কলকাতা, 24 জুন : দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের পর থেকেই আবর্জনামুক্ত দেশ গড়ার দিকে বাড়তি নজর দেওয়া শুরু হয়েছে । শুরু হয়েছে স্বচ্ছ ভারত অভিযান । পিছিয়ে নেই রাজ্যও । কেন্দ্রের মতো রাজ্যেও আবর্জনামুক্ত পশ্চিমবঙ্গ গড়তে চালু করা হয়েছে প্রকল্প । পোষাকি নাম নির্মল বাংলা অভিযান । কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রক প্রকাশিত 2019-20 সালের রিপোর্টে আবর্জনামুক্ত শহরের তালিকায় ছয়টি শহরকে সবার উপরে রাখা হয়েছে । এগুলির মধ্যে রয়েছে ছত্তিশগড়ের অম্বিকাপুর, গুজরাতের রাজকোট ও সুরাত, কর্নাটকের মাইসোর, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর ও মহরাষ্ট্রের নভি মুম্বই । এই ছয়টি শহরকেই আবর্জনামুক্ত শহর হিসেবে ফাইফ স্টার তালিকাভুক্ত করা হয়েছে । এছাড়াও 65 টি শহরকে থ্রি স্টার তালিকাভুক্ত ও 70 টি শহরকে ওয়ান স্টার তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ।
এই তালিকা প্রকাশের সময়ে, আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হরদীপ এস পুরি জানিয়েছিলেন, "কোরোনার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্যানিটেশন ও সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের গুরুত্ব আগের থেকে অনেকটাই বেড়েছে । বিগত পাঁচ বছর ধরে শহরাঞ্চলে স্বচ্ছ ভারত অভিযান যে প্রভাব ফেলেছে, তার জেরেই কোরোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়া থেকে আটকানো গেছে ।"
আবর্জনামুক্ত শহরের তালিকায় কলকাতা কোথায় ?
তবে কেন্দ্রের প্রকাশিত এই তালিকায় নাম নেই তিলোত্তমার । রাজনৈতিক মতভেদের কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক, এই কেন্দ্রের আবর্জনামুক্ত শহরের এই তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণ করে না কলকাতা পৌরনিগম । তবে তিলোত্তমাকে দূষণমুক্ত রাখতে ও আরও বেশি করে পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে একাধিক পদক্ষেপ করেছে কলকাতা পৌরনিগম ।
কলকাতা পৌর নিগমের প্রশাসক মন্ডলীর সদস্য দেবব্রত মজুমদার জানিয়েছেন, "সচ্ছ ভারত অভিযান কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্প । 'মোদি সরকার'-এর কোনও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক কলকাতা পৌরনিগম । তাই রাজনীতিগত মতপার্থক্যের কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারের তালিকায় নাম নেই কলকাতা শহরের ।"
শহর থেকে প্রতিদিন 4 হাজার 500 মেট্রিক টন আবর্জনা সংগ্রহ করে কলকাতা পৌরনিগম । কলকাতা পৌরনিগমের কাছে এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন শহরের পরিবেশবিদদের একটি বড় অংশ । তার উপর এত ঘনবসতিপূর্ণ শহরকে আবর্জনামুক্ত করে পরিবেশবান্ধব গড়ে তোলার কাজ বেশ কঠিনও বটে ।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক তিলোত্তমাকে আবর্জনামুক্ত রাখতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে
- কলকাতায় আগে জায়গায় জায়গায় খোলা ভ্যাট ছিল । এই সমস্ত খোলা ভ্যাট গুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে । নতুন করে 113 টি কম্প্যাক্টার স্টেশন তৈরি করা হয়েছে । এখন দু'শো-টিরও বেশি মোবাইল ভ্যান কম্প্যাক্টার শহরজুড়ে আবর্জনা সংগ্রহের কাজ করে ।
- আগে শহরে দিনে একবার করে সাফাইয়ের কাজ হত । এখন সকালে, বিকেলে ও সন্ধ্যায় তিনবার করে রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় । বাজার অঞ্চলগুলিতে রাতেও সাফাইয়ের কাজ চলে ।
- নতুন করে বহু সাফাইকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে পৌরনিগমে । শেষ এক বছরে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে মোট 17 হাজার মজদুর ও সাফাইকর্মী নিয়োগ করেছে কলকাতা পৌরনিগম ।
- সাফাইয়ের কাজকে আরও দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যাটারি চালিত গাড়ির ব্যবহার করছে কলকাতা পৌরনিগম । ব্যাটারি চালিত গাড়ির সাহায্যে এলাকা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করা হচ্ছে । এর ফলে একদিকে যেমন দ্রুত আবর্জনা সাফাই করা সম্ভব হচ্ছে, সেই সঙ্গে ব্যাটারি চালিত গাড়ি হওয়ার জন্য দূষণের সম্ভাবনা নেই ।
- শহরে এই মুহূর্তে সাড়ে তিন হাজার সুলভ শৌচালয় রয়েছে । শেষ এক বছরে নতুন করে চার'শো-টির কাছাকাছি সুলভ শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে কলকাতায় ।
- বায়ো-মেডিকেল বর্জ্যের জন্য করা হয়েছে পৃথক ব্যবস্থা ।
ধাপা সমস্যা ও তার মোকাবিলায় কলকাতা পৌরনিগম
কলকাতাকে দূষণমুক্ত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা ছিল ধাপা । দীর্ঘ বছর ধরে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ধাপাতে শহরের আবর্জনা ফেলতে ফেলতে স্তুপে পরিণত হয়েছিল । বর্তমানে সেখানেও পুনর্নবীকরণের কাজ শুরু করেছে কলকাতা পৌরনিগম । ধাপায় তৈরি হচ্ছে জৈব সার । বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে শহরের বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে । একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতা পৌরনিগম বজ্র পদার্থ থেকে জৈব সার প্রস্তুত করছে ।
দেবব্রত মজুমদার জানিয়েছেন, "এই মুহূর্তে ধাপায় প্রতিদিন 500 টন জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে । দিন দিনে চাহিদা বাড়ায় এই প্রকল্পকে আরও উৎসাহ দিচ্ছে কলকাতা পৌরনিগম । আগামী কিছুদিনের মধ্যে আরও 600 মেট্রিক টন উৎপাদন করার জন্য ইতিমধ্যে টেন্ডার ডাকা হয়েছে । ক্রমাগত জঞ্জাল জমতে জমতে স্তুপে পরিণত হয়েছে । প্রতিদিন শহর থেকে 4 হাজার 500 টন আবর্জনা ফেলা হয় । ক্রমাগত জমতে থাকা আবর্জনা থেকে শহরে বায়ু দূষণ ও পরিবেশ দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে । এই আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি করে শহরকে দূষণমুক্ত করা যাবে । সেই সঙ্গেই আবর্জনার স্তুপ কমে আসবে ।"
এই মুহূর্তে 20 টি ওয়ার্ড থেকে জৈব ও অজৈব বর্জ্য পদার্থগুলিকে পৃথক করে সংগ্রহ করা হচ্ছে । আগামী দিনে কলকাতা সবকটি ওয়ার্ডেই এই ব্যবস্থা চালু করা হবে । আগামী দিনে ওয়ার্ডগুলিতে পচনশীল বর্জ্য থেকে সার তৈরি করার কারখানা তৈরি করার পরিকল্পনা করছে কলকাতা পৌরনিগম । দেবব্রতবাবু জানিয়েছেন, বিভিন্ন বহুতল আবাসনের মধ্যে সার তৈরির মেশিন বসানোর চিন্তা ভাবনা ইতিমধ্যেই শুরু করেছে পৌরনিগম । ধাপায় ফেলা বর্জ্য পদার্থ থেকে সার তৈরি ক্ষমতা এই মুহূর্তে রয়েছে দৈনিক 500 টন । আগামী দিনে তা বাড়িয়ে এক হাজার টন করা হবে বলেও জানিয়েছেন দেবব্রত মজুমদার । অপচনশীল বর্জ্যগুলি থেকে রিসাইকেল করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নিচ্ছে কলকাতা পৌরনিগম ।
কলকাতা পৌরনিগমের প্রশাসক মণ্ডলীর সদস্য তারক সিং জানিয়েছেন, "কলকাতায় অনেক বেশি সংখ্যক সুলভ শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে । এর ফলে যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ হয়েছে । ফলে কলকাতা আরও বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়েছে । পাশাপাশি শহরকে আবর্জনামুক্ত করতে নিকাশি নালার কাজ আরও ব্যাপক ভাবে করা হয়েছে শহর জুড়ে । কোথাও জল জমলে যাতে দ্রুত নিষ্কাশন হয়, সে-বিষয়ে একাধিক প্রকল্প কাজ করছে কলকাতা পৌরনিগম । আগের তুলনায় রাস্তাঘাট এখন অনেক বেশি পরিষ্কার ।"
আরও কী কী ব্যবস্থা নিতে পারে কলকাতা ?
- 2019-20 সালের আবর্জনামুক্ত শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ছত্তিশগড়ের অম্বিকাপুর । সেখানে যারা কাগজ, প্লাস্টিক বা অন্যান্য আবর্জনা কুড়ানোর কাজ করেন, তাঁদের জন্য বিশেষ গার্বেজ ক্যাফের ব্যবস্থা করেছে অম্বিকাপুরের স্থানীয় প্রশাসন । 1 কেজি প্লাস্টিকজাত বর্জ্যের বদলে পেটভরে খাবার মেলে সেখানে । আলাদা কোনও টাকা লাগে না ।
- গুজরাতের রাজকোটে আবার আবর্জনামুক্ত শহর গড়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ প্রযুক্তি । বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ট্রাকগুলিতে বসানো হয়েছে GPS ডিভাইস ।
- সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টে আবার সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে সুরাত । এইসব শহরগুলি আবর্জনামুক্ত হতে কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখে অনুরূপ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে তিলোত্তমাকে আরও পরিস্কার, আরও আবর্জনামুক্ত করার জন্য ।
পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্রমোহন ঘোষ জানিয়েছেন, "গত 15 বছর ধরে কলকাতাকে যেভাবে দেখছি, তাতে কলকাতা অনেকটাই পরিস্কার হয়েছে । 15 বছর আগে যেখানে খোলা ভ্যাট ছিল, সেগুলি এখন বন্ধ হয়েছে । অনেকক্ষেত্রে জঞ্জালকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা হচ্ছে । আগে যেখানে ডাম্পিং গ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়ার সময় জঞ্জাল উড়তে উড়তে যেত, তা এখন ঢেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে । বর্তমানে কলকাতা আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন । পাশাপাশি মেডিকেল ও বায়ো-মেডিকেল বর্জ্য নিয়ন্ত্রণেও আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে কলকাতা । গ্লাভস, মাস্ক, সিরিঞ্জ ও অন্যান্য হাসপাতালের বর্জ্যগুলি ফেলার জন্য পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছে । রাজ্য সরকার বিদ্যুৎ চালিত বহু বাস চালু করেছে যার ফলে দূষণের মাত্রা অনেক কমেছে আগের তুলনায় । "
সর্বোপরি এখনকার শহর তিলোত্তমা অনেক বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত । এককথায় কলকাতাকে বর্তমানে গ্রিন ক্লিন সিটি বলা যেতে পারে বলেই মনে করছেন পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্রমোহন ঘোষ ।