতে টালবাহানা করতে পারে এই আশঙ্কাও রয়েছে তাঁদের মধ্যে।
অভিভাবকদের আশঙ্কা সত্যিতে পরিণত হওয়ারও যে সম্ভাবনা রয়েছে তা আজ অধিকাংশ বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া থেকে স্পষ্ট। এদিন হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ICSE স্কুলগুলির সর্বভারতীয় সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক তথা সেন্ট্রাল মর্ডান স্কুলের প্রিন্সিপাল নবারুণ দে বলেন, "20 এপ্রিল রাজ্য সরকারের প্রধান সচিব আমাদের কাছে একটা আবেদন করেছিলেন ফি রোল ব্যাক করার জন্য। কারণ প্রত্যেক বছরই অ্যাকাডেমিক সেশনে, কোনও কোনও স্কুলে দুই বছর অন্তর একটা ফি বৃদ্ধি করা হয়। সেটা গড়ে 8-10 শতাংশ বৃদ্ধি হয়। আমাদের রাজ্য সরকার বলেছিল, কোরোনা পরিস্থিতিতে ফি বৃদ্ধি না করতে। সেটা আমরা বেশিরভাগ স্কুলই করেছিলাম। নিশ্চয়ই সব স্কুল করেছিল। আমাদের মে মাসে কমপ্ল্যায়েন্স রিপোর্টও পাঠাতে হয়েছিল। সেখানেই 8-10 শতাংশ ফি কিন্তু কমে গেল। তারপরে যদি আবার 20 শতাংশ ফি কমাতে হয় আমার মনে হয় না কোনও বেসরকারি আন-এডেড স্কুল তাঁরা চালাতে পারবে। কারণ, কোনও স্কুলই 30 শতাংশ মার্জিনে চলে বলে আমার মনে হয় না। কাজেই কী হবে, আমাদের বন্ধ করে বসে থাকতে হবে আমাদের। কারণ, এখন যে অনলাইনে ক্লাস হতো তাতে টিচারদের উপর ডবল চাপ পড়ে যাচ্ছে নর্ম্যাল ক্লাসের থেকে। নন-টিচিং স্টাফেদেরও অনলাইন ক্লাস অ্যাডজাস্ট করা, বোর্ড অ্যাডজাস্ট করা, পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, এসবে নর্মাল কাজের চাপের থেকে দ্বিগুণ চাপ পড়ে যাবে। এখানে তাদের স্যালারি কাট করার কোনও জায়গা নেই। মানবিকভাবে করা যাবে না। অনলাইন ক্লাস করানোর জন্য বিরাট একটা খরচা লাগে।" আগামীদিনে স্কুলের তরফে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হতে পারেন বলে জানাচ্ছেন নবারুণ দে। তিনি বলেন, "আমার স্কুলের জন্য যদি অ্যাডভোকেট পরামর্শ দেয় তাহলে আমার শতকরা 100 ভাগ ইচ্ছে সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গল রিট পিটিশন ফাইল করব। শুধু আমার নয়, অনেক স্কুলেরই ইচ্ছে আছে, অন্তত আমি সবার সঙ্গে কথা বলে তাই বুঝলাম।"
সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য কৃষ্ণ দামানি বলেন, "এই নির্দেশটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না। সাউথ পয়েন্টে 98 শতাংশের বেশি অভিভাবক এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বাকি থাকা ফি মিটিয়ে দিয়েছেন। আমাদের কাছে ফি মকুবের আবেদন জানানো অভিভাবকের সংখ্যা 15-র বেশি নয়, প্রায় 12 হাজার অভিভাবকের মধ্যে। প্যানডেমিকের কারণে বহু বাঁধা সত্ত্বেও আমাদের টিচাররা গত 6 মাস ধরে অনবরত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন আমাদের সব পড়ুয়াদের কোয়ালিটি শিক্ষা দেওয়ার জন্য। আমরা আমাদের কাছে কী আইনি সমাধান রয়েছে তা দেখব।"