কলকাতা, 23 জুন : টানা লকডাউনে নাভিশ্বাস উঠেছিল । অন্নপূর্ণা, বাসন্তী, লক্ষ্মী, গণেশ-কেউ রক্ষা করেনি । উদ্ধার পেতে এখন ভরসা মা দুর্গা । রথের দিনে সেই আশাতেই কুমোরটুলি ৷ হতাশ মৃৎশিল্পীদের মনোভাব, এবার ব্য়বসা লাগবে না, মা কেবল বাঁচিয়ে রাখুন আমাদের ৷ কোনওরকমে দুঃস্বপ্নের 2020 উতরে যেতে চান তাঁরা । আর ক্রমবর্ধমান সংকটমোচনে সাহায্য চাইছেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ৷
কলকাতার কুমোরপাড়া দুঃস্বপ্নে আরও ডুববে না-কি ভেসে উঠবে কোনও আলোর নৌকোয়, তা কতকটা বোঝা যায় রথযাত্রার দিন ৷ প্রতি বছর এই দিনটার অপেক্ষায় থাকেন কুমোরটুলির কয়েক হাজার শিল্পী ও কারিগরও । এমনিতে চৈত্রে, বৈশাখে শুরু হয় বায়না । কিন্তু, রথের দিনই স্পষ্ট হয়, এবছর পুজোতে কতটা বাণিজ্য ৷ যদিও, কোরোনার জেরে সে সব আজ অতীত । অন্য বছর যখন এই সময়টায় নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না মৃৎশিল্পীদের, এবছর সে সময় খাঁ-খাঁ করছে কুমোরটুলি ৷ চাপা শোকের গন্ধ হাওয়ায় ৷ কারণ, দেখা নেই বড় পুজো কমিটিগুলির কর্তাদের । এখনও অপেক্ষায় থাকলেও তলে তলে হতাশা গ্রাস করছে শিল্পীদের । একেবারে বায়না আসছে না, তা নয় । তবে, তা গত বছরের তুলনায় অর্ধেকেরও কম । ঘটনায় প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লক্ষাধিক মানুষ দুশ্চিন্তার প্রহর গুনছে ।
বর্তমানে 460 জন মৃৎশিল্পী রয়েছেন এপাড়ায় । এইসঙ্গে খড় বাঁধা, কাঠামো তৈরি, মূর্তির সাজসজ্জা, পোশাক, পরিধান, গহনা তৈরি-সহ আনুষঙ্গিক অন্য কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় আড়াই লাখ মানুষ । তাঁদের ভাগ্যও ঝুলছে সরু সুতোয় ।
প্রতিমাশিল্পী তরুণ পাল বলেন, "অন্য বছর রথের দিন দুর্গা ঠাকুরে অর্ডার হয় । বাড়ির কাঠামো পুজো হয়ে যায় এইদিন । কিছু বারোয়ারির বায়নাও হয় । এবছর এখনও পর্যন্ত খবর নেই । অসহায় হয়ে বসে আছি । কাজকর্ম নেই ।"
শিল্পীর কথায়, "কাজ না থাকলে মন ঠিক থাকে না । বোকারের মতো বসে আছি । শুনছি, হাইকোর্ট অনুমতি দিলে পুজো হবে, না হলে হবে না । অনেক রকম কথা শুনছি । কী হবে বুঝতে পারছি না । তিনমাস ধরে বসে । 15 টা অন্নপূর্ণা গড়েছিলাম, 15 টাই পড়ে । শীতলা 15-20 টা । বিক্রি হয়নি । এখন যদি জগন্নাথদেব দয়া করেন !"
মৃৎশিল্পী সমীর পাল বলেন, "রাস্তায় গাড়ি নেই ৷ কারিগররা আসতে পারছে না ৷ তাঁরা না এলে ঠাকুর তৈরি করতে পারছি না ৷ তবে, রথের দিন যে বায়না হয়, সেগুলো হচ্ছে । বাড়ির ঠাকুরই বেশি বায়না হয় রথের দিন । কিছু ক্লাবও আসছে । কিন্তু, গত বছর যে দাম পেয়েছি, যে পরিমাণ গ্রাহক পেয়েছি, তা এবছর পাব না । আসল সমস্যা টাকা-পয়সার । টাকা শেষ হয়ে গিয়েছে । এই বাজারে ঠাকুর গড়ার জিনিস কিনতে গেলেও নগদ চাইবে । যেটুকু বায়না পাব, সেটুকুই কাজ করব । দেখি কদ্দুর কী করতে পারি ।"
শিল্পীদের সংকট জানে কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতি । সমিতিও জানাচ্ছে, কোরোনা আবহে কুমোরটুলি ছেড়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন বহু কর্মচারী । একে তো মূর্তির বায়না কম, তার উপর কর্মচারী কমেছে ৷ ফলে অন্য বছর বহু কাজ শেষ হয়ে যায় যে সময়, এবছর সেই কাজ শুরুই করা যায়নি । ফলে, যে সামান্য বরাত এসেছে সে কাজও পড়ে । তবে, এবার বরাতেই কাজ হচ্ছে, আগাম কাজে রাজি নন শিল্পীরা । যেহেতু অন্নপূর্ণা, শীতলা, লক্ষ্মী, গণেশের মতো বহু মূর্তি গড়েও পড়ে থেকে কুমোরটুলির ক্ষতি পরিমাণ 3 কোটি টাকা ৷
কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতির সম্পাদক বাবু পাল বলেন, "দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে । রথে বুঝতে পারব আগামী দিনে পুজোর পরিসংখ্যান কী দাঁড়াবে । তবে, 2019 সালে যে ব্যবসা করেছি, সেই ব্যবসা এবছর হবে না । সবকিছুর দাম বাড়বে ৷ তবে, শিল্পীমানুষ লড়াই করতে ভালোবাসে ।"
প্রতি বছর কুমোরটুলি থেকে বেশ কিছু দুর্গা মূর্তি বিদেশে পাড়ি দেয় ৷ সমিতের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর 58 টি মূর্তি বিদেশে গেছে ৷ এবছরও একই সংখ্যক মূর্তির বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল ৷ কিন্তু, তা হচ্ছে না । কারণ ইতিমধ্যে বাতিল হয়েছে অধিকাংশ অর্ডার । এদিকে শিল্পীর ঘরে মূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে । তার মানে, ফের ধাক্কা বড়সড় ক্ষতির । একের পর এক এমন ক্ষতির মুখে পড়েই বিবর্ণ হচ্ছে কুমোরটুলি । এই অসহায় পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছেন শিল্পীরা ।
বাবু পাল বলেন, "আমরা চাই, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করুন, রাজ্যে পুজো হবে ৷ প্যান্ডেলে ভিড়ভাট্টা না করেও পুজো হবে । এটা যদি উনি ঘোষণা করেন তাহলে আমাদের কাস্টোমাররা পুজো করবেন ৷ তা বাড়িতে হোক কী ক্লাব বা সংগঠনের ৷ আর রাজ্য সরকার যদি অনুদান দেন তাহলে শিল্পীরা উপকৃত হবেন ৷ এই যে শিল্পীরা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন, সাহায্য পেলে এতটাও তলিয়ে যাবেন না ।
কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতি সম্পাদক বাবু পালের কথায়, "মুখ্যমন্ত্রী বাঁচালেই আমরা বাঁচব ।"