দিল্লি, 19 জুলাই : বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক নিয়ে ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা আবার শুরু হতে চলেছে ৷ এর উদ্দেশ্য, দু'পক্ষের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো ৷ এই বিষয়টি দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে রয়েছে ৷ তবে অদূর ভবিষ্যতে এই আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা ৷
ভিয়েতনাম গত মাসেই EU-র সঙ্গে FTA করার অনুমোদন দিয়েছে ৷ আর এখানেই পিছিয়ে পড়েছে ভারত ৷ অথচ এশিয়ার এই দুই দেশ ইউরোপের বাজার ধরতে মরিয়া ৷
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিচেল এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেয়েন 15 জুলাই ভার্চুয়াল মাধ্যমে 15 তম ভারত - EU সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৷ সেখানে দুই পক্ষই রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি পর্যালোচনা করে ৷
এই সম্মেলনের পর বিদেশমন্ত্রকের (MEA) সচিব (পশ্চিম) বিকাশ স্বরূপ সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জানান যে, ‘‘এই বৈঠকের সব গুরুত্বপূর্ণ ফল হল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার সিদ্ধান্ত ৷ সেখানে বাণিজ্য ও বাজার সহ সরবরাহের ব্যবস্থাকে সংযুক্ত করার বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে ৷’’
স্বরূপ জানান যে দুই পক্ষের নেতারা “দুই পক্ষেরই কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করার গুরুত্বের প্রেক্ষিতে সরবরাহের ব্যবস্থা সংযুক্ত করার বৈচিত্রের গুরুত্ব, ভারত ও EU এর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি পূর্ণ উদ্যমে দুই দিক থেকেই আরও জোর দেওয়া এবং দুই তরফের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে” আলোচনা করেছেন ৷
তিনি বলেন, “প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) টানার বিষয়টিতে আমরা যে গুরুত্ব দিচ্ছি এবং নিয়ম সংক্রান্ত পরিবেশকে সহজ করার ও ব্যবসা করার পরিস্থিতিকে আরও সহজ করার যে কাজ ভারত সরকার করছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার উপরই জোর দিয়েছেন ৷”
“তিনি ইউরোপের ব্যবসাকে ভারতের সুযোগগুলি ব্যবহারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে আত্মনির্ভর ভারতের লক্ষ্য হল ভারতের দেশীয় পণ্যকে বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করা ৷”
MEA এর দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, 2018 সালে EU ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য সহযোগী ৷ আর ভারত ছিল EU এর নবম বড় বাণিজ্য সহযোগী ৷ 2018-2019 সালে EU এর সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল 115.6 বিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার ৷ এর মধ্যে ভারত রফতানির মূল্য ছিল 57.17 বিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার এবং EU থেকে ভারতে আমদানির মূল্য ছিল পরিমাণ ছিল 58.42 বিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার ৷ EU এ রপ্তানির নিরিখে ভারতের অবস্থান চার নম্বর স্থানে ৷ আর EU থেকে রফতানি করে আনার ক্ষেত্রে ভারত ছয় নম্বর স্থানে রয়েছে ৷
ভারতে FDI এর সবচেয়ে বড় উৎস হল EU ৷ 2000 সালের এপ্রিল থেকে 2018 সালের জুন মাস পর্যন্ত EU এর অধীনে থাকা দেশগুলি থেকে ভারতে আসা FDI এর পরিমাণ 90.17 বিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার ৷ এই সময়ে ভারতে যত FDI এসেছে, তার মধ্যে এটা হল 24 শতাংশ ৷ বিনিয়োগের সুবিধার্থে তৈরি করা একটি ব্যবস্থা যা EU থেকে FDI আনতে সমর্থ হয়েছে ৷
ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক 2017 সালের মার্চ মাসে দিল্লিতে তাদের অফিস শুরু করে এবং তারা ভারতের একাধিক প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে ৷ EU তে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় 50 বিলিয়ন ইউরো ৷
এত কিছুর পরও দুই পক্ষের মধ্যে Broad-based Trade and Investment Agreement (BTIA) - এর অধীনে FTA নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি ৷ BTIA নিয়ে আলোচনা শুরু হয় 2007 সালে ৷ একাধিক বার বৈঠকের পর 2013 সালে তা স্থগিত করে দেওয়া হয় ৷
যাঁরা এই বিষয়টি জানেন, তাঁরা বলছেন যে, ভারত সব দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তি (BIT) ত্যাগ করার পরে, ইউরোপীয় দেশগুলির থেকে বিনিয়োগ এখন আর সুরক্ষিত নয় । 2015 সালের ডিসেম্বরে দিল্লির তরফে একটি নতুন BIT মডেল তৈরি করা হয় ৷ তার ভিত্তিতে ভারত সমস্ত BIT বাতিল করে দেয় ।
এর পর EU এর 28টি সদস্য দেশের তরফে বিনিয়োগ সুরক্ষার আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় EU - কে ৷ ব্রেক্সিট ও অর্থনৈতিক চুক্তির বহুপাক্ষিক পরিবর্তনের ফলে বিনিয়োগের সুরক্ষা নিয়ে যে উদ্বেগের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার ফলে ভারত ও EU - এর বাণিজ্য সম্পর্কের উপর অনিশ্চিয়তা তৈরি হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য ৷
ETV ভারতের সঙ্গে কথা বলার সময় ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনসের (FIEO) ডিরেক্টর জেনারেল ও CEO অজয় সহায় জানিয়েছেন যে, অটোমোবাইলস ও অটো পার্টস, ওয়াইন এবং দুগ্ধজাত পণ্য আমদানির বিষয়গুলিতে তথ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রটি ভারত ও EU - এর মধ্যে BTIA সম্পাদনে বাধা হয়ে রয়েছে ৷ সহায় বলেন, “আমরা একটি রপ্তানি সংস্থা হিসেবে, সবাই FTA - এর পক্ষে রয়েছি ৷ তবে পুরোটাই নির্ভর করছে দু’পক্ষ একে অপরকে কতটা জায়গা দিচ্ছে এবং উভয় পক্ষের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির উপর ।”
ব্রিটেন ভারতের বরাবর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগী ৷ EU থেকে এদের বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ভারতকে BTIA - কে অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা উচিত ৷ এমনটাই মনে করেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ়ের অন্তর্গত সেন্টার ফর ইউরোপীয় স্টাডিজ়ের চেয়ারপার্সন গুলশন সচদেব ৷ সচদেব বলেন, “UK কী ধরনের বাণিজ্য চুক্তি EU - এর সঙ্গে করছে ৷ তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে ৷ তাছাড়া ইউরোপের শরণার্থী সমস্যা এবং এর জেরে ইউরোপের অর্থনীতির অবস্থাও এর মধ্যে বিচার্য হবে ৷” তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ‘‘15 জুলাইয়ের শীর্ষ সম্মেলনের পর বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা করা হবে বলে ঠিক হয়েছে ৷ তবে এই প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু হবে BTIA - তে সমঝোতা নিয়ে ৷ সেই কারণেই এই চুক্তির বাস্তবায়ন অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা নেই ৷’’
সহায় আরও উল্লেখ করেছেন যে, এই বছর জুনে ভিয়েতনাম EU - এর সঙ্গে FTA অনুমোদন করেছে ৷ এর ফলে ভারতের অবস্থান আরও খানিকটা পিছিয়ে গিয়েছে ৷ EU - Vietnam Free Trade Agreement (EVFTA) হল অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস (ASEAN)-এর গোষ্ঠীভুক্ত কোনও দেশের সঙ্গে EU - এর দ্বিতীয় FTA ৷ এর আগে ওই গোষ্ঠীভুক্ত দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর এই চুক্তি করে ৷
সহায় বলেন, “ভারত এবং ভিয়েতনাম উভয় দেশই ইউরোপের বাজার ধরার প্রতিযোগিতা করছে ৷ এখন যেহেতু ভিয়েতনাম FTA অনুমোদন করেছে, তাই তারা পোশাক, জুতো, চামড়ার পণ্য, আসবাব, সামুদ্রিক পণ্য এবং কিছু কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করার সুযোগ পাবে ৷ তাছাড়া ভিয়েতনামের সঙ্গে থাকছে শুল্কেরও সুবিধা ৷”