কলকাতা, 8 জুন : বাতিল হয়ে গেল 2021-এর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ৷ বিশেষজ্ঞ কমিটির জমা দেওয়া রিপোর্ট ও জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার ৷ সোমবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান ৷ এক্ষেত্রে পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কী ভাবে হবে, সেই বিষয়ে আগামী সাত দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এর আগে সিবিএসসি ও আইসিএসসি বোর্ডের পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে ৷ করোনা আবহে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই এই পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ৷ যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে এই সিদ্ধান্ত পরীক্ষার্থীদের জীবনে ও মননে একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করবে।
মনোবিদ দেবাশিস সান্যাল মনে করেন, ‘‘পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়াটা পরীক্ষার্থীদের জীবনে একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ৷ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য পড়ুয়ারা অনেক আগের থেকেই প্রস্তুতি নেয় ৷ এই পরীক্ষা ঘিরে তাদের অনেক আশা-প্রত্যাশা থাকে ৷ পরীক্ষায় ভাল ফল করে সেই ফলের ভিত্তিতেই তারা তাদের আগামী জীবনের দিশা স্থির করে ৷’’
দেবাশিস সান্যালের বিশ্লেষণ, ‘‘স্কুলে এক পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হলেও পর্ষদের মূল্যায়ন পদ্ধতি একটু অন্য রকম ৷ তাই এ বছর যারা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক দিতে পারল না, তারা পর্ষদের মূল্যায়নের সুযোগ হারিয়ে ফেলল ৷ বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করে দেয়, একজন ছাত্র বা ছাত্রী ভবিষ্যতে কোন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করবে ৷ তাই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়াটা সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক ৷’’
আরও পড়ুন : Secondary and HS exam cancelled : বাতিল মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক, ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
তবে করোনা আবহ একটা ব্য়তিক্রমী ও আনকোরা পরিস্থিতি ৷ তাই সরকারের পদক্ষেপও অবান্তর নয় ৷ দেবাশিস মনে করেন, ‘‘একটা কথা আমাদের বুঝতে হবে, করোনা অত্যন্ত বিপজ্জনক আকার নিয়েছে ৷ কিন্তু পরীক্ষা দিতে না পারাটা পরীক্ষার্থীদের মনে দীর্ঘ রেখাপাত করবেই ৷ যদি কোনও পড়ুয়ার আগের পরীক্ষা ভাল না হয়ে থাকে, তাহলে সে আরও বেশি করে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিয়েছিল ৷ পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় সেই পড়ুয়ার মনে চাপ পড়বে ৷’’
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকার ও প্রশাসনের সমালোচনাও শোনা গিয়েছে মনোবিদের মুখে ৷ দেবাশিস বলেন, ‘‘নির্বাচন প্রক্রিয়া বা কুম্ভ মেলা করোনাকে ভয়াবহ আকার দিয়েছে ৷ এই অবস্থায় আরও একটা ঝুঁকিপূর্ণ ও ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না ৷ তাই কম বয়সীদের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ৷ তাছাড়া, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অল্প বয়সী ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে ৷ তাই পরীক্ষা দিতে গেলে এদের জীবন যে বিপন্ন হবে না, সেটা আমরা কীভাবে বলতে পারি ?’’ অন্যদিকে, গোটা ঘটনায় রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ৷ তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এই সিদ্ধান্তের ফলে সরকারের অস্থিরমতির পরিচয় পাওয়া গেল ৷ এতদিন সরকার স্পষ্ট একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না ৷ প্রথমে বলা হল, পরীক্ষা হবে ৷ তারপরে কমিটি তৈরি করা হল ৷ কমিটি পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে সুপারিশ করল ৷ তারপর আবার জনসাধারণের মতামত চাওয়া হল ! কমিটি ও জনসাধারণের মতামতের উপর ভিত্তি করেই পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার ৷’’
পবিত্র সরকার মনে করেন, ‘‘মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক দু’টোই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ৷ এই দুই পরীক্ষার ভিত্তিতেই পড়ুয়াদের মূল্যায়ন হয় এবং তারা একটি শংসাপত্র পায়। তারপর তারা নিজেদের পছন্দ মতো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে ৷ অনেকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য আবেদন করে ৷’’ পরীক্ষা বাতিলে পড়ুয়াদের সেই পথ কঠিন হল বলেই মনে করছেন বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ ৷
আরও পড়ুন : মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্তে বাড়ছে ক্ষোভ
তবে সরকারের অবস্থান যে একেবারে অযৌক্তিক নয়, সেটাও মানছেন পবিত্রবাবু ৷ তিনি বলেন, ‘‘সরকারের যুক্তি হল, জীবন পরীক্ষার থেকে বড় ৷ তবে আমার মনে হয়, এই বিষয়ে একটা সর্বভারতীয় নীতি হওয়া উচিত ৷ এই পরীক্ষার্থীরা যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে থাকবে তা তো নয়, এরা অন্যান্য রাজ্যেও যাবে ৷ তাই কেন্দ্র ও সবকটি রাজ্য সরকার মিলে এই বিষয়ে একটা সর্বভারতীয় নীতি প্রণয়ন করলে সব রাজ্যের ছেলে-মেয়েদের পক্ষেই সেটা সুবিধাজনক হত ৷’’