কার্যত লকডাউন ৷ রাজ্যের করোনা বিধিনিষেধকে এ ভাবেই দেখছিলাম আমরা ৷ ভাইরাসকে ঠেকাতে দোকানপাট, বাজারহাট, বাস-ট্রেন সব বন্ধ ছিল ৷ সাধু উদ্যোগ ৷ সচেতন নাগরিক হিসেবে যতটা সম্ভব নিয়ম-কানুন মেনে চলেছি ৷ বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি ৷ অফিস গাড়ির ব্যবস্থা করেছে ৷ সেটুকু ছাড়া নিজেকে প্রায় ঘরবন্দি রেখেছি ৷ পরিবারকেও ৷ সরকার ও মানুষের প্রচেষ্টায় সংক্রমণ কমেছে ৷ ধীরে ধীরে অনেকটাই উঠেছে বিধিনিষেধ ৷ 1 জুলাই থেকে চালু হয়েছে বাস-অটো ৷ স্বাভাবিকভাবেই এ বার গণ পরিবহণ মাধ্যমেই অফিস যাওয়ার পালা ৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, 1 তারিখ থেকে রাস্তায় সরকারি, বেসরকারি বাস, অটো, টোটো সবই মিলবে ৷ তবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের ভ্রুকুটি থাকায় সুরক্ষার খাতিরে বাসে 50 শতাংশের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেন তিনি ৷ আম জনতা হিসেবে আশ্বস্ত হয়েছিলাম ৷
এতদিনে এটুকু বুঝে গিয়েছি, আপাতত কোভিডকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের চলতে হবে ৷ জীবন থেমে থাকে না ৷ লকডাউনও এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা নয় ৷ তাই টিকা নিয়ে, মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই কর্মযুদ্ধে ঝাঁপ দিতে হয়েছে ৷ কোভিডের সঙ্গে ফের মুখোমুখি লড়াইয়ে নেমে সরকারকে পাশে পেয়ে কিছুটা ভরসা পেয়েছিলাম ৷ তবে গতকালই রাস্তায় নেমে সেই আশা জলে ধুয়ে গিয়েছে ৷ নেই কোনও বেসরকারি বাস ৷ সরকারি বাস যে কটা চলছে, তার সবেতেই চিঁড়ে চ্যাপ্টা ভিড় ৷ কোথায় করোনা ! কোথায় সামাজিক দূরত্ব ! ফেরার সময়ও একই পরিস্থিতি ৷ ভেবেছিলাম নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর প্রথম দিন, তাই হয়রানিটা বেশি হল ৷ ধীরে ধীরে হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে ৷ না ৷ ভুল ভেবেছিলাম ৷ আজ দ্বিতীয় দিনেও একই ছবি ৷ রাস্তায় নেমে দুরবীন দিয়ে বাস খুঁজতে হয়েছে ৷
আরও পড়ুন: হাতেগোনা বাস হাওড়া বাস-টার্মিনালে, চূড়ান্ত ভোগান্তি অফিস যাত্রীদের
আমার অফিস ল্যান্সডাউনের কাছে ৷ ইএম বাইপাসে সিংহবাড়ি স্টপে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোনও বাস পাইনি ৷ অবশেষে একটা রুবির অটো পেয়ে উঠে পড়লাম ৷ চালক জানালেন, ভাড়া কিন্তু 11 টাকা নয়, 15 টাকা দিতে হবে ৷ মেনে নিয়েছি ৷ উপায় নেই যে ৷ রুবির মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়ালাম প্রায় 45 মিনিট ৷ একটু একটু করে বাস স্ট্যান্ডে লোক বাড়তে থাকল ৷ এ দিকে, অফিসে ঢোকার টাইম এগিয়ে আসছে ৷ একটা ট্যাক্সি সামনে এসে দাঁড়াল ৷ দেখলাম তাতে পেছনে 3 জন আর সামনে একজন বসে ৷ হিসেব মতো কোনও জায়গা নেই ৷ তবু কোনওক্রমে সেখানে আরও একজন যাত্রী যাতে তুলে নেওয়া যায়, সে জন্য চালক হাঁক দিচ্ছেন, রাসবিহারী...রাসবিহারী ৷ অফিসে লেট মার্ক পড়ে যাবে ভেবে ছুটে গেলাম ৷ ভাবলাম একটু বেশি টাকা দিয়েই না-হয় আজ চলে যাই ৷ ভাড়া কত জিজ্ঞেস করতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ ৷ চালক বলল 150 টাকা লাগবে ৷ রুবির মোড় থেকে দেশপ্রিয় পার্ক যাব, 150 টাকা ৷ বাসের ভাড়া 9 টাকা ৷ ট্যাক্সিতে উঠিনি ৷ সবে মাসের 2 তারিখ ৷ এখনও বেতন হয়নি ৷ আবারও অপেক্ষা ৷
আরও পড়ুন : রাস্তায় অমিল বেসরকারি বাস, অটো ভাড়া আকাশছোঁয়া ; চরম দুর্ভোগে আমজনতা
মিনিট দশেক পরে একটা সরকারি বাস এল ৷ দেখলাম, দূর থেকে বাসটাকে দেখেই সবাই পিঠের ব্যাগ সামনে নিয়ে, জামার হাতা গুটিয়ে তৈরি হয়ে নিচ্ছে ৷ যেন বাঁশি বাজলেই দৌড় প্রতিযোগিতায় ছুট দিতে হবে ৷ হলও অনেকটা সে রকমই ৷ বাস এসে দাঁড়াতে পারেনি, হুড়মুড়িয়ে ঠেলেঠুলে সবাই উঠতে শুরু করল ৷ বয়ষ্ক একজনের এক গুঁতোয় আমার চশমাটা খুলে গেল ৷ কোনওক্রমে ধরে নিয়েছি ৷ রাগ হয়েছিল প্রথমটায় ৷ তবে পরে বুঝতে পারি তাঁর উদ্বেগ ৷ কিছু বলিনি ৷ বাসে উঠে তো পড়লাম ৷ কিন্তু দাঁড়ানোরই জায়গা নেই ৷ হাতল ধরে এ পাশ ওপাশ করে শরীরটাকে ফিট করিয়ে নিলাম ৷ জাপ্টাজাপ্টি ভিড়ে করোনার বিধিনিষেধ উধাও ৷ 50 শতাংশ নয়, 100 শতাংশেরও বেশি যাত্রী তখন বাসে ৷ বাসচালকরাই বা কী করেন ! মানুষেরও কিছু করার নেই ৷ বিকল্প কোনও পথ নেই, তাই জীবনের ঝুঁকি ভুলিয়ে দিয়েছে পেটের টান ৷ করোনা হলে যদিও বা বেঁচে যাওয়ার চান্স রয়েছে, অফিসে না-পৌঁছতে পারলে তো চাকরিটা সংকটে পড়বে ৷ তাই অগত্যা ৷ দেশপ্রিয় পার্কে কোনওক্রমে নেমে সেখানেও প্রায় মিনিট 15 অপেক্ষা করার পর একটা অটো এল ৷ সেটা ধরতেও সেই দৌড় প্রতিযোগিতা ৷ সফল হয়েছি ৷ অন্যদের পেছনে ফেলে ছুটে গিয়ে অটোয় উঠেছি ৷
আরও পড়ুন : রাস্তায় নেই বেসরকারি বাস, সুযোগে খেয়াল-খুশির দর অটোয়
এ ভাবে অফিসে তো আজও পৌঁছলাম ৷ জানি না ফেরার সময় আবার কী অপেক্ষা করে আছে ৷ টিভি-পোর্টাল খুললেই দেখতে পাচ্ছি, শুধু আমি না, এমনই চরম হয়রানির শিকার আরও বহু শহরবাসী ৷ ধর্মতলা থেকে বালিগঞ্জ, শ্যামবাজার থেকে নাগেরবাজার, সর্বত্রই একই ছবি ৷ বেসরকারি বাস নেই, সরকারি বাসে বাদুড়ঝোলা ভিড়, আর অটোয় খেয়ালখুশি ভাড়া ৷ আমরা কোথায় যাব ? করোনার থেকেও তো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে আনলক ফেজের এই জীবনযাপন ৷ বাস মালিকরা বলছেন, ডিজেলের ভাড়া বেড়েছে, খরচ চালাতে পারছেন না ৷ তাই বাস নামছে না ৷ তাহলে এর সমাধান কী ৷ মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন...