কলকাতা, 28 জুন : বাঁকা পা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে সন্তান । অনেক মা-বাবা মনে করেন, এই শিশু পোলিও আক্রান্ত । জন্মগত এই ত্রুটির কোনও চিকিৎসা নেই । যার জেরে অবহেলিত হয় এমন শিশুদের চিকিৎসা । বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পোলিও নয় ; এটা "ক্লাবফুট ডিসেবিলিটি" অর্থাৎ জন্মগত কারণে চক্রপদের শিশু । সঠিক চিকিৎসায় সেরে যায় এই অসুখ । এর চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । তা সত্ত্বেও, গোটা দেশকে এই ক্লাবফুট ডিসেবিলিটি থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা চলছে ।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্লাবফুট প্রোগ্রামের স্টেট নোডাল অফিসার, ডাক্তার উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় এবিষয়ে বলেন, "ক্লাবফুট, শিশুদের জন্মগত সমস্যা । ক্লাবফুট অর্থাৎ পা বাঁকা থাকে । ভিতরের দিকে ঘুরে থাকে বলে এটাকে বাংলায় অনেক সময় চক্রপদ বলা হয় ।" পরিসংখ্যান বলছে, যদি এক হাজার সুস্থ শিশুর জন্ম হয়, তার মধ্যে এক জন ক্লাবফুট নিয়ে জন্মায় । যত শিশু বিভিন্ন ধরনের বিকৃতি নিয়ে জন্মায়, তেমন ১০০ জনের মধ্যে আট জনের ক্লাবফুট থাকে ।
এই ধরনের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কেনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ডাক্তারদের? তিনি বলেন, "মা-বাবা অথবা যে কোনও ডাক্তার দেখে বুঝতে পারবেন পা ঠিক নেই । কিন্তু অসুবিধার জায়গা হল, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করাতে হয় এই ক্ষেত্রে । আমরা Ponseti Method-এ এই সমস্যার চিকিৎসা করি । এর জন্য প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিনে প্লাস্টার করাতে হয় । এরকমভাবে ছয় থেকে আট বার প্লাস্টার করার পরে, অনেক ক্ষেত্রে ছোটো একটি অস্ত্রোপচারও করতে হয় । এটার পরই শিশুর সুস্থ হয়ে যায় ।"
তবে সুস্থ হতে গেলে সঠিক সময় চিকিৎসা হওয়া দরকার । এবং চিকিৎসা সঠিক হওয়া দরকার । এবিষয়ে এক নোডাল অফিসার বলেন, "ক্লাবফুট নিয়ে জন্মানো আমরা বন্ধ করতে পারব না, কিন্তু ক্লাবফুট নিয়ে যে শিশুটির জন্ম হচ্ছে সে যেন ক্লাবফুট নিয়ে বেঁচে না থাকে । ভারত যেন ক্লাবফুট ফ্রি ইন্ডিয়া হয় । এটাই আমাদের লক্ষ্য।" এই Ponseti Method-এ চিকিৎসা আগে থেকেই চালু রয়েছে এরাজ্যে । সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবী একটি সংস্থা এই বিষয়ে সহযোগিতা করছে । কেন্দ্রীয় সরকারের RBSK (রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রম)-এর সঙ্গে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে প্রত্যেকটি মেডিকেল কলেজে একটি করে ক্লাবফুট চিকিৎসার ইউনিট করা হয়েছে ।
নির্দিষ্ট দিনে এই সব ইউনিটে বিনামূল্যে চিকিৎসা হয় । এ কথা জানিয়ে নোডাল অফিসার বলেন, "যে সব রোগীকে প্রতি সপ্তায় আসতে হয়, সেসব রোগীর অধিকাংশ মা-বাবার দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা । এই অবস্থায় প্রতি সপ্তাহে শিশুদের চিকিৎসার জন্য কোনও ক্ষেত্রে যদি কোনও সমস্যা হয়, তাহলে ওই সব শিশুর মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে, প্রয়োজন হলে বাড়িতে গিয়ে, যাতে কোনওভাবে চিকিৎসা মাঝ পথে বন্ধ না হয়ে যায়, তা এই সংস্থা করছে রাজ্য সরকার এবং RBSK-এর সহযোগিতায় ।"
বুধবার এই ক্লাবফুট ডিস্যাবিলিটির উপরে একটি কর্মশালার আয়োজন হয়েছিল NRS মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে । সেখানে ওই সংস্থার ডিরেক্টর ডাক্তার সন্তোষ জর্জ ETV ভারতকে বলেন, "ক্লাবফুট নিয়ে জন্ম হওয়া প্রতিটি শিশুর জন্য দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রতিটি রাজ্যের সঙ্গে কাজ করছে আমাদের এই সংস্থা । বিনামূল্যে কোনও অস্ত্রোপচার ছাড়া এই চিকিৎসা করা হয় । পশ্চিমবঙ্গে গত তিন বছর ধরে এই সব শিশুর চিকিৎসা আমরা করছি । খুব ভালোভাবে এগোচ্ছে এই কাজ ।" একই সঙ্গে তিনি বলেন, "পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে তিন বছর কাজ করার পরে, আগামী তিন বছরের জন্য পশ্চিমবঙ্গকে ক্লাবফুট ডিস্যাবিলিটি থেকে মুক্ত করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে । 11টি মেডিকেল কলেজে এখন এই পরিষেবা পাওয়া যাচ্ছে। আরও বেশি সংখ্যক শিশুর চিকিৎসা যাতে সম্ভব হয় তার জন্য আরও পাঁচটি সেন্টার আমরা চালু করতে চলেছি।"
বছর দুয়েক আগে গ্লোবাল ক্লাবফুট কনফারেন্সে ভারতের রাষ্ট্রপতি উপস্থিত ছিলেন । এ কথা জানিয়ে ডাক্তার সন্তোষ জর্জ বলেন, "এই কনফারেন্সে রাষ্ট্রপতি বলেছেন 2022-এর মধ্যে ক্লাবফুট ডিস্যাবিলিটি থেকে ভারতকে মুক্ত হতে হবে । 2019 থেকে 2022-র মধ্যে আমাদের লক্ষ্য, কোনও শিশু যেন ক্লাবফুটের চিকিৎসার বাইরে না থেকে যায় ।" এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে?
তিনি বলেন, "শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় । পুরো দেশেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে । ক্লাবফুটের চিকিৎসা বিষয়ক তথ্য মা-বাবার কাছে সহজলভ্য নয় বলে । অনেক মা-বাবা মনে করেন এই ধরনের শিশু পোলিও নিয়ে জন্মেছে । তাঁরা মনে করেন জন্মগত ত্রুটির কোনও চিকিৎসা নেই।"
সন্তোষবাবু আরও বলেন, "এটা পোলিও নয় । এটা ক্লাবফুট । এই তথ্য ভারতের প্রতিটি গ্রামে পৌঁছনো উচিত । তাহলে এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা আমরা করতে পারব । এবং আরও অনেক শিশুর চিকিৎসা শুরু করতে পারব ।" এই ধরনের সমস্যার সমাধান কী? তিনি বলেন, "ক্লাবফুট ডিস্যাবিলিটির বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য ন্যাশানাল মিশনের প্রয়োজন রয়েছে।"
কোন কারণে এই ধরনের সমস্যায় শিশুরা আক্রান্ত হয়?
ডাক্তার উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "জন্মগত এই ত্রুটির সঠিক কারণ জানা যায় না । অনেকটা জিনঘটিত কারণ । কিছু এনজাইন ঘটিত । অনেকগুলো কারণের কথা বলা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে বলা যায় না কোন কারণে এই সমস্যা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণ বোঝা যায় না।" চিকিৎসা শুরু হওয়ার কোনও সময় আছে? তিনি বলেন, "জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায়, সেটাই ভালো।"
চিকিৎসার জন্য সময় কত দিন লাগতে পারে? তিনি বলেন, "সাধারণত ছয় থেকে আট সপ্তাহ । এরপর দীর্ঘ দিন ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়। ঠিকঠাক হাঁটার বয়স বা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ডাক্তাররা এই ধরনের শিশুকে ফলোআপের মধ্যে রাখেন ।" এরপরে কোনও সমস্যা দেখা দিতে পারে? এই ডাক্তার বলেন, "এই চিকিৎসায় 90 শতাংশ শিশু সুস্থ হয়ে ওঠে। সুস্থ হওয়ার পরেও এই যে অনেকের আমরা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ফলোআপে রাখি একটা কারণে যে, কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায় ঠিক হয়ে গেল কিন্তু আবার কিছুদিন পরে বিকৃতি ফিরে আসছে । যদি সেটা ফিরে আসে তখন যাতে যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব হয় বা পরবর্তীকালে অন্য কোনও অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় কি না, এই জন্য দীর্ঘদিন ফলো আপের মধ্যে থাকতে হয় ।"
মেডিকেল কলেজগুলোতে এই ইউনিট চলছে তিন বছর ধরে । এই চিকিৎসা পদ্ধতি চিকিৎসক মহলে বহুদিন ধরে পরিচিত । কিন্তু অতটা জনপ্রিয় বা সব ডাক্তার এই পদ্ধতিকে মান্যতা দেননি । এই কথার পাশাপাশি নোডাল অফিসার জানিয়েছেন, 1990-এর শেষের দিকের সময় থেকে ডাক্তারদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে । এই শতকের প্রথম থেকে প্রায় সব ডাক্তার চিকিৎসার জন্য এই Ponseti Method-কে অবলম্বন করেছেন ।
এই রাজ্যে এই চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেমন কোনও সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে? ডাক্তার উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "সমস্যার অধিকাংশই ঠিকঠাক চিকিৎসা না হওয়ার জন্য । অনেক সময়, পরবর্তীকালে বিকৃতি ফিরে আসা, কখনও কখনও এমন হয়, যেহেতু এটা প্লাস্টার করে চিকিৎসা হয়, তার জন্য কিছু কিছু অসুবিধা হয় । প্লাস্টারের জন্য হয়তো কোথাও ছোট ঘা হয়ে গেল, আঙ্গুল ফুলে গেল, ব্যথা হয় অনেক সময়, অনেক সময় আঙ্গুলের রং বদলে যায় । যদি এমন কোনও সমস্যা হয়, মা-বাবাদের বোঝানো থাকে যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁরা যেন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । এতে সমস্যা সমাধান করা যায় ।"
এই চিকিৎসার বিষয়ে সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন?
ডাক্তার উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "বাচ্চার পা বাঁকা আছে প্রত্যেক মা-বাবাই চাইবেন ঠিক হোক । বহু কারণে দেখা যায় চিকিৎসা ঠিকঠাক হয়নি, অনেক বেশি বয়সে আবার চিকিৎসার জন্য আসতে দেখা যায়। আর্থিক কারণ থেকে শুরু করে এই চিকিৎসা পরিষেবার বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর যে সমস্যা আমাদের দেশে, এরাজ্যেও তা সত্যি । এই সংস্থার যোগদানের পড়ে যেটা হয়েছে, মা-বাবাকে অনেকটা মোটিভেট করা যাচ্ছে, যাতে চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা তাঁরা নেন ।"
একই সঙ্গে তিনি বলেন, "চিকিৎসা করলে সেরে যায়, এই ধারণাটা এখনও অনেকের মধ্যে নেই । চিকিৎসার ক্ষেত্রে মা-বাবার তরফে বাধা এসেছে, এমন ঘটনাও দু-একটি যে আমাদের চোখে আসেনি তা নয় । তাঁদের ধারণা, এ রকম পা নিয়ে জন্মেছে, ভগবান দিয়েছে কেন পালটাতে যাব । হয়তো তাঁরা মনে করছেন এটাকে পালটাতে গেলে শিশুর অন্য কোনও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে । এর জন্য সচেতনতা বাড়ানো দরকার । চিকিৎসা করাতে এসে অন্য কোনও বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।" লেদার কমপ্লেক্সের বাসিন্দা পিয়া মণ্ডল এবং মিরাজ মণ্ডল । পাঁচ মাসের পুত্রসন্তানকে নিয়ে NRS হাসপাতালে এসেছেন । পিয়া মণ্ডল বলেন, "জন্ম থেকে পা বাঁকা ছিল । আমরা চেষ্টা করছি যাতে ভালো হয়ে যায় ।" এই হাসপাতালেই তাঁদের সন্তানের জন্ম হয়েছে । জন্মের দু'মাস পর থেকেই শুরু হয়েছে চিকিৎসা ।