শীতের ভোর ৷ কুয়াশায় ঢাকা চারদিক ৷ চাঁদপুর স্টেশনের এককোণে গুটি মেরে বসে দুই যুবক ৷ পাশ দিয়ে গেলেও কারও নজরে পড়ত না ৷ কোনও কিছুর অপেক্ষা করছেন তাঁরা ৷ প্রতীক্ষার প্রহর যত বাড়তে লাগল, ততই যেন তাঁদের হৃদস্পন্দনের গতি বাড়তে থাকে ৷ একসময় ট্রেনের আওয়াজে তাঁদের চোখ চিকচিক করে উঠল ৷ অপেক্ষার প্রহর শেষ ৷ এবার নিজেদের সংকল্প পূরণের সময় ৷ দৌড়লেন ট্রেনের দিকে ৷ কয়েক মুহূর্ত পরে রিভলভারের গুলির আওয়াজ ৷ হইচই শুরু স্টেশনে ৷ দৌড়ে পালাচ্ছেন দুই যুবক ৷ তাঁদের ধরার জন্য দৌড়াল পুলিশ ৷ তার আগেই অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন ওই দুই যুবক ৷
1930 সালের 1 ডিসেম্বরের এই ঘটনার কয়েকঘণ্টা পর ধরা পড়লেন ওই দুই যুবক ৷ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তী ৷ ধরা পড়ার পর তাঁদের চোখেমুখে ভয়ের কোনও চিহ্ন নেই ৷ বরং নিজেদের কাজ সম্পূর্ণ করতে না পারার বেদনা ধরা পড়ে ৷ কারণ, যাঁকে মারতে গিয়েছিলেন, তিনি বেঁচে গিয়েছেন ৷ মাস্টারদা সূর্য সেনকে দেওয়া কথা না রাখতে পারার যন্ত্রণা রামকৃষ্ণের চোখেমুখে ৷
মাত্র 21 বছর বয়সে দেশের জন্য ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন রামকৃষ্ণ ৷ ছোটো থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখতেন ৷ জন্ম 1910 সালের 16 জানুয়ারি ৷ বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামের সারোয়াতলিতে ৷ বাবার নাম দুর্গাকৃপা বিশ্বাস ৷ মায়ের নাম নয়নতারা দেবী ৷ ছোটোবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ৷ 1928 সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় জেলায় প্রথম হন ৷ ভরতি হন চট্টগ্রামের সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ৷ পাথরঘাটায় বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু করেন ৷ কিন্তু, স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য ক্রমশ মনের ভিতর তোলপাড় চলছিল ৷ মাস্টারদা সূর্য সেন তখন যুবকদের অনুপ্রেরণা ৷ তাই ছুটলেন তাঁর কাছে ৷ তাঁর দীপ্ত চোখে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জেদ দেখতে পান সূর্য সেনও ৷ দলে নেন ৷ কিছুদিনের মধ্যেই মাস্টারদার বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ৷
ব্রিটিশদের মোকাবিলার জন্য দরকার বন্দুক, বোমা ৷ বিপ্লবীরাই বোমা তৈরি করতেন ৷ কিন্তু, বোমা বানানো সহজ কাজ নয় ৷ বিজ্ঞানের ছাত্র রামকৃষ্ণ বোমার ক্যাপ বানানোর দায়িত্ব পেলেন ৷ বোমা বানানোয় ক্রমে দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন ৷ আর বোমা বাঁধতে গিয়েই 1930 সালের ফেব্রুয়ারিতে গুরুতর জখম হন ৷ ফলে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনে অংশ নিতে পারেননি তিনি ৷
তবে বোমার ক্ষত তাঁকে দমাতে পারেনি ৷ পুলিশ যাতে তাঁর খোঁজ না পায়, সেজন্য আহত অবস্থাতেই বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন ৷ সুস্থ হয়েই ফের জড়িয়ে পড়েন বিপ্লবী কার্যকলাপে ৷
সেইসময় চট্রগ্রামে স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনেরাল পদে টি জে ক্রেগকে বসায় ব্রিটিশ শাসক ৷ স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর অত্যাচারের জন্য ক্রেগ তখন সুবিদিত ৷ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উপর এই অত্যাচারের বদলা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মাস্টারদা ৷
1930 সালের 1 ডিসেম্বর ৷ চাঁদপুর স্টেশনে ট্রেনে করে আসবেন ক্রেগ ৷ তাঁকে হত্যার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করলেন মাস্টারদা ও তাঁর দল ৷ দায়িত্ব পড়ল রামকৃষ্ণ ও কালীপদ চক্রবর্তীর উপর ৷ যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন রামকৃষ্ণ ৷ সংকল্প করলেন, অত্যাচারী ক্রেগকে হত্যা করতেই হবে ৷
1 ডিসেম্বর চাঁদপুর স্টেশনে পৌঁছালেন রামকৃষ্ণ ৷ সঙ্গী কালীপদ ৷ দু'জনে অপেক্ষা করতে লাগলেন ৷ একসময় ট্রেন এসে থামল স্টেশনে ৷ দুই যুবক ছুটলেন ট্রেনের দিকে ৷ কিন্তু, ক্রেগকে মারতে পারেননি রামকৃষ্ণরা ৷ ভুল করে রেলের ইন্সপেক্টর তারিণী মুখোপাধ্যায়কে ক্রেগ ভেবে গুলি করেন তাঁরা ৷ খাঁকি উর্দি আর গায়ের ওভারকোট দেখে তারিণী মুখোপাধ্যায়কে ক্রেগ ভেবেছিলেন ৷ গুলিতে মৃত্যু হয় রেলের ওই ইন্সপেক্টরের ৷
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরই বাইশ মাইল দূরে মেহেরকালী স্টেশনে বোমা ও রিভলবার সহ ধরা পড়েন রামকৃষ্ণ ও কালীপদ ৷ ওই বোমাগুলি কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিপ্লবী মনোরঞ্জন রায় ৷ বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় ফেরার একদিন পর 24 নভেম্বর পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলন মনোরঞ্জন ৷
বয়স কম হওয়ায় কালীপদ চক্রবর্তীকে পাঠানো হয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে ৷ তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ৷
রামকৃষ্ণকে পাঠানো হয় কলকাতার আলিপুর জেলে ৷ কলকাতায় এসে ছেলের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পয়সা ছিল না রামকৃষ্ণের পরিবারের ৷ সেইসময় কলকাতায় পড়াশোনা করছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদর ৷ হিজলির জেল থেকে তাঁকে একটা চিঠি লিখলেন মনোরঞ্জন ৷ চিঠিটি প্রীতিলতার কাছে পৌঁছে দেন মনোরঞ্জনের মা ৷ জেলে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে চিঠিটি আনেন তিনি ৷ রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টার জন্য চিঠিতে প্রীতিলতাকে অনুরোধ করেন মনোরঞ্জন ৷
আলিপুর জেল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখলেন প্রীতিলতা ৷ সেখানে নিজের পরিচয় দিলেন রামকৃষ্ণের কাজ়িন হিসেবে ৷ নাম বললেন অমিতা দাস ৷ জেলে গিয়ে রামকৃষ্ণের সঙ্গে প্রায় 40 বার দেখা করেছেন প্রীতিলতা ৷
রামকৃষ্ণের সঙ্গে জেলে সাক্ষাৎ নিয়ে প্রীতিলতা লেখেন, “তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপূর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদি মন এবং প্রগাঢ় উপলব্দিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করল । আগের তুলনায় আমি দশগুণ বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম । আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল ।”
ছেলেকে দেখতে একবার আলিপুর জেলে এসেছিলেন নয়নতারা দেবী ৷ তাঁকে রামকৃষ্ণের কাছে নিয়ে যান প্রীতিলতা ৷ সেদিন ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন নয়নতারা দেবী ৷ তা দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি প্রীতিলতাও ৷
কয়েকমাসের শুনানির পর ফাঁসির সাজা হল রামকৃষ্ণের ৷ দিন ঠিক হল 1931 সালের 4 অগাস্ট ৷ ততদিনের জেলের কুঠুরিতে থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েন রামকৃষ্ণ ৷ অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় ৷
রামকৃষ্ণের ফাঁসি প্রীতিলতার জীবনে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে । তাঁর কথায়, “রামকৃষ্ণদার ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষা আমার অনেক বেড়ে গেল ।”