কলকাতা, 10 অগস্ট: স্বাধীনতার 75 বছর পূর্তি (75 Years of Independence) উপলক্ষে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' (Azadi Ka Amrit Mahotsav) ৷ গত 75 বছরে অনেক লড়াই লড়তে হয়েছে ভারতবাসীকে ৷ এসেছে বহু সাফল্য ৷ এক্ষেত্রে ভারতীয় সাহিত্য অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি পরিসর ৷ সেখানে বাংলার অবদান অনস্বীকার্য ৷ বাঙালি লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের গত 75 বছরের সাফল্য়ের খতিয়ান তুলে ধরতে গেলে হয়তো শব্দভাণ্ডারও কম পড়বে ! এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রটিতে নারীদের অবদানও অনস্বীকার্য ৷ কিন্তু, বাঙালি মহিলা সাহিত্যিকদের সংখ্য়াও নেহাত কম নয় ৷ তাঁদের সকলকে নিয়ে একটিমাত্র উপস্থাপনায় আলোচনা সম্পূর্ণ করা কার্যত অসম্ভব ৷ তাই প্রবীণ ও নবীনের সমন্বয়ে এমন দু'জনকে বেছে নেওয়ার চেষ্টা আমরা করব, যাঁদের কলম সারা বিশ্বের সামনে বাঙালির মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে ৷
এঁদের প্রথমজন হলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ মহাশ্বেতা দেবী (Mahasweta Devi) ৷ 1926 সালের 14 জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে জন্ম হয়েছিল মহাশ্বেতার ৷ ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি ৷ সাহিত্য ছিল তাঁর রক্তে ৷ তাঁর বাবা মণীশ ঘটকও ছিলেন কবি ও সাহিত্যিক ৷ কল্লোল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি ৷ যুবনাশ্ব ছদ্মনামে লিখতেন মণীশ ৷ তাঁর ভাই, অর্থাৎ মহাশ্বেতার কাকা ছিলেন প্রখ্য়াত চলচিত্রকার ঋত্ত্বিক ঘটক ৷ এমনকী, মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন স্বনামধন্য লেখিকা ৷ লেখালেখির পাশাপাশি পরাধীন ভারতে বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি ৷
আরও পড়ুন: 75 Years of Independence Day: স্বাধীনতা আন্দোলনে বামেদের অবদান তুলে ধরতে একাধিক কর্মসূচি সিপিআইএমের
জীবনের শুরুর বছরগুলি ঢাকাতেই কেটেছিল ছোট্ট মহাশ্বেতার ৷ 1930 সালে সেখানকার ইডেন মন্টেসরি স্কুলে তাঁর হাতেখড়ি হয় ৷ এর পাঁচ বছর পর মেদিনীপুর মিশন গার্লস হাইস্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে ৷ তত দিনে ঘটক পরিবার ঢাকা থেকে এ পার বাংলায় চলে এসেছে ৷ এর একবছরের মাথায় শান্তিনিকেতনে পঠনপাঠন শুরু হয় মহাশ্বেতার ৷ সেখান তিনি ছিলেন 1938 সাল পর্যন্ত ৷ পরবর্তীতে (1941 সাল) বেলতলা গার্লস স্কুল থেকে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন কিশোরী মহাশ্বেতা ৷ এরপর আশুতোষ কলেজ থেকে আইএ এবং বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক হন ৷ একই বিষয় নিয়ে স্নাতকোত্তরের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে ৷
পরাধীন ভারতে মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার ছিল নগণ্য ৷ সেখানে নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ছিলেন মহাশ্বেতা ৷ তার উপর তাঁর পারিবারিক আবহ তাঁকে রাজনৈতিকভাবেও একজন সচেতন মানুষ হিসাবে গড়ে তুলেছিল ৷ মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় বাংলার সমাজ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নারীর প্রতি সমাজের অবহেলার মতো বিষয়গুলি বরাবরই প্রকট থেকেছে ৷ মায়ের মতোই তিনিও বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ৷ বাস্তুহীন শ্রমজীবী মানুষের প্রতি তাঁর আন্তরিক দরদ ছিল ৷ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন তিনি ৷
মহাশ্বেতা দেবীর লেখা প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় 1956 সালে ৷ বইটির নাম 'ঝাঁসির রানি' ৷ বইটি লিখতে অনেক পরিশ্রম করেছিলেন মহাশ্বেতা ৷ দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলেন গবেষণার কাজে ৷ তাঁর লেখা অন্য়ান্য বইগুলির মধ্য়ে উল্লেখযোগ্য হল, হাজার চুরাশির মা, অরণ্য়ের অধিকার, অগ্নিগর্ভ, নীরেতে মেঘ, স্তন্যদায়িনী প্রভৃতি ৷ এর মধ্য়ে 'ঝাঁসির রানি' আদতে রানি লক্ষ্মীবাইয়ের জীবন সংগ্রামের প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ ৷ এছাড়াও রয়েছে একাধিক কালজয়ী উপন্যাস এবং অসংখ্য ছোট গল্পের সংকলন ৷
এহেন একজন গুণী মানুষকে তাঁর কৃতিত্বের সম্মান জানাতে কার্পণ্য করেনি দেশ ৷ তাঁর পুরস্কার ও সম্মাননার ঝুলিতে রয়েছে সাহিত্য অ্য়াকাডেমি পুরস্কার, পদ্মশ্রী, জ্ঞানপীঠ, পদ্মবিভূষণ, বঙ্গবিভূষণ প্রভৃতি ৷ 2016 সালের 23 জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন মহাশ্বেতা ৷ বাংলা তথা দেশ হারায় একজন মহান সাহিত্যিক ও সমাজসেবীকে ৷
আরও পড়ুন: 75 Years of Independence: স্বাধীনতার 75 বছরে ফিরে দেখা সংগ্রামীদের ইতিহাস
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে স্বনামধন্য বাঙালি লেখিকা তথা সাহিত্যিকদের কথা বলা হলে অরুন্ধতী রায়ের (Arundhati Roy) উল্লেখ অবশ্যম্ভাবী ৷ লেখালিখির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত রয়েছেন অরুন্ধতী ৷ তবে, তাঁর নামের সঙ্গে সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনই জড়িয়ে রয়েছে বহু বিতর্ক ৷ 1961 সালের 24 নভেম্বর জন্ম হয় সুজানা অরুন্ধতী রায়ের (Suzanna Arundhati Roy) ৷ তাঁর লেখা বইগুলির মধ্যে সবথেকে আলোচিত, 'দ্য গড অফ স্মল থিংস' (The God of Small Things) ৷ অরুন্ধতীর এই বই 1997 সালে বুকার পুরস্কার (Booker Prize) জিতেছিল ৷ ছিনিয়ে নিয়েছিল 'বেস্ট সেলিং'-এর তকমাও ৷
অরুন্ধতীকে নিয়ে বিতর্কের কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হল, কাশ্মীর এবং কাশ্মীরীদের নিয়ে তাঁর অবস্থান ৷ 2008 সালের অগস্ট মাসে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরকে স্বাধীন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করা উচিত ৷ কারণ, কাশ্মীরীরাই নাকি তেমনটা চান ৷ এই মন্তব্য করার জন্য জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল অরুন্ধতীকে ৷ এমনকী 'ভারত-বিরোধী' ভাষণ দেওয়ার অভিযোগে 2010 সালে অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করেছিল দিল্লি পুলিশ ৷ এছাড়াও, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে সমাজকর্মী মেধা পাটকরের সহযোদ্ধা হিসাবে দেখা গিয়েছিল অরুন্ধতীকে ৷ পরবর্তীতে, আমেরিকার আফগান নীতি, ভারতের পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার-সহ অসংখ্য ইস্যুতে অরুন্ধীর মন্তব্য নিত্যনতুন বিতর্ক তৈরি করেছে ৷ বর্তমানে কেন্দ্রের মোদি সরকারের সমালোচনার জন্য যাঁদের নাম সকলের আগে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের মধ্যে অরুন্ধতী অন্যতম ৷
শুধুমাত্র মহাশ্বেতা দেবী ও অরুন্ধতী রায়ের কথা বলে বাঙালি মহিলা সাহিত্যিকদের ব্যপ্তিকে নাগালে আনা কার্যত অসম্ভব ৷ এক্ষেত্রে লীলা মজুমদার থেকে শুরু করে আশাপূর্ণা দেবী, সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতো নামগুলি অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় ৷ যদিও তার বাইরেও থেকে যান আরও বহু কৃতী নারী লেখিকা ৷