কলকাতা, ৬ সেপ্টেম্বর : বহু শতাব্দী আগে কারবালার প্রান্তরে খিলাফতের যুদ্ধ থেকেই শত্রুতা ও দ্বন্দ্বের সূত্রপাত । পরে ইরাক (Iraq) ও ইরান (Iran) সীমান্ত সমস্যা সেই দ্বন্দ্বে ঘি ঢালে । যা আজও বিদ্যমান । কিন্তু, 2020 সালের প্রথম দিকে আমেরিকার (USA) এয়ার স্ট্রাইকে বাগদাদে ইরানের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সুলেমানীর মত্যুতে পরিস্থিতির অনেকটাই বদল ঘটতে শুরু করেছে ।
শিয়া-সুন্নি (Shia-Sunni) প্রধান দুই মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে আমেরিকার মতো ‘শত্রুরাই’ নানা ভাবে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ । তাই, সেই সমস্যার সমাধান ঘটিয়ে মুসলিমদের একাট্টা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে । সোমবার কলকাতায় মৌলালি যুব কেন্দ্রে রাজ্যের একাধিক সুন্নি মুসলিম প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন ইরানের একাধিক শিয়া প্রতিনিধি ।
সেই আলোচনায় বার বার উঠে আসে যে ‘ইসলাম ফোবিয়া-শিয়া ফোবিয়া’ শত্রুদের প্রজেক্ট । শত্রুরাই বার বার কিছু মুসলিম গোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা ইস্যুতে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দেয় । সেই দ্বন্দ্বের কারণে, ভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে ইসলাম (Islam) ধর্মের বিষয়ে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে । যা আগামীতে আর হতে দেওয়া যাবে না বলেই শিয়া-সুন্নি উভয় প্রতিনিধিদের বক্তব্যে বার বার উঠে আসে ।
বক্তারা বার বার উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, "ইসলামে বা কোরআনে হিংসা হানাহানি, কাটাকাটি বা ঘৃণ্য চক্রান্তের কথা বলা নেই । বরং, এসবের বিরুদ্ধে শান্তির বার্তা দেওয়া এবং সমস্ত ধর্মের, সমস্ত জাতির মানুষকে ভালোবাসার কথা বলা আছে । কিন্তু দীর্ঘ কাল ধরে তার বিকৃতি হচ্ছে শত্রুপক্ষের দ্বারা । তাই, শত্রুপক্ষকে বার্তা দিয়েই সমস্ত মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে । নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের মতোই ইসলাম ধর্মের সংবিধান 'কোরআন'কে মেনে চলতে হবে ।"
এদিনের আলোচনায় শিয়া-সুন্নি ছাড়াও হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি, পারসিক, শিখ, ইসাই ইত্যাদি একাধিক ধর্মের প্রসঙ্গ ওঠে । ভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা থেকে শুরু করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মে কী বলা আছে, তারও উল্লেখ করা হয় । বক্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইসলাম ধর্মকে ভালবাসে এমন যে কোনও ভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যায় । তেমনই সমস্ত ধর্মের মানুষকে তাঁর নিজ, নিজ, ধর্মকে ভালোবাসা-পালনে কোনোরকম বাধা সৃষ্টি না করা, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধার কথা কোরআনে বলা আছে । তাই, মুসলিম কিংবা শিয়াদের বিরুদ্ধে যে, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ইসলাম ধর্মের কনভার্ট করার অভিযোগ ঠিক নয় । কারণ, ইসলামকে কেউ জোরপূর্বক গ্রহণ করাতে পারে না বলেও যুক্তি দেখান বক্তারা ।
শুধু ভিন্ন ধর্মের বিষয় নিয়ে আলোচনা নয়, শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে নমাজ, রোযা কিংবা একাধিক ইসলামিক রীতিনীতি পালনের যে তফাৎ রয়েছে সে বিষয়েও আলোচনা হয় । সেক্ষেত্রে, শিয়া-সুন্নি উভয়েই নিজ নিজ রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী ধর্মীয় অনুশাসনে থাকবেন । কিন্তু মূল লক্ষ্য থাকবে বিশ্বজুড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে যে ভুল বার্তা ভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, তা নিরসন করা । শিয়া-সুন্নি ঐক্যের মাধ্যমে শত্রুপক্ষকে কড়া জবাব দেওয়া । এমনটাই সেখানে আলোচনা হয়েছে ৷
বৈঠক শেষে ইরানের শিয়া প্রতিনিধি তথা সেক্রেটারি জেনারেল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ফোরাম ফর দ্য এপ্রক্সিমেশন অফ ইসলামিক রিলিজিয়ন্স ড. হামিদ শাহরিয়ারি ইটিভি ভারতকে বলেন, "আমরা ভারতীয় মুসলিমদের ইরানের তরফে ঐক্যবার্তা পৌঁছাতে এসেছি । পারস্পরিক ভুলভ্রান্তি দূর করে ইসলামের সুদূর ভবিষ্যৎ গড়তে । শত্রুপক্ষই বিশ্বজুড়ে ইসলামো ফোবিয়া ক্রিয়েট করেছে । কিন্তু, আদতে ইসলাম হল শান্তি, সম্প্রীতি, ক্ষমা ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম । প্রত্যেক ধর্মকে সম্মান করে, ভালোবাসে । কিন্তু ইসলামো ফোবিয়ার মাধ্যমে ভুল বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে । ইরান বরাবরই আমেরিকা এবং চীনের মতো সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে । তাই তারা সর্বদা চেষ্টা করে চলেছে শিয়া তথা ইরানকে ধর্মীয় হিংসার রূপ দিতে ।"
কলকাতার এই আলোচনা বৈঠকের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা জমিয়ত উলেমায়ে হিন্দের নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী । তিনি ইটিভি ভারতকে বলেন, "শিয়া, সুন্নি, আহলে হাদিস, দেওবন্দের মতো যত জনগোষ্ঠী ইসলামের মধ্যে আছে তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যই ইরান থেকে প্রতিনিধি এসেছেন । ঠিক তেমনি অমুসলিমদের সঙ্গে ভালো, সুন্দর ব্যবহারের কথা কোরআনে বলা আছে । যে ইসলামে ফোবিয়া, তা ক্রিয়েট করা ।"
আরও পড়ুন : 'তিনি আমার বাবার মতো ছিলেন...', হিন্দু কর্মচারীর শব বহনের পর মন্তব্য মুসলিম ব্যবসায়ীর