কলকাতা, 2 অক্টোবর: অবিভক্ত বঙ্গভূমের পাবনা জেলায় ছিল স্থলবসন্তপুর ৷ সেই স্থলবসন্তপুরের প্রথম জমিদার হরিদেব ভট্টাচার্য ৷ তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কালীসাধক এবং পণ্ডিত মানুষ ৷ তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েই রানি ভবানী তাঁকে স্থলবসন্তপুরের জমিদারি দান করেছিলেন ৷ কথিত আছে, স্বপ্নাদেশ পেয়েই কৃষ্ণবর্ণা দশভূজার (Black Idol of Durga) আরাধনা শুরু করেছিলেন তিনি ৷ সেটা ছিল 1730 সাল ৷ সেই ঐতিহ্য আজও অব্যাহত ৷ তবে, এখন আর পাবনায় পুজো হয় না ৷ আসানসোল ঘুরে ভট্টাচার্য পরিবারের বর্তমান ঠিকানা কলকাতার বেলেঘাটা ৷ কৃষ্ণবর্ণা দেবী দুর্গা এখন পূজিতা হন এখানেই (Durga Puja 2022) ৷
পরিবারের বর্তমান সদস্য কৃষ্ণা ভট্টাচার্য জানালেন, দশভূজার একটি স্বপ্ন বহুবার দেখেছিলেন হরিদেব ৷ দেবী তাঁকে দেখা দেন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রূপে ৷ আদেশ দেন, এই রূপেই তাঁর পুজো শুরু করার ৷ ধর্মপ্রাণ মানুষটি পড়েন আতান্তরে ৷ কৃষ্ণবর্ণা দুর্গার অস্তিত্ব তাঁর জানা ছিল না ৷ অগত্যা হরিদেব ভট্টাচার্য শরণাপন্ন হন পাবনার পুরোহিতকুলের ৷ কিন্তু, তাঁরাও কালীভক্ত জমিদারকে দিশা দেখাতে ব্যর্থ হন ৷ সেই সময় এই বঙ্গদেশের যোগাযোগ মোটেও উন্নত ছিল না ৷ তবুও মায়ের টানে হরিদেব পৌঁছে যান নৈহাটির ভাটপাড়ায় ৷ কিন্তু, সেখানকার টোলের পণ্ডিতদের ব্যাখ্যাও তাঁর মনঃপুত হয়নি ৷
আরও পড়ুন: পুজোয় গঙ্গাবক্ষে ফিরল ব্রিটিশ আমলের প্যাডেল স্টিমার
শেষমেশ হরিদেব পাড়ি দেন কাশী ধামে ৷ আশাহত হন সেখানেও ৷ তাবড় সাধু, সন্তরাও কৃষ্ণবর্ণা দেবী দুর্গার স্বপ্নের কোনও যুৎসই ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ৷ এই অবস্থায় একরাশ মন খারাপ নিয়ে একদিন কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে বসেছিলেন হরিদেব ৷ সেই সময়েই এক সাধু কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই আগন্তুকের চিন্তার কারণ জানতে চান ৷ পথের হদিশও দেন সেই সাধুই ! তিনি জানান, চণ্ডীপাঠেই দুর্গার কৃষ্ণবর্ণের উল্লেখ রয়েছে ৷ এরপর পাবনায় ফিরে সেই সাধুর বিধান মেনেই কৃষ্ণবর্ণ দুর্গার পুজো শুরু করেন হরিদেব ৷ তবে মহামায়া কৃষ্ণবর্ণা হলেও একচালার প্রতিমায় তাঁর চার সন্তানের গায়ের রঙে কোনও আলাদা বিশেষত্ব নেই ৷
বেলেঘাটা জোড়া মন্দিরের কাছে 35 নম্বর বাসস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রামকৃষ্ণ নস্কর লেনের বাসিন্দা ভট্টাচার্য পরিবার (Bhattacharya Family of Beleghata) এখনও প্রাচীন প্রথা মেনেই কৃষ্ণবর্ণা দশভূজার পুজো করে ৷ হরিদেবের ঐতিহ্য পালন করেন তাঁর উত্তরসূরি সুবোধ ভট্টাচার্য ৷ পারিবারিক রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতেই পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পুজোর নিয়ম শিখেছিলেন তিনি ৷ এই পুজোর জন্য রয়েছে বিশেষ মন্ত্র ৷ সেই মন্ত্র লেখা রয়েছে বহু প্রাচীন এক তালপাতার পুঁথিতে ৷ যা আজও রক্ষিত রয়েছে ভট্টাচার্য পরিবারের কাছে ৷
কৃষ্ণা জানালেন, পাবনা থেকে ছিন্নমূল হওয়ার পর এক সময় তাঁদের ঠাঁই হয় আসানসোলের ভাড়া বাড়িতে ৷ তারও পরে বেলেঘাটার ফ্ল্য়াটে উঠে আসে ভট্টাচার্য পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম ৷ আপাতত এখানেই এক ফালি জায়াগায়, প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণারা ৷ মায়ের কৃপায় অগাধ বিশ্বাস রয়েছে তাঁর ৷ বললেন, ভবানীর আশীর্বাদ না থাকলে এই পুজো চালিয়ে যাওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হত না ৷ গত প্রায় তিন শতাব্দীতে একাধিকবার পুজো স্থান বদলালেও আজ পর্যন্ত কোনও বছরই পুজো বন্ধ হয়নি ৷ প্রতিমার আকার ছোট হলেও আচারে কোনও কাটছাঁট করা হয়নি ৷ তবে, এই বাড়ির প্রতিমা উত্তর কলকাতার কুমোরটুলিতে নয়, তৈরি হয় দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাটের পটুয়াপাড়ায় ৷ পঞ্চমী তিথিতে উমাকে সেখান থেকে ঘরে নিয়ে আসা হয় ৷ মায়ের নিরঞ্জন হয় দশমীতে ৷