কলকাতা, 29 মে : 63 পার্ক স্ট্রিটের স্কুলটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে না এই ভবনটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শহর কলকাতার এক টুকরো বিস্মৃত ইতিহাস । তৎকালীন কলকাতার গরিব ইহুদি পরিবারের সন্তানদের কম খরচে উন্নতমানের শিক্ষাদানের কথা ভেবে এই স্কুলটি তৈরি করা হয়েছিল ৷ সেখানে আজ আর কোনও ইহুদি পড়ুয়ার দেখা মেলে না ৷ তবে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই বিদ্যালয় (No Jews left in Jewish Girls School of Kolkata)।
1940 সালের মাঝামাঝি সময় যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়, তখন লক্ষ্য লক্ষ্য ইহুদিরা দেশচ্যুত হয় ৷ এরপর তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে । ওই সময় বহু ইহুদি পরিবার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বসবাস শুরু করে । বাগদাদ, আরব, ইসরাইল, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন-সহ আরও বেশ কিছু জায়গা থেকে ভারতে প্রবেশ করে ইহুদিরা । কেরল, সুরাট, তৎকালীন বোম্বাই, গুজরাতের মতো বহু ইহুদি পরিবার কলকাতায়ও এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে । তবে কলকাতায় বাগদাদি ইহুদির সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি ।
অন্যদিকে তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে কলকাতা হয়ে উঠেছে অনেকটাই আধুনিক ও কসমোপলিটন । তাই ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষগুলোও খুব সহজেই এখানে খাপ খাইয়ে নিতে পারে । 1881 সালে কলকাতার দুঃস্থ ইহুদি পরিবারের সন্তানদের কম খরচে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে শহরের সমৃদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত দশ জন ইহুদি একটি ট্রাস্ট গঠন করেন । এঁদের আর্থিক অনুদানে তৈরি হয় এই স্কুল । প্রথমে এজরা স্ট্রিটে এক কামরার একটি বাড়িতে আটজন ইহুদি শিশুকে নিয়ে শুরু হয় জিউইস গার্লস স্কুলের (Jewish Girls School) পথ চলা ।
এই স্কুলের উপাধ্যক্ষ আবেদা রেজাক বলেন, "তৎকালীন আভিজাত্যপূর্ণ ও ধনী ইহুদি পরিবারগুলি ছিল বেশ গোঁড়া । এই ধনী পরিবারের দৈনন্দিন কাজ করতো ওই সম্প্রদায়ের দরিদ্র ইহুদিরা । তাই মূলত এই দরিদ্র ইহুদিদের সন্তানদের কম খরচে পড়াশোনার জন্য তৈরি হয়েছিল স্কুলটি । প্রথমদিকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তো । বিনামূল্যে শিক্ষা দান করা হত ।"
প্রথমে এজরা স্ট্রিটের ছোট্ট একটি ঘরে কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হলেও, ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে থাকে ৷ এরপর স্কুলটি চলে যায় 7 নম্বর পোলক স্ট্রিট এবং তারপর 1950 সালের শেষের দিকে বর্তমান ঠিকানায় স্কুলটি চলে আসে । আবেদ রেজাক জানান, আগে এখানে ছাত্রীরা স্কুলের হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করতে পারতো । তবে পরে সেই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয় । পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে হাতের কাজও যেমন শেখানো হত, তেমনই এখানে হিব্রু ভাষাও পড়ানো হত । তবে এখন আর কোনও ইহুদি পড়ুয়া না থাকলেও, স্কুলটি এখনও ইহুদি ম্যানেজমেন্টের দ্বারা চালিত হয় । স্কুলে ইহুদি ছুটির ক্যালেন্ডার মেনে ছুটি দেওয়া হয় । একসময় যেই স্কুলটি শহরের ইহুদি পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, আজ সেই স্কুলে একটিও ইহুদি শিশু নেই । শুধুমাত্র স্কুলের নাম ও ইউনিফর্মে বুক পকেটের উপর হলোগ্রামটি (Star of David) ইহুদি সমাজের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে পার্ক স্ট্রিটের জিউইস গার্লস স্কুল ।
স্কুলের বর্তমান অধ্যক্ষ মনিকা ভিন্সেন্ট বলেন, "এখন আর এখানে হিব্রু ভাষা পড়ানো হয় না । ঠিক তেমনভাবেই স্কুলের নাম জিউইস গার্লস স্কুল হলেও, বর্তমানে আর একজনও ইহুদি ছাত্রী নেই । এমনকি শিক্ষক বা শিক্ষিকারাও কেউ ইহুদি সমাজের নন । এখন বেশিরভাগ পড়ুয়ারাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী । এখন আইসিএসসি ও সিবিএসসি পাঠ্যক্রম মেনেই চলে পড়াশোনা । বর্তমানে স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা প্রায় 1500 ।"
শহরের এক ইহুদি ইয়ল সিলিম্যান যাঁর মা ফ্লাওয়ার সিলিম্যান জিউইস গার্লস স্কুলেরই প্রাক্তনী তিনি বলেন, "সেই সময় স্কুলের ভোরের প্রার্থনা হতো হিব্রু ভাষায় । পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে স্কুলে পোড়ানো হত তনক (Tanakh Hebrew Bible) । স্কুলের প্রথম ইহুদি প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন রেজিনা গুহা । এরপর 1000, 940 থেকে 50 এর মধ্যে ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকল ৷ তারপর আস্তে আস্তে কলকাতা থেকে বহু ইহুদি পরিবার ইজরায়েল, আমেরিকা, ব্রিটেন, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিতে শুরু করল । শহরের মতো স্কুলেও কমতে থাকল ইহুদি পড়ুয়াদের সংখ্যা । তাই অগত্যা 1953 সালে স্কুল কর্তৃপক্ষ অন্যান্য সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলে ভর্তির জন্য দরজা খুলে দিল ।"
তিনি আরও বলেন, "ইহুদি সম্প্রদায়ের পড়ুয়ার সংখ্যা কমতে থাকায় এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের পড়ুয়ারা বেশি সংখ্যক হওয়ায় 1970 সালের পর থেকে হিব্রু ভাষায় প্রার্থনা ও তনক পড়ানো বন্ধ হয়ে যায় । এখনও স্কুলের হল ঘরে স্কুল থেকে প্রথম যাঁরা সিনিয়র কেমব্রিজ স্কুল সার্টিফিকেট পাস করেছিলেন, সেই সব ছাত্রীদের নাম কাঠের ফলকে লেখা রয়েছে ।"
আরও পড়ুন : Belashuru Film : নিঃসঙ্গ নবতিপর দেবব্রত ঘোষকে পাশে নিয়ে বেলাশুরু দেখলেন নগরপাল