ETV Bharat / city

কেমন ছিল প্রাণের পুজো ? স্মৃতিসুধায় ডুব

জনপদ বরাহনগরের প্রাচীন পুজোর কথা উঠে এল কথায় কথায় ৷ কৃষ্ণনগর, অ্যামেরিকা আর বলাকাপুরের পুজোর কথাও বললেন ওঁরা ৷ নিজেদের ফেলে আসা দুর্গাপুজোর স্মৃতিতে ডুব দিলেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও কবি সুবোধ সরকার ৷

author img

By

Published : Oct 25, 2020, 9:18 PM IST

Updated : Oct 25, 2020, 10:33 PM IST

recollecting-their-memories-of-durga-puja
recollecting-their-memories-of-durga-puja

আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ফেলে আসা দিনের পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও কবি সুবোধ সরকার ।

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

recollecting-their-memories-of-durga-puja
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমি যে অঞ্চলে বড় হয়েছি তা ছিল কলকাতার কাছেই একটি প্রাচীন গ্রাম ৷ গ্রামটির নাম বরাহনগর ৷ একেবারে গঙ্গার উপর ৷ বিপরীত দিকে বেলুড়মঠ ৷ জায়গাটি ছোটো হলেও প্রচুর ইতিহাস ৷ বহু বিশিষ্ট মানুষ এখানে বসবাস করেছেন ৷ একসময় কলকাতার ঠাকুর পরিবারের সারি সারি বাগানবাড়ি ছিল গঙ্গার ধারে ৷ এখনও আছে, মৃয়মান অবস্থায় ৷

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কলকাতার জয়নারায়ণ মিত্র ৷ তিনি এখানে উদ্যান সমন্বিত একটি কালীবাড়ি স্থাপন করেছিলেন ৷ এখনও আছে ৷ এই কালীবাড়ি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি থেকেও 5 বছরের প্রাচীন ৷ এই কালীবাড়িতে একসময় স্বামী বালানন্দজি (স্বামী মোহনানন্দজির গুরু ৷ মস্ত বড় সাধক ৷ দেওঘরে যাঁর তপোবন ৷) থাকতেন ৷ তখন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের খ্যাতনামা সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন ৷ আবার মাইকেল মধুসূদন দত্তও এই কালীবাড়ির গেস্ট হাউজ়ে ছিলেন ৷ এইখানেই তিনি গঙ্গায় স্নান করে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বলেছিলেন, আজ থেকে আমি হিন্দু হলাম ৷ এইরকম একটি জায়গায় আমার বড় হওয়া ৷ একদিকে শিক্ষিত মানুষ, ধনী মানুষ, যাঁদের মধ্যে একাধিক রায়বাহাদুর ৷ আরেক দিকে সাধারণ বৃত্তিজীবী প্রান্তিক মানুষের দল ৷ এখানে সাধনসমরের মহর্ষি সত্যদেব একটি আশ্রম স্থাপন করেছিলেন ৷ এদের দুর্গাপুজোর পদ্ধতি ছিল অসাধারণ ৷ সন্ধিপুজোর পূর্বে তিনি নিজে হাতে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে মাকে স্নান করাতেন ৷ অলৌকিকত্ব এইখানেই যে মাটির তৈরি প্রতিমা কিন্তু গলে যেত না ৷ এই পূজায় পূজারী ও দর্শনার্থীর মধ্যে কোনও ভেদ থাকত না ৷ সকলেই একসঙ্গে পূজায় বসতেন ৷ সমবেত মন্ত্র উচ্চারণ ও সংগীত হত ৷ এই পূজাটি দেখার জন্যে মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকতেন ৷ এই পূজাটিই ছিল বলবার-কইবার মতো ৷ এছাড়াও প্রাচীন ঐশ্বর্যশালী পরিবারগুলির পারিবারিক পূজা তো ছিলই ৷ পূজা হত নাটমন্দিরে ৷

আমার ছেলেবেলায় যুগ যখন আধুনিক হচ্ছে ক্রমশ, তখনই সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হল ৷ এবং একটা মজার কথা, দুটি আকর্ষণীয় বড় পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন দুই শিল্পপতি ৷ একটি পূজা হত বেঙ্গল ইমিউনিটিতে (ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতিষ্ঠিত ওষুধ তৈরির কম্পানি ৷) ভ্যাকসিন তৈরির জন্যে বিখ্যাত হয়েছিল ৷ শত শত কর্মী কাজ করতেন ৷ এদের ছিল বিরাট কারখানা এবং আবাসন ৷ যা আজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে ৷ স্থানীয় মানুষ এই বেদনা এখনও ভুলতে পারেনি ৷ আরেকটি পুজো হত সর্বমঙ্গলা অয়েল মিলে ৷ প্রতিমাটি ছিল মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু ৷ সে এক ভয়াবহ ব্যাপার !

ক্রমে প্রতিটা পাড়াতেই বারোয়ারি পূজা শুরু হল ৷ এল প্রতিযোগিতা ৷ দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানষ তাঁদের সংস্কৃতিও নিয়ে এলেন সঙ্গে করে ৷ ঢাকিদের ঢাকবাদ্যের ভঙ্গি পালটে গেল ৷ এল ধুনুচি নৃত্য ৷ সেইসঙ্গে পল্লিগীতি ৷ প্রয়াত নির্মলেন্দুবাবুও কয়েকবার এখানে এসে অনুষ্ঠান করেছেন ৷ ক্রমশ ক্রমশ পুজোর ধরন পালটালেও ভক্তি ও পবিত্রতার অভাব ঘটেনি ৷ মা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন ৷ এখনকার মতো থিম পুজোর আড়ালে চলে যায়নি ! সেই পুজোতে মাটির গন্ধ মাখা শিশিরবিন্দুতে ভেজা অদ্ভুত একটা ভক্তির ভাব প্রকাশ পেত ৷ ধুনোর গন্ধ মাখা একটা শারদ সুবাস নাকে নয়, মনে এসে লাগত ৷ আমাদের মতো কিশোররা রাতের ঘুমে মাকে স্বপ্ন দেখত- মা তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে সবুজ মাঠের কাশফুলের আড়ালে আড়ালে খেলা করছেন ৷ খিল খিল করে হাসছেন ৷ গঙ্গার কূলে নৌকাটি বাঁধা আছে ৷ দিনু মাঝির সেই বিখ্যাত নৌকা ৷ যেটি করে তিনি এসেছেন, আবার চলেও যাবেন ৷ আমি আর আমার বন্ধু অনাথ পুজোয় যে একজোড়া প্যান্ট-শার্ট হয়েছে, মা চলে যাওয়ার পর সেটি আর পরতুম না ৷ অনাথ বলত, খুলে রেখে দে ৷ মা চলে গেছেন, আর এসব পরে কী হবে ! আমার দিদি তখন বলত, এগুলো না পরলে পুরোনো হবে কী করে ? পরের বছর মা এলে তো আবার নতুন পরতে হবে ৷ অনাথ তখন বিজ্ঞের মতো বলত, কথাটা খুব ঠিক রে ৷ সূর্য যেমন পূব থেকে পশ্চিমে যায়, উদয় থেকে অস্ত ৷ চিরকালের জন্য তো চলে যায় না ! মা-ও সেইরকম ৷ নদীর এপার আর ওপার ৷ আশা আর যাওয়া ৷

দুর্গাপূজা মানে নারকেল নাড়ু ৷ সেই গোটাকতক হাতে নিয়ে ছলছল চোখে গঙ্গার ঘাটে বসে আছি ৷ মায়ের কাঠামোটা তীরের একপাশে উঁচু হয়ে আছে ৷ কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবে পটুয়া পাড়ায় ৷ মাটির মা জলে গলে গেছেন ৷ অনাথ বিজ্ঞের মতো বলল, গলে গেছেন কিন্তু মরে যাননি ! তাছাড়া আর তো বেশি মন খারাপের সুযোগ নেই ৷ মা তো এবার কালী হয়ে আসবেন কয়েকদিন পরে ৷ চল চল সোরা-গন্ধক-কাঠকয়লা রোদে শুকিয়ে গুড়িয়ে মিশিয়ে তুবড়ি করতে হবে তুবড়ি ৷ আর তো কদিন পরেই ৷ ইস্কুল তো খুলতে দেরি আছে ৷ দু'জনে হারিয়ে গেলাম বাজি তৈরি করার খাটুনিতে ৷ মাটিতে তুবড়ি, আকাশে হাউই ৷ উড়ন তুবড়ি ৷ কোথাও কোনও ফ্ল্যাট নেই ৷ ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে হিংসা নেই ৷ বড় বড় সব মাঠ ৷ অন্ধকার অন্ধকার রহস্যময় গলি ৷ বৃষ্টি হলে প্রচুর ব্যাঙ তখনও ডাকত ডোবায় ডোবায় ৷ সভ্যতার চাপে অসভ্য শেয়ালগুলো পিছু হটতে হটতে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল ! স্কুলের মাঠের বেলগাছটা কবেই কাটা পড়েছে ! সন্ধ্যার বুকে ওই গাছের তলায় একজোড়া শেয়াল দম্পতি এসে ডাকাডাকি করত । আমাদের সতর্ক করে দিত ! বাড়ি যাও, পড়তে বোসো ৷

সেই বোধন, সেই কলা বউয়ের স্নান ৷ সেই বিজয়া দশমী ৷ ঘুঘনি ও নারকেল নাড়ু ৷ বড়দের জন্য একচুমুক সিদ্ধি ৷ আগমনী ও নিরঞ্জনের গান ৷ দেখা হলেই কোলাকুলি ৷ সে সব কোথায় হারিয়ে গেছে ! দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না ! মা সব জানেন ৷ সহ্য করাই তাঁর ধর্ম ৷

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় কবি সুবোধ সরকার

recollecting-their-memories-of-durga-puja
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় কবি সুবোধ সরকার

পুজোর অনেক স্মৃতি । আমি বড় হয়েছি কৃষ্ণনগরে । সেখানে পুজো হত বিরাট করে । এক পাড়ার সঙ্গে আর এক পাড়ার মারপিট হত । মাঝে মাঝে বডি পড়ে যেত । প্রতি বছর আলোচনার বিষয় হত কে পড়বে আর কে ফেলবে । ভাসানের দিন একশো দুশো তিনশো ঢাক নিয়ে লড়াই হত । ঘরে বসে ঢাক শুনে আমি বুঝতে পারতাম কে যাচ্ছে হাতারপাড়া না গোলাপট্টি ?

অ্যামেরিকার পুজোয় দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল হাসব না কাঁদব ? সপ্তমী অষ্টমী নবমী সব একদিনে । সেটা উইকএন্ড । শনিবার । পরের দিন ভাসান । তাড়াতাড়ি কেননা সোমবার থেকে অফিস ।

বলাকাপুর নামে একটি গ্রামে একবার পুজো কাটিয়েছিলাম । খুব গরিব গ্রাম । সেখানে দেখেছিলাম দুর্গাকে বাতাসা দেওয়া হয় । আমি গ্রামের একজন মাথাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুর্গা কি বাতাসা খায় ? তিনি বললেন, "কেন খাবে না ? আমরা যা দেব, ভালোবেসে দেব, কেন খাবে না ? উমা ওরকম মেয়ে নয় । এখনকার মেয়েদের মতো নয়, বাবার গলায় গামছা দিয়ে জিনস-চুড়িদার-শাড়ি সব আদায় করবে' ! আমি বলাকাপুরে তিনদিন ছিলাম । ওই দারিদ্রের মধ্যে, নির্জনতার মধ্যে, নিঃস্ব বাতাসার মধ্যে যে শান্তি পেয়েছিলাম সেই রকম ভালোলাগা আর কোথাও পাইনি ।

আমি যদি বেঁচে থাকি মহামারি পার হয়ে তবে একবার আমি ওই বলাকাপুর যেতে চাই । ওখানে গিয়ে তিনটে দিন চুপচাপ বসে থাকব ।

আজকের মতো থিম পুজোর ভিড় তখন একেবারে ছিল না । কেমন ভাবে কাটত তখনকার পুজো ? নিজেদের ফেলে আসা দিনের পুজোর স্মৃতি ETV ভারতের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ও কবি সুবোধ সরকার ।

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

recollecting-their-memories-of-durga-puja
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

আমি যে অঞ্চলে বড় হয়েছি তা ছিল কলকাতার কাছেই একটি প্রাচীন গ্রাম ৷ গ্রামটির নাম বরাহনগর ৷ একেবারে গঙ্গার উপর ৷ বিপরীত দিকে বেলুড়মঠ ৷ জায়গাটি ছোটো হলেও প্রচুর ইতিহাস ৷ বহু বিশিষ্ট মানুষ এখানে বসবাস করেছেন ৷ একসময় কলকাতার ঠাকুর পরিবারের সারি সারি বাগানবাড়ি ছিল গঙ্গার ধারে ৷ এখনও আছে, মৃয়মান অবস্থায় ৷

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কলকাতার জয়নারায়ণ মিত্র ৷ তিনি এখানে উদ্যান সমন্বিত একটি কালীবাড়ি স্থাপন করেছিলেন ৷ এখনও আছে ৷ এই কালীবাড়ি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি থেকেও 5 বছরের প্রাচীন ৷ এই কালীবাড়িতে একসময় স্বামী বালানন্দজি (স্বামী মোহনানন্দজির গুরু ৷ মস্ত বড় সাধক ৷ দেওঘরে যাঁর তপোবন ৷) থাকতেন ৷ তখন পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের খ্যাতনামা সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন ৷ আবার মাইকেল মধুসূদন দত্তও এই কালীবাড়ির গেস্ট হাউজ়ে ছিলেন ৷ এইখানেই তিনি গঙ্গায় স্নান করে ধুতি পাঞ্জাবি পরে বলেছিলেন, আজ থেকে আমি হিন্দু হলাম ৷ এইরকম একটি জায়গায় আমার বড় হওয়া ৷ একদিকে শিক্ষিত মানুষ, ধনী মানুষ, যাঁদের মধ্যে একাধিক রায়বাহাদুর ৷ আরেক দিকে সাধারণ বৃত্তিজীবী প্রান্তিক মানুষের দল ৷ এখানে সাধনসমরের মহর্ষি সত্যদেব একটি আশ্রম স্থাপন করেছিলেন ৷ এদের দুর্গাপুজোর পদ্ধতি ছিল অসাধারণ ৷ সন্ধিপুজোর পূর্বে তিনি নিজে হাতে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে মাকে স্নান করাতেন ৷ অলৌকিকত্ব এইখানেই যে মাটির তৈরি প্রতিমা কিন্তু গলে যেত না ৷ এই পূজায় পূজারী ও দর্শনার্থীর মধ্যে কোনও ভেদ থাকত না ৷ সকলেই একসঙ্গে পূজায় বসতেন ৷ সমবেত মন্ত্র উচ্চারণ ও সংগীত হত ৷ এই পূজাটি দেখার জন্যে মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকতেন ৷ এই পূজাটিই ছিল বলবার-কইবার মতো ৷ এছাড়াও প্রাচীন ঐশ্বর্যশালী পরিবারগুলির পারিবারিক পূজা তো ছিলই ৷ পূজা হত নাটমন্দিরে ৷

আমার ছেলেবেলায় যুগ যখন আধুনিক হচ্ছে ক্রমশ, তখনই সর্বজনীন দুর্গাপূজা শুরু হল ৷ এবং একটা মজার কথা, দুটি আকর্ষণীয় বড় পূজার উদ্যোক্তা ছিলেন দুই শিল্পপতি ৷ একটি পূজা হত বেঙ্গল ইমিউনিটিতে (ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতিষ্ঠিত ওষুধ তৈরির কম্পানি ৷) ভ্যাকসিন তৈরির জন্যে বিখ্যাত হয়েছিল ৷ শত শত কর্মী কাজ করতেন ৷ এদের ছিল বিরাট কারখানা এবং আবাসন ৷ যা আজ পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে ৷ স্থানীয় মানুষ এই বেদনা এখনও ভুলতে পারেনি ৷ আরেকটি পুজো হত সর্বমঙ্গলা অয়েল মিলে ৷ প্রতিমাটি ছিল মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত উঁচু ৷ সে এক ভয়াবহ ব্যাপার !

ক্রমে প্রতিটা পাড়াতেই বারোয়ারি পূজা শুরু হল ৷ এল প্রতিযোগিতা ৷ দেশ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানষ তাঁদের সংস্কৃতিও নিয়ে এলেন সঙ্গে করে ৷ ঢাকিদের ঢাকবাদ্যের ভঙ্গি পালটে গেল ৷ এল ধুনুচি নৃত্য ৷ সেইসঙ্গে পল্লিগীতি ৷ প্রয়াত নির্মলেন্দুবাবুও কয়েকবার এখানে এসে অনুষ্ঠান করেছেন ৷ ক্রমশ ক্রমশ পুজোর ধরন পালটালেও ভক্তি ও পবিত্রতার অভাব ঘটেনি ৷ মা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই ছিলেন ৷ এখনকার মতো থিম পুজোর আড়ালে চলে যায়নি ! সেই পুজোতে মাটির গন্ধ মাখা শিশিরবিন্দুতে ভেজা অদ্ভুত একটা ভক্তির ভাব প্রকাশ পেত ৷ ধুনোর গন্ধ মাখা একটা শারদ সুবাস নাকে নয়, মনে এসে লাগত ৷ আমাদের মতো কিশোররা রাতের ঘুমে মাকে স্বপ্ন দেখত- মা তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে সবুজ মাঠের কাশফুলের আড়ালে আড়ালে খেলা করছেন ৷ খিল খিল করে হাসছেন ৷ গঙ্গার কূলে নৌকাটি বাঁধা আছে ৷ দিনু মাঝির সেই বিখ্যাত নৌকা ৷ যেটি করে তিনি এসেছেন, আবার চলেও যাবেন ৷ আমি আর আমার বন্ধু অনাথ পুজোয় যে একজোড়া প্যান্ট-শার্ট হয়েছে, মা চলে যাওয়ার পর সেটি আর পরতুম না ৷ অনাথ বলত, খুলে রেখে দে ৷ মা চলে গেছেন, আর এসব পরে কী হবে ! আমার দিদি তখন বলত, এগুলো না পরলে পুরোনো হবে কী করে ? পরের বছর মা এলে তো আবার নতুন পরতে হবে ৷ অনাথ তখন বিজ্ঞের মতো বলত, কথাটা খুব ঠিক রে ৷ সূর্য যেমন পূব থেকে পশ্চিমে যায়, উদয় থেকে অস্ত ৷ চিরকালের জন্য তো চলে যায় না ! মা-ও সেইরকম ৷ নদীর এপার আর ওপার ৷ আশা আর যাওয়া ৷

দুর্গাপূজা মানে নারকেল নাড়ু ৷ সেই গোটাকতক হাতে নিয়ে ছলছল চোখে গঙ্গার ঘাটে বসে আছি ৷ মায়ের কাঠামোটা তীরের একপাশে উঁচু হয়ে আছে ৷ কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবে পটুয়া পাড়ায় ৷ মাটির মা জলে গলে গেছেন ৷ অনাথ বিজ্ঞের মতো বলল, গলে গেছেন কিন্তু মরে যাননি ! তাছাড়া আর তো বেশি মন খারাপের সুযোগ নেই ৷ মা তো এবার কালী হয়ে আসবেন কয়েকদিন পরে ৷ চল চল সোরা-গন্ধক-কাঠকয়লা রোদে শুকিয়ে গুড়িয়ে মিশিয়ে তুবড়ি করতে হবে তুবড়ি ৷ আর তো কদিন পরেই ৷ ইস্কুল তো খুলতে দেরি আছে ৷ দু'জনে হারিয়ে গেলাম বাজি তৈরি করার খাটুনিতে ৷ মাটিতে তুবড়ি, আকাশে হাউই ৷ উড়ন তুবড়ি ৷ কোথাও কোনও ফ্ল্যাট নেই ৷ ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে হিংসা নেই ৷ বড় বড় সব মাঠ ৷ অন্ধকার অন্ধকার রহস্যময় গলি ৷ বৃষ্টি হলে প্রচুর ব্যাঙ তখনও ডাকত ডোবায় ডোবায় ৷ সভ্যতার চাপে অসভ্য শেয়ালগুলো পিছু হটতে হটতে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল ! স্কুলের মাঠের বেলগাছটা কবেই কাটা পড়েছে ! সন্ধ্যার বুকে ওই গাছের তলায় একজোড়া শেয়াল দম্পতি এসে ডাকাডাকি করত । আমাদের সতর্ক করে দিত ! বাড়ি যাও, পড়তে বোসো ৷

সেই বোধন, সেই কলা বউয়ের স্নান ৷ সেই বিজয়া দশমী ৷ ঘুঘনি ও নারকেল নাড়ু ৷ বড়দের জন্য একচুমুক সিদ্ধি ৷ আগমনী ও নিরঞ্জনের গান ৷ দেখা হলেই কোলাকুলি ৷ সে সব কোথায় হারিয়ে গেছে ! দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না ! মা সব জানেন ৷ সহ্য করাই তাঁর ধর্ম ৷

দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় কবি সুবোধ সরকার

recollecting-their-memories-of-durga-puja
দুর্গাপুজোর স্মৃতিচারণায় কবি সুবোধ সরকার

পুজোর অনেক স্মৃতি । আমি বড় হয়েছি কৃষ্ণনগরে । সেখানে পুজো হত বিরাট করে । এক পাড়ার সঙ্গে আর এক পাড়ার মারপিট হত । মাঝে মাঝে বডি পড়ে যেত । প্রতি বছর আলোচনার বিষয় হত কে পড়বে আর কে ফেলবে । ভাসানের দিন একশো দুশো তিনশো ঢাক নিয়ে লড়াই হত । ঘরে বসে ঢাক শুনে আমি বুঝতে পারতাম কে যাচ্ছে হাতারপাড়া না গোলাপট্টি ?

অ্যামেরিকার পুজোয় দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল হাসব না কাঁদব ? সপ্তমী অষ্টমী নবমী সব একদিনে । সেটা উইকএন্ড । শনিবার । পরের দিন ভাসান । তাড়াতাড়ি কেননা সোমবার থেকে অফিস ।

বলাকাপুর নামে একটি গ্রামে একবার পুজো কাটিয়েছিলাম । খুব গরিব গ্রাম । সেখানে দেখেছিলাম দুর্গাকে বাতাসা দেওয়া হয় । আমি গ্রামের একজন মাথাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুর্গা কি বাতাসা খায় ? তিনি বললেন, "কেন খাবে না ? আমরা যা দেব, ভালোবেসে দেব, কেন খাবে না ? উমা ওরকম মেয়ে নয় । এখনকার মেয়েদের মতো নয়, বাবার গলায় গামছা দিয়ে জিনস-চুড়িদার-শাড়ি সব আদায় করবে' ! আমি বলাকাপুরে তিনদিন ছিলাম । ওই দারিদ্রের মধ্যে, নির্জনতার মধ্যে, নিঃস্ব বাতাসার মধ্যে যে শান্তি পেয়েছিলাম সেই রকম ভালোলাগা আর কোথাও পাইনি ।

আমি যদি বেঁচে থাকি মহামারি পার হয়ে তবে একবার আমি ওই বলাকাপুর যেতে চাই । ওখানে গিয়ে তিনটে দিন চুপচাপ বসে থাকব ।

Last Updated : Oct 25, 2020, 10:33 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.