কলকাতা, 23 সেপ্টেম্বর : কলকাতা-সহ সারা রাজ্যে বেড়েছে ভুয়ো ডাক্তারের সংখ্যা ৷ অভিযোগ, ডাক্তার না হয়েও এই সমস্ত ব্যক্তি ত্বকের নানা সমস্যার চিকিৎসা করছেন ৷ ফলে তাদের প্রেসক্রিপশনে স্টেরয়েডের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ৷ যার জেরে, ভোগান্তিতে পড়ছেন বহু মানুষ ৷ এসব ডাক্তাররা ভুয়ো রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও ডিগ্রি নিয়েই প্র্যাকটিস করে চলেছেন ৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিল (WBMC)-এ এই নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ডার্মাটোলজিস্টস, ভেনেরিওলজিস্টস অ্যান্ড লেপরোলজিস্টস (IADVL)।
2017 সালে রাজ্যজুড়ে ভুয়ো চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিল WBMC ৷ ত্বকের চিকিৎসা করছেন এমন ভুয়ো ডাক্তারদের বিরুদ্ধে 2018-র সেপ্টেম্বরে WBMC-এ অভিযোগ জানিয়েছিল IADVL ৷ চিকিৎসক সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছিল, সন্দেহজনক রেজিস্ট্রেশন এবং ডিগ্রি নিয়ে রাজ্যজুড়ে ডার্মাটোলজি, ভেনেরিওলজি এবং লেপরোলজির চিকিৎসা করছে বেশ কিছু ভুয়ো চিকিৎসক ৷ অনেকে আবার সাধারণ MBBS ডিগ্রি নিয়েও ত্বকের চিকিৎসা করছেন৷ এই ধরনের কিছু চিকিৎসকের নামও WBMC-এ পাঠিয়েছিল IADVL ৷
IADVL-এর রাজ্য সচিব চিকিৎসক সুদীপ দাস বলেন, "এই ধরনের 45 জন ডাক্তারের নামের একটি তালিকা আমরা WBMC-এ পাঠিয়েছিলাম ৷ আমাদের কাছে 100 জন ডাক্তারের নামের তালিকা রয়েছে ৷ এসব ডাক্তারের বিরুদ্ধে এখনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি WBMC ৷ এই বিষয়ে WBMC কোনও পদক্ষেপ নিয়েছে তা জানতে গত ডিসেম্বর এবং এপ্রিলে WBMC-এ মেইল করা হয়েছে ৷ " WBMC-র তরফে এই বিষয়ে IADVL-র কাছে কোনও উত্তর আসেনি ৷ WBMC-র সভাপতি চিকিৎসক নির্মল মাজির কাছে ভুয়ো ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, " আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিই ৷ " তবে IADVL-র অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি ৷
IADVL-র পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি (ইলেক্ট) চিকিৎসক সত্যেন্দ্রনাথ চৌধুরি বলেন, "একই মানুষ প্রেসক্রিপশনে কখনও লিখছেন MD, আবার কখনও লিখছেন Ph.D ৷ গত পাঁচ বছরে এই সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে ৷ শিক্ষিত বহু মানুষ রয়েছেন, ফরসা হওয়ার জন্য যাঁরা এই ধরনের ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন ৷ এদের পরামর্শ মতো ওষুধ ব্যবহার করছেন ৷ কোনও জিনিস কেউ আর খুঁটিয়ে দেখছেন না ৷ ডাক্তারের যোগ্যতা নিয়ে মানুষ খুব একটা বেশি ভাবেন না ৷"
এ ধরনের ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য কোন্ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ? ডাক্তার সত্যেন্দ্রনাথ চৌধুরি বলেন, " দেখে মনে হল মুখে ব্রণ হয়েছে ৷ দেখা গেল আসলে ব্রণ নয় ৷ অনেক সময় ছোট ছোট টিউমার মুখে গজিয়ে ওঠে ৷ অথচ, ব্রণ ভেবে যে ওষুধ ব্যবহার করা হল, স্বাভাবিক কারণেই তা এক্ষেত্রে কার্যকরী নয় ৷ উলটে ক্ষতিকারক ৷ " তিনি আরও বলেন, " ট্রপিক্যাল স্টেরয়েড ৷ আফিম ব্যবহার করলে যেমন আফিমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন মানুষ ৷ তেমনই, মলম আকারের এই ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে, মানুষ আসক্ত হয়ে পড়েন ৷ একে স্কিন অ্যাডিকশন সিনড্রোম বলে ৷ এই মলমের ব্যবহার বন্ধ করে দিলে, যে স্থানে ব্যবহার করা হচ্ছিল সেই স্থান জ্বালা করে, চুলকায় ৷ ফলে আরও বেশি করে ব্যবহার হতে থাকে এই মলম ৷ কিন্তু, যত বেশি ব্যবহার করা হয়, পরিস্থিতি তত খারাপ হতে থাকে ৷ যদি যথাযথ কোনও ডাক্তারের কাছে না যাওয়া হয়, তা হলে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া খুব কঠিন ৷ "
সত্যেন্দ্রনাথ চৌধুরি বলেন, "স্টেরয়েডের বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে ৷ অথচ প্রেসক্রিপশন করার সময় অনেকেই ভুলেই যান ৷ হয়তো কোনও রোগীকে দুই সপ্তাহ ব্যবহারের জন্য লিখে দেওয়া হয়েছে ৷ ভালো ফল পেলেন রোগী ৷ দেখা গেল এই ওষুধ 2 বছর পর্যন্ত ব্যবহার করছেন ওই রোগী ৷ দীর্ঘ সময় ব্যবহারের জন্য স্টেরয়েডের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া স্থায়ী হয়ে গিয়েছে ৷ শরীরের যে অংশে ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানকার চামড়া কুঁচকে গিয়েছে, পাতলা হয়ে গিয়েছে ৷ " IADVL-র রাজ্য শাখার সচিব চিকিৎসক সুদীপ দাস বলেন, "যাঁরা ভুয়ো চিকিৎসক বা অন্য শাখার কিংবা MBBS ডিগ্রি নেই, তাঁরাও ডার্মাটোলজি প্র্যাকটিস করছেন ৷ " ডাক্তার সুদীপ দাস বলেন, "অনেক ওষুধ রয়েছে, যেগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হওয়ার কথা নয় ৷ অথচ, বিক্রি হওয়ার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে পরিস্থিতি ৷ রোগী যখন আমাদের কাছে আসছেন, তখন দেখা যাচ্ছে, হয় মুখের চামড়া পাতলা হয়ে যাচ্ছে, নয়তো গায়ে গুটি বের হচ্ছে ৷ কিংবা, মুখে রোম গজিয়ে উঠছে ৷ " রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানার পরে ডাক্তারবাবুরা বুঝতে পারছেন, সঠিক রোগ নির্ণয় না করে ওষুধ দেওয়ার জেরে এই বিপত্তি দেখা দিচ্ছে ৷
IADVL-র রাজ্য সচিব বলেন, "এই ধরনের ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করেছেন এমন রোগী কলকাতার মেডিকেল কলেজগুলোর আউটডোরে প্রতিদিন আমরা দেখতে পাচ্ছি ৷ এক্ষেত্রে প্রশাসনের তরফে যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, দুর্ভাগ্যবশত তা হচ্ছে না ৷ প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি হবে না ৷ কিন্তু, প্রেসক্রিপশনই যদি গলদ হয়, কারণ যিনি প্রেসক্রিপশন লিখছেন, তিনি যদি ডাক্তার না হন, তাহলে সমস্যা তো বাড়বেই ৷ " যাঁর কাছে রোগী চিকিৎসা করাতে যাবেন, তিনি পাশ করা চিকিৎসক কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া জরুরি ৷ এই বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে সচেতনতা শিবির চালু করা হয়েছে ৷