কলকাতা, 28 জুলাই : একটু আসছি বলে দুপুরে বেরিয়েছিলেন ৷ ঘড়ির কাঁটা তখন রাত দশটা পেরিয়েছে । তখনও ফেরেননি ৷ কোথায় গেল জলজ্যান্ত মানুষটা? 6 মাস আর 3 বছরের দুটি শিশুপুত্রকে নিয়ে রাতে চিন্তায় তখন ঘুম উড়েছে আমিনা বিবির ৷ রাত যখন আরেকটু বাড়ল, ছুটে গেলেন ভাসুর শানোয়ার আলি পুরকাইতের কাছে ৷ জানালেন ঘটনা ৷ সেটা ছিল শনিবার ৷ 2017 সালের 19 মার্চ ৷ রাতটা বিনিদ্রই কেটেছিল ৷ রবিবার সকালেও শওহর আনোয়ার আলি পুরকাইতকে না দেখতে পেয়ে সোজা গেছিলেন নাদিয়াল থানায় ৷ পুরোটা জানিয়েছিলেন ডিউটি অফিসারকে ৷ অফিসার সব শুনে প্রশ্ন করেছিলেন, “কারোর সঙ্গে শত্রুতা নেই তো?” মাথা নেড়েছিলেন আমিনা ৷ বাড়ির কাছেই কাজ ৷ নির্মীয়মাণ বহুতল বাজারের ম্যানেজার ৷ বাজারে কোনও দোকান ঘর বিক্রি হলে সেটি সাজানো, শ্রমিক জোগান দেওয়ার কাজ করতেন আনোয়ার ৷ এলাকার কেউ জোর গলায় কথা বলতে দেখেনি তাঁকে ৷ তবে কী এমন হল?
সব শুনে পুলিশ যায় লালপুল এলাকায় ৷ প্রথমে আনোয়ারের বাড়িতে ৷ ততক্ষণে ভিড় জমেছে সেখানে ৷ তদন্তকারী অফিসার দেখতে চাইলেন কর্মস্থান ৷ বাজারে কথা বলে জানতে পারলেন চারতলার একটি দোকান সাজানোর কাজ করছিলেন আনোয়ার ৷ অফিসার যান চারতলায় ৷ খোলেন নির্দিষ্ট দোকানের শাটার ৷ দেখা যায় মেঝেতে পড়ে আছে চাপ রক্ত ৷ মার্কেটের অন্যদের সঙ্গে কথা বলে কোনও ক্লু পাননি অফিসার ৷ বোঝা যাচ্ছিল না কিছুই ৷ জানা যায়, যক্ষ্মায় ভুগছিলেন আনোয়ার ৷ তবে কি এ রক্ত কাশির? না কি অন্য কিছু । ধন্দে পড়েন অফিসার ৷ ফোন করেন বড়বাবুকে ৷ খবর যায় লালবাজারে ৷ এবার ময়দানে নামে কলকাতা পুলিশের দুঁদে গোয়েন্দা ৷ রক্তের দাগ দেখে আর আশপাশের গন্ধ শুঁকে দৌড় শুরু করে সে ৷ বাজারের গলি পার হয়ে পার্ক, সেটিও পার হয়ে যায় ৷ পৌঁছে যায় এক পুকুরে ৷ তবে কি এই পুকুরেই আনোয়ারের দেহ? না ৷ সেখানেই থামা নয় ৷ এবার গোয়েন্দা পৌঁছায় একটু দূরে মনজ়ুর আলম মোল্লার বাড়ি ৷ সেখানে শুরু করে হাঁকডাক ৷ বাড়ি ছিলেন না মনজ়ুর ৷ বাড়ির এককোণে বালতির কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় গোয়েন্দা ৷ তারপর পুলিশ সেই বালতিতে পায় রক্তমাখা পাঞ্জাবি ৷
তখন ঘটনাটা মনে পড়ে যায় আনোয়ারের দাদার ৷ প্রোমোটার মনজ়ুরের কাছে ছ’লাখ টাকা পেতেন আনোয়ার ৷ শ্রমিক সাপ্লাই, ইট-বালির দাম বাবদ ওই টাকা পেত ৷ দিন কয়েক আগে দিয়েছিলেন তাগাদাও ৷ তবে কি খুনই হয়েছেন আনোয়ার? ধারণাটা বদ্ধমূল হতে শুরু করে ৷ নাদিয়াল থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করে আনোয়ারের পরিবার ৷ শুরু হয় 302, 102-বি ধারায় মামলা ৷ নিখোঁজের ঘটনা মোড় নেয় খুনের মামলায় ৷ সৌজন্যে সেই গোয়েন্দা ৷ নাম তার জিপসি ৷ কলকাতা পুলিশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে ক্ষুরধার গন্ধ সন্ধানী জিপসি৷ বয়স মাত্র সাড়ে চার ৷
মুচিপাড়ার কোটি টাকার ঘড়ি চুরি হোক বা হরিদেবপুরের সোনার দোকানে ডাকাতি ৷ জিপসিই তদন্তকারী অফিসারদের হাতে তুলে দিয়েছিল নানা প্রমাণ৷ তার ভিত্তিতেই সমাধান হয়েছিল রহস্য ৷ আর নাদিয়াল থানার এই ঘটনায় জিপসির দেওয়া সূত্রেই শুরু হয় তদন্ত ৷
আইন বলছে, খুনের কেস সাজাতে প্রথমেই চাই দেহ ৷ সেই মৃতদেহের খোঁজ শুরু হয় ৷ জিপসির হ্যান্ডলার কনস্টবেল এম মণ্ডল তদন্তকারী অফিসারকে জানান, পুকুরে মিলতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ক্লু ৷ তবে কি আনোয়ারের দেহ পাওয়া যাবে পুকুরেই ? জিপসির দেওয়া সূত্র ধরে নামানো হয় ডুবুরি ৷ না, দেহ মেলেনি ৷ তবে যেটা মেলে তাও কম কিছু নয় ৷ একটা হাতুড়ি ৷ এদিকে, রবিবার সকাল থেকেই বেপাত্তা মনজু়র ৷ পুলিশ মোবাইলের টাওয়ার লোকেট করে জানতে পারে সে ফোন ফেলে গেছে বাড়িতে ৷ আনোয়ারের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে ওইদিনই বিকেলে স্থানীয় এক ইটভাটা থেকে পাকড়াও করা হয় সইফুদ্দিন নামে একজনকে ৷ সে মনজু়রের ছায়াসঙ্গী ৷ তাকে জেরা করতেই ভেঙে পড়ে ৷ জানায়, খুনই করা হয়েছে আনোয়ারকে ৷
জানা যায়, পাওনা 6 লাখ টাকার কিছুটা মিটিয়ে দেবেন বলে আনোয়ারকে বাজারে ডেকে পাঠায় মনজ়ুর ৷ ওই বাড়ির ছাদে তখন কাজ করছিলেন চারজন শ্রমিক ৷ দুপুর দেড়টা নাগাদ ওই শ্রমিকদের চলে যেতে বলে সে ৷ তারপর দোকান ঘরের শাটার নামিয়ে হাতুড়ি আর ইট দিয়ে আঘাত করে খুন করে আনোয়ারকে ৷ মৃত্যু নিশ্চিত করতে এরপর গলায় লাগানো হয় ফাঁস ৷ আনোয়ারকে দিনদুপুরে খুন করে বস্তায় মুড়ে সেখানেই ফেলে রাখা হয় ৷ তারপর শাটারে তালা লাগিয়ে তখনকার মতো চলে যায় মনজ়ুর৷ পরে ভোররাতে আনোয়ারের দেহ ফেলে দেওয়া হয় একটি পরিত্যক্ত কারখানার ঝোঁপে ৷ পরে সেখান থেকে উদ্ধার হয় আনোয়ারের দেহ ৷
খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রের সন্ধান আগেই জিপসির লম্বা নাকে ভর করে পেয়েছিল পুলিশ ৷ সেই চিহ্নিত করেছিল খুনি ৷ কলকাতা পুলিশের বড়কর্তারা বলছেন, পুরো তদন্তে নায়ক একজনই ৷ সে জিপসি ৷ কলকাতা পুলিশের ডগ স্কয়্যাডের অন্যতম সদস্য ৷ জাতে এক জার্মান শেপার্ড ৷