কলকাতা, 26 জুন : কোরোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে অবলা জীবদের সঙ্গে চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছেন কোচোয়ানরা। নিজেদেরই দু-বেলা ঠিক মত খাবার জুটছে না । কোচোয়ানদের পরিবার ও ঘোড়াদের কার্যত অনাহারে কাটছে দিন।
ঐতিহ্য ও পরম্পরা সঙ্গে যুক্ত কলকাতার ঘোড়ার গাড়ি। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত এমনকী দেশ-বিদেশ থেকে বহু ভ্রমণপ্রিয় মানুষ শহরে এসে ঘোড়ার গাড়িতে সওয়ার হয়। সুন্দর নকশাকরা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে চেপে শহর ঘুরে দেখে তারা। পর্যটকদের জন্য সারা বছর লাইন দিয়ে গড়ের মাঠ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বিড়লা তারামণ্ডল চত্বরে রীতিমতো অপেক্ষায় থাকে ঘোড়ার গাড়িগুলি। পর্যটকদের শহর ঘুরিয়ে বিনোদন দিয়ে তাদের কাছ থেকে যে অর্থ উপার্জন হয় তা নিয়ে বাড়ি ফেরে কোচোয়ানরা। এই অর্থেই নির্বাহ হয় পরিবারের দুবেলা আহার। যদিও অর্থ উপার্জনের বিষয়টা ছিল কোরোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির একদম শুরু ও লকডাউন জারি হওয়ার আগের সময়টিতে । তবে বর্তমান চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিড়লা তারামণ্ডল ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে নকশা আঁকা ঘোড়ার গাড়ি পর্যটকদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার বদলে মনমরা হয়ে পড়ে রয়েছে কোচোয়ানদের আস্তাবলে। দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় ভ্রমণপ্রিয় মানুষ বা পর্যটকদের মুখ দেখেনি ঘোড়ার গাড়িগুলি। ফলে কোচোয়ানদের অবস্থা খুবই সংকটজনক। নেই উপার্জন। পরিবারের জন্য দু'বেলা আহার জোটাতে পারছেন না তারা। এই পরিস্থিতিতে বাড়তি চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াগুলোকে নিয়ে। কার্যত না খেয়ে দিন কাটছে ঘোড়াগুলোরও। অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে কী করবে তা ভেবে উঠতে পারছেন না কোচোয়ানরা।
প্রসঙ্গত, ইংরেজ শাসনকালে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি নামানোর ব্যবস্থা করা হয়। এদের চলাচলের সুবিধার জন্য শহরের রাস্তাঘাটের উন্নতি শুরু হয়। প্রথমে ইট-সুরকি, সিমেন্ট পরে পিচের রাস্তা তৈরি হয়। ইংরেজদের পাশাপাশি দেশিয় জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির লোকজনও ঘোড়ার গাড়িকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বড় শহর থেকে ধীরে ধীরে মফস্বল শহরেও এর প্রচলন ঘটে। যদিও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে অবলুপ্তি ঘটে ঘোড়ার গাড়ির। বর্তমানে শহরে মাত্র 29 টি ঘোড়ার গাড়ি চলে। এই ঘোড়ার গাড়ির অধিকাংশই বিড়লা তারামণ্ডল ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চত্বরে ভাড়া খাটে। এর মধ্যে আবার কোনও কোনও ঘোড়ার গাড়ি বিয়ে, অন্নপ্রাশন-সহ সামাজিক অনুষ্ঠানে ভাড়া খেটে থাকে। সাধারণত ঘোড়ারগাড়ি চালিয়ে কোচোয়ানরা দিনে আয় করে থাকেন 500 থেকে 600 টাকা। কিন্তু লকডাউন পরিস্থিতিতে বন্ধ রয়েছে বিড়লা তারামন্ডল ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মতো ঐতিহাসিক বিনোদন ক্ষেত্র। এছাড়াও কোরোনা সংক্রমণের আতঙ্কে বন্ধ রয়েছে সামাজিক অনুষ্ঠান। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন কোচোয়ানরা।
ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান মোঃ সালাম Etv ভারতকে বলেন, "লকডাউনের কারণে প্রায় চার মাস বসে আছি। কাজকর্ম নেই । আগে বিয়ে বাড়ি ও অন্যের অনুষ্ঠানে কাজ করেও আয় হত। নিজেদের খাবার নেই। ঘোড়ায় খাবার নেই। ঘোড়ার পিছনে প্রতিদিন 200 টাকা খরচ। খুব খারাপ পরিস্থিতি আমাদের। কোনও সাহায্য পাচ্ছি না।" একই রকম দুরবস্থার কথা শোনালেন আর এক কোচোয়ান মোহাম্মদ জাহিদও। এক সময় ঘোড়ার গাড়িতে মানুষকে চাপিয়ে বিনোদন দিতেন কোচোয়ানরা ৷ আজ চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়ে রয়েছেন । এর থেকে কবে মুক্তি পাবে, কবে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে নতুন ভোর আসবে সেই অপেক্ষায় দিন গুনছেন তারা।