কলকাতা, 18 অক্টোবর : আজকের "সবুজ বিপ্লব"-এ আবিচ্ছেদ্য হিমঘর ৷ ফসল সংরক্ষণে, প্রয়োজনের সময় বণ্টনে বিকল্পহীন সে ৷ কিন্তু এরাজ্যে কৃষি দ্রব্যের উৎপাদনের তুলনায় হিমঘর কম ৷ প্রধান ফসল ধান গোডাউনে রাখলে চলে । কিন্তু দ্বিতীয় লাভজনক ফসল আলুর জন্য হিমঘর জরুরি । এইসঙ্গে শাক-সবজি সংরক্ষণেও দরকার হিমঘর । সেই দরকার মিটছে না ৷ ফলে আলু হিমঘরে জায়গা পেলেও অন্য সবজির স্থান হচ্ছে না ৷ নষ্ট হচ্ছে ফসল, দাম পাচ্ছেন না চাষিরা ৷
রাজ্যে মোট 460টি হিমঘর রয়েছে । যেখানে 70 লাখ টন অবধি আলু সংরক্ষণ করা সম্ভব । সংখ্যায় অল্প তবু এমন হিমঘরও রয়েছে যেগুলিতে অন্য সবজি সংরক্ষণ করা হয় । হিমঘর মালিকরা জানাচ্ছেন, এই 'মাল্টিপারপাস' হিমঘরগুলিতে টমেটো, পটল, কুমড়োর মতো সবজি সংরক্ষিত হয় । রাজ্যে মাল্টিপারপাস হিমঘর রয়েছে 21টি । যেখানে 70 হাজার টন অবধি সবজি সংরক্ষিত হয় । বোঝাই যাচ্ছে আলুর যতখানি জায়গা হয় হিমঘরে, তত জায়গা হয় না সবজির ৷ যদিও রাজ্যে উৎপাদিত আলু ও গোটা বছরে চাহিদা অনুযায়ী আলুর সংরক্ষণ তাতেও সবটা সম্ভব হচ্ছে না ৷ পরিসংখ্যান এরকম- বছরে প্রায় 100 লাখ টন আলু উৎপাদন হয় রাজ্যে । হিমঘরে 70 লাখ টনের স্থান হয় ৷ বাকি 30 লাখ টন চাষিকে বিক্রি করে দিতে হয়, না হলে তা নষ্ট হয় ৷ রাজ্যের হিমঘর সংগঠনের মালিকরা অবশ্য জানাচ্ছেন, ওই 70 লাখ টন আলুই হিমঘরে আসে ৷
বাকি আলু কোথায় যায় ?
হিমঘর সংগঠনের সম্পাদক পতিতপাবন দে জানান, বাকি আলু মাঠ থেকেই ব্যবসায়ীরা কৃষকদের থেকে কিনে নেন । ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে আলু মাঠ থেকে সরাসরি চলে যায় ব্যবসায়ীদের হাতে । হাত ঘুরে রাজ্যের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরো বাজারে চলে যায় সেই আলু । বাকি 9 মাসের আলু হিমঘরে রাখার প্রয়োজন হয় । উল্লেখ্য, সারা বছরই হিমঘরের আলু বাজারে বিক্রি হয় । কিন্তু তার সঙ্গে চাষির সম্পর্ক খুব কম ৷ ফড়েরাই চাহিদার সময় ভালো দাম রেখে বাজারে আলু ছাড়ে ৷ উলটো দিকে পর্যাপ্ত আলু উৎপাদন হলে কৃষক সমস্যায় পড়েন ৷ কারণ, হিমঘরে তার স্থান হয় না ৷ সেই সময় বাজারে চাহিদা কম থাকলে পরিশ্রমের সেই ফসলও নষ্ট হয় । এইসব কারণে রাজ্যের অন্যতম অর্থকরী ফসল আলুর জন্য আরও হিমঘরের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ৷ মাল্টিপারপাস হিমঘরের প্রয়োজন তো আরও বেশি ।
রাজ্যের হিমঘর অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক পতিতপাবন দে বলেন, " গত বছর 78 শতাংশ আলু সংরক্ষণ করা হয়েছে । চলতি বছরে সেই আলুই খাচ্ছি আমরা । 2019 সালে 85 শতাংশ সংরক্ষিত আলুর পুরোটাই ব্যবহার করা হয়েছিল । 2017 এবং 2018 সালে উৎপাদিত আলু বণ্টন করা গিয়েছিল সময় মতো ।"
যদিও চাষিদের একটা অংশ জানাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে হিমঘরের কৃষিপণ্য রাখার খরচের কথা ভেবে ফড়েদের ফসল বিক্রি করে দেয় চাষিরা ৷ কিন্তু হিমঘরে খরচ কতটা ?
জানা গিয়েছে, হিমঘরে স্টোর ভাড়াসহ আনুষাঙ্গিক খরচ মিলিয়ে 1 কেজি আলুতে খরচ 5-6 টাকা । এছাড়াও হিমঘরে রাখলেও বস্তা প্রতি 8 শতাংশ অর্থাৎ 50 কেজিতে গড়ে 4 কেজি আলু বিভিন্নভাবে নষ্ট হয় । বর্ধমান এবং হুগলি জেলার আলু চাষিরা জানান, এইসব কথা মাথায় রেখেই কিছু আলু রেখে বাকিটা তাঁরা বিক্রি করে দেন । কাদের কাছে বিক্রি করেন? অবশ্যই ফড়েদের কাছে ৷ এইখানে একটা বিষয় স্পষ্ট ৷ হিমঘর ও চাষিদের যতটা না সম্পর্ক, তারচেয়ে গভীর সম্পর্ক এই ফড়ে বা ব্যবসায়ী শ্রেণির ৷ এরাই কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে আলু কিনে হিমঘরে মজুত করে । চাহিদা মতো বেচে প্রচুর পরিমাণ লাভ করে ৷ এই ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেই কৃত্রিম সংকট তথা কৃষিপণ্যের কালোবাজারির অভিযোগও ওঠে । আসল কথা, ঘাম ঝরিয়ে সোনার ফসল ফলায় চাষি আর লাভের গুড় খায় ফড়ে !
আলু চাষি শেখ সালেখ জানান, "হিমঘরে আমাদের কোনও লাভ হয় না ৷ মাঠ থেকেই ফসল বিক্রি করে দিই ৷ ফসল তোলার সময় যদি আলুর দাম হয় তাহলে লাভ হয় ৷ নচেত সব লাভ পার্টির (ফড়ে) ৷"
কিন্তু হিমঘরে চাষিরাই সরাসরি ফসল রাখেন না কেন ? শেখ সালেখ জানাচ্ছেন, "গরিব চাষি দেনা করে চাষ করে ৷ ফসল উঠলে সেই ধার শোধ করতে হয় ৷ এরপর হিমঘরের খরচ সামলাতে পারে না সে ৷"
এই উত্তর হয়তো একা শেখ সালেখের না, রাজ্যের বহু কৃষকেরই ৷ একথা সমর্থন করলেন পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সভার নেতা অমিয় পাত্র ৷
তিনি বলেন, "কৃষককে ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না হিমঘরগুলি । ফড়েরা হিমঘরের দখল নিচ্ছে । অধিকাংশ হিমঘরই তো বেসরকারি ৷ গরিব কৃষকের হিমঘরে কোনও লাভ হচ্ছে না ৷ চাষি 7 টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছে, সেই আলু 38 টাকা কেজি দরে কিনছি আমরা ৷"
কেন্দ্রের নয়া কৃষি আইনেরও বিরোধিতা করেন অমিয়বাবু ৷
তিনি বলেন, "নতুন কৃষি বিলে শিল্পপতিদের সুযোগ বৃদ্ধি করা হল । কৃষকের থেকে সবজি কিনবে কর্পোরেটরা । আরও বেশি বেসরকারি হিমঘর তৈরি হবে ৷"