কলকাতা, 19 জুলাই : কোরোনার জেরে বন্ধ স্কুল ৷ কবে খুলবে নেই কোনও নিশ্চয়তা ৷ অধিকাংশ স্কুলে অনলাইন মাধ্যমে পঠন-পাঠন ব্যবস্থা চললেও, থমকে গেছে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী । কিছু স্কুল অনলাইনে কাজ চলালেও, তা ক্লাসরুমের বা খেলার মাঠের বিকল্প কখনও নয় । কিন্তু, আগের মতোই পঠন-পাঠনের সঙ্গে সমান তালে কি চলবে সহ-পাঠ্যক্রমিক শিক্ষা? না কি অতিরিক্ত বিবেচনা করে সেগুলিকে তুলে রাখা হবে শেল্ফে ? সব স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকারা এক বাক্যে জানাচ্ছেন, না । পঠন-পাঠন চললে তার সঙ্গে সমানতালে চলবে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী । শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশের জন্য এগুলো কোনওভাবেই বন্ধ করা যাবে না ।
সহ-পাঠ্যক্রম বা এক্সট্রা ক্যারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ় । মানে বিষয়ভিত্তিক পঠন-পাঠনের পাশাপাশি অতিরিক্ত পাঠ্যক্রম । সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিভিন্ন স্কুলে এগুলি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত । এর গুরুত্ব শিক্ষাবিদ থেকে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকরা একবাক্য স্বীকার করেছেন । শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, "লেখাপড়া শেখা মানে এই নয় যে, শুধু বই পড়া বা অঙ্ক কষা । লেখাপড়া মানে হচ্ছে একটা গ্রোথ, নিজে থেকে বেড়ে ওঠা । শুধু মানসিকভাবে নয় শারীরিকভাবেও বেড়ে ওঠা দরকার । সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খেলাধুলো, গান, কবিতা, আবৃত্তি এবং আরও নানা রকমের কাজ করতে হয় । যার জন্য শরীর, মনকেও যোগ্য করতে হয় । সেইজন্য প্রয়োজন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী ৷ যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্যের মতে, "সিলেবাসের বাইরে নয় সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলী । শুধুমাত্র বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা দিয়েই পড়ুয়াদের সার্বিক বিকাশ হয় না । আমাদের এখানে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর উপর প্রচণ্ডভাবে জোর দেওয়া হয় । কারণ আমরা বিশ্বাস করি সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর মধ্যে দিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের সঠিক চরিত্র গড়ে উঠতে পারে।"
লকডাউনের আগে পর্যন্ত প্রতিটি স্কুলের রুটিনে নিয়ম করে রাখা হত সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর ক্লাস । কিন্তু, কোরোনা আবহে স্কুল বন্ধ থাকায় সহ-পাঠক্রম ক্লাসের উপর প্রভাব পড়েছে । তবে বেশ কয়েকটি স্কুল অনলাইনে এখনও কো-ক্যারিকুলার কার্যাবলী চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে । যেমন, শাখাওয়াত মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল । স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া নাগ সিংহ মহাপাত্র বলেন, "এই লকডাউনের সময়ে মেয়েরা বাড়িতে রয়েছেন । আমরা যতটা পারছি, অ্যাকাডেমিকের অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি, যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি । কিন্তু দীর্ঘদিন বাড়িতে থেকে পড়ুয়ারা অত্যন্ত একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে ৷ তারা কারও সঙ্গে মিশতে পারছে না । যার কারণে ওদের মানসিক সুস্থতার উপর প্রভাব পড়ছে ৷ তাই আমরা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসের মাধ্যমে সবটা ঠিক রাখার চেষ্টা করছি । আমাদের সরকারি স্কুলে আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটের কাজগুলি ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে অনলাইনে করানো হচ্ছে । বিভিন্ন হাতের কাজের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের । ওরা অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাচ্ছে । কেউ কেউ আলপনা আঁকছে ৷ ওদের বলা হয়েছে, যখন স্কুল খুলবে তখন আলপনার একটা বই নিয়ে আসবে । ওরা ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে করছে । কেউ আবার ছবি এঁকে পোস্ট করছে । ওদের আরও উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমরা অনলাইনেই ওদের সার্টিফিকেট দিচ্ছি । বলছি, তোমরা আঁকাগুলি জমা দাও তার জন্য আমরা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়কে পুরস্কৃত করব । তাতে ওদের মধ্যে উৎসাহ অনেক বেড়ে যাচ্ছে । বিভিন্ন অনলাইন কম্পিটিশনে মেয়েরা অংশগ্রহণ করছে আমাদের জানিয়ে । খেলার বিষয়টার উপর ভীষণভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি । আমাদের খেলার শিক্ষককে বলা হয়েছে, তিনি যোগাযোগ করছেন।" যাদবপুর বিদ্যাপীঠেও অনলাইনে সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা ৷ তাদের উৎসাহ দিয়ে চলেছেন প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সকলে । এবিষয়ে পরিমল ভট্টাচার্য বলেন, "আমাদের এখানে সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীতে হয় না এমন কোনও বিষয় নেই । বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত যা কিছু আছে তাকে আমরা হাইলাইট করার চেষ্টা করি । আমরা সারা বছরে একটা রুটিন বানাই । সেই রুটিনের ভিত্তিতে আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের রেজিস্টার করাই ৷ কোন ছাত্র-ছাত্রী কোনদিকে বেশি আগ্রহী তা বিচার করা হয় । যাতে আগামীতে আমাদের থেকে আরও ভালো কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, নাট্যব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে । লকডাউনের মধ্যেই আমি পড়ুয়াদের থেকে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যক্টিভিটিজ় দেখতে চেয়েছিলাম ৷ প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী তাদের অ্যাক্টিভিটি আমার কাছে পাঠিয়েছে ।"
তবে অনলাইনের সমস্যা অনেক ৷ অনেকের ইন্টারনেটের সমস্যা । কারও তো আবার বাড়িতে সামান্যতম স্মার্ট ফোনটুকুও নেই । পাপিয়াদেবী জানিয়েছেন, এত কিছুর পরও 100 শতাংশ অংশগ্রহণ পাওয়া যাচ্ছে না ৷ এর অন্যতম প্রধান কারণ হল আর্থিক সংকট ৷ অন্যদিকে, মুরলিধর গার্লস স্কুলে লকডাউনের কারণে আপাতত সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানাচ্ছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অনিন্দিতা রায় । তিনি বলেন, "আমাদের নাচ, গান, যোগা, ক্যারাটে সবই শেখানো হত স্কুলে । প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত একটা করে ক্লাস থাকত । ক্যারাটে জন্য বাইরে থেকে একজন ট্রেনার আনানো হত । কিন্তু, এখন কিছুই করা যাচ্ছে না । শুধু অনলাইন ক্লাস হচ্ছে । আর কিছু হচ্ছে না ।"
তবে, অপেক্ষা এখন কোরানা আতঙ্ক অবসানের । লকডাউন ওঠার । স্কুল খোলার । আর তারপরই স্পষ্ট হবে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ কোন পথে ?