কলকাতা, 23 জুলাই: ঘটনা 1: গত মার্চের শেষ সপ্তাহে হুমকির মুখে পড়েন এক বেসরকারি হাসপাতালের এক নার্স । সোদপুরের আজাদ নগরের বাসিন্দা ওই নার্সের অভিযোগ ছিল, তাঁকে এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলর কর্মস্থলে যেতে নিষেধ করেন । আসলে আড়িয়াদহের বাসিন্দা 57 বছরের এক ব্যক্তির শরীরে মিলেছিল কোরোনা ভাইরাসের জীবাণু । 23 মার্চ থেকে তিনি ওই হাসপাতালে ভরতি ছিলেন । সর্দি-কাশি জ্বর নিয়ে ভরতি হয়েছিলেন । তাঁকে ID হাসপাতালে পাঠানো হলে সেই খবর প্রকাশ্যে আসে । এরপরই ওই নার্সের বাড়িতে লোকজন নিয়ে হাজির হন এলাকার কাউন্সিলর আশিস দেব রায় ।
সেই সময় ওই নার্স জানান, "উনি (কাউন্সিলর) আমাকে কাজে যেতে নিষেধ করেন । আগামীকাল যদিও আমার ডিউটি রয়েছে তবু ওঁর কথাকে সম্মান জানিয়ে কাল কাজে যাব না৷ ম্যানেজমেন্টকে জানিয়েছি । কিন্তু, পরদিন থেকে কাজে যেতেই হবে । আমার মেয়ে থ্যালাসেমিয়া রোগী । প্রচুর চিকিৎসা খরচ । কাজে না গেলে চলবে না । যদিও ওঁর (কাউন্সিলর) সঙ্গে থাকা লোকজন বলে গেছে, কাজে গেলে আমরা ঠিক খবর পেয়ে যাব । কী করব বুঝতে পারছি না !"
ঘটনা 2: এই ঘটনা এপ্রিল মাসের ৷ রাজারহাটের নারায়ণপুরের মনি খোলা এলাকায় স্বাস্থ্য কর্মীদের ওপর চড়াও হয় বেশকিছু মানুষ । কেন? যেহেতু তাঁরা হাসপাতাল কর্মী ৷ হাসপাতাল কর্মীদের থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায় তাঁদের বাড়ি ঘিরে শুরু হয় বিক্ষোভ । এমনকী উত্তেজিত জনতা ইট-পাথর ছোড়ে বাড়িতে । ঘটনার খবর পেয়ে বিধাননগরের ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায় ঘটনাস্থানে পৌঁছান । তখন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এলাকায় । পরে পুলিশ গিয়ে গোলমাল নিয়ন্ত্রণে আনে ।
শুধু এরাজ্যেই নয়, এই ধরনের ঘটনা গোটা দেশেই ঘটতে শুরু করে একটা সময় থেকে ৷ যার পর চিকিৎসক, নার্স, অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানায় কেন্দ্র । আনা হয় নতুন আইন । কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভারেকার জানিয়ে দেন, চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর হামলায় অভিযুক্তকে 1 থেকে 5 লাখ টাকা অবধি জরিমানা দিতে হবে ৷ পাশাপাশি 6 থেকে 7 বছরের জেল হতে পারে । যদিও তার পরেও খুব একটা পালটায়নি অবস্থা । তার প্রমাণ সরশুনার ঘটনা ।
এক ভাই কোরোনা হাসপাতালের BMOH ৷ তাই আক্রমণের মুখে পড়তে হল আরেক ভাইকে । বিষ্ণুপুর 1 নম্বর ব্লক হাসপাতালে চিকিৎসক সৈকত বসু । মহামারি বনাম মানুষের যুদ্ধে লড়াই করছেন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে । প্রথম দিকে তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরছিলেন না ৷ আমতলার কাছে একটি হোটেলে থাকছিলেন । পরে সরশুনার নিজের বাড়িতে বাবা-মা ও দাদা সুদীপ্ত বসুর কাছে ফিরে আসেন । এরপরই এলাকাবাসীর নাছোড় দাবি, যেহেতু সৈকতবাবু কোরোনা হাসপাতালের চিকিৎসক, অতএব তাঁর পরিবারের সদস্যরা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবে না ।
গত 21 জুলাই প্রতিবেশী সাত-আটজন সুদীপ্তবাবুর উপর চড়াও হয় । বচসার পর লোহার রড দিয়ে মেরে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয় ।
শুধুমাত্র চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাই নয় । একশ্রেণির মানুষের হামলার মখে পড়ছেন কোরোনা রোগীরাও । যেমন, পাটুলির কেন্দুয়া মেইন রোডের একটি ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা হীরক নাগের ঘটনা । তিনি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকুরে । স্ত্রী সোমা নাগ স্কুল শিক্ষিকা । যিনি এই মুহূর্তে গর্ভবতী । হীরকবাবু ও বাড়ির পরিচারিকা কোরোনা আক্রান্ত । কিছুদিন আগেই পরিস্থিতির চাপে হীরক নাগ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ৷ অভিযোগ জয়ন্ত ওরফে অশোক ঘোষ ও তাঁর ছেলে অনির্বাণ ঘোষের বিরুদ্ধে । অভিযুক্তেরা একই অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা । সম্প্রতি অনির্বাণ হীরক নাগকে ফোন করে হুমকি দেয় । এরপর জোড় করে ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে বলে । দরজা খুলতেই অশোক ঘোষ ও ছেলে অনির্বাণ হীরকবাবুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে । তাঁকে জুতোপেটা করে বাপ-ছেলে মিলে । হীরকবাবুর দোষ তিনি কোরোনা রোগী ! প্রশ্ন হল, বারবার এমনটা কেন ঘটছে? কীভাবে বদলাবে সামাজিক এই ব্যধি ?
বাংলার বিশিষ্টজনদের মতে, বিষয়টা বাস্তবিক ব্যধির পর্যায়ে চলে গেছে । তাঁদের কথায়, এমনটা কাম্য নয় ।
সাহিত্যিক আবুল বাশার বলেন, "পোড়া দেশের ঘুণধরা সমাজ ব্যবস্থার নগ্ন ছবি দেখছি আমরা ৷ যারা মহামারির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করছেন, তাঁদের আক্রমণ করছি আমরা !" কিন্তু, কীভাবে বদলাবে পরিস্থিতি? তিনি আরও বলেন, "একদিকে সামাজিক প্রচার চালাতে হবে, অন্যদিকে পুলিশকে কড়া হাতে দমন করতে হবে এই অন্যায় । বার্তাটা আক্রমণকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে ৷ এমন ঘটনা ঘটালে কোনওভাবেই যেন রেয়াত না করা হয় । এই বিষয়ে রাজনৈতিক দল, পাড়ার ক্লাবগুলোকেও হাতে হাত রেখে কাজ করতে হবে । মানুষকে বোঝাতে হবে লড়াইটা রোগীর সঙ্গে নয়, রোগের সঙ্গে ।"
সাহিত্যিক বাণী বসুর কথায়, "ভাবতেই পারি না, এমন ঘটনাও ঘটতে পারে ! আসলে মানুষ অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে । কোরোনা হলে আর ফিরবে না, ধরে নিয়েছে ! অনেক ক্ষেত্রেই মৃতদেহ দেখতে পারছে না পরিজন । সাধারণের অলক্ষ্যে দেহ দাহ করা হচ্ছে । এইসব মানুষকে ট্রমাটাইজড করে দিয়েছে । ফলাফল, মানুষ মনুষত্ব হারিয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে ।
তিনি আরও বলেন, "তাই বলে কোরোনার বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করছেন বা যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের ওপর আক্রমণ মানা যায় না । যাঁরা আক্রমণ করছেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, আগামী দিনে তাঁর পরিজনও সংক্রমিত হতে পারে । শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ করছি সকলকে ।"
"মানুষ উন্মাদ হয়ে গেছে !" বলছেন কবি মন্দাক্রান্তা সেন ৷ তাঁর কথায়, "যারা মানুষকে বাঁচাচ্ছেন তাঁদের উপরে আক্রমণ হচ্ছে ! যাঁদের দিকে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত, সেই রোগীদের উপর হামলা হচ্ছে ! দুর্ভাগ্যজনক !"