ইম্ফল ও নয়াদিল্লি, 19 ডিসেম্বর: বছর শেষ হতে আর ক'দিন ৷ 2023 সাল ফিরে দেখলে প্রথমেই মনে পড়ে মণিপুরের কথা ৷ দুই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরে বারবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যটি ৷ এখানে জনসংখ্যার 53 শতাংশ মেইতেই ৷ মণিপুরের উপত্যকাতেই এই গোষ্ঠীর বসবাস ৷ আর জনসংখ্যার 40 শতাংশ নাগা ও কুকি ৷ তারা পাহাড়ি এলাকার বাসিন্দা ৷ মেইতেই সম্প্রদায় গত 10 বছর ধরে তফশিলি উপজাতিভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে ৷ তাদের এই দাবিকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর ৷
মে মাসে এই দাবির বিরোধিতা করে কুকি ৷ একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে এই গোষ্ঠী ৷ সেই মিছিলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ৷ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ইম্ফল ৷ সেখান থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যে এবং সারা দেশে ৷ উন্মত্ত জনতা মন্ত্রীদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় ৷ এই সবকিছুর মধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় দুই বিবস্ত্র তরুণীর ভিডিয়ো ৷ তাদের বিবস্ত্র করে প্রকাশ্যে হাঁটতে বাধ্য করা হয় ৷ এই ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়তেই তা যেন আগুনে ঘি ঢালে ৷ দীর্ঘ সময় ধরে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে ৷ বিশ্বের অন্য দেশগুলিও এই ঘটনার সমালোচনা করে ৷ তবে মণিপুরে এই সংঘর্ষের ঘটনা এই প্রথম নয় ৷ এর আগে 1992 সালে নাগা ও কুকি গোষ্ঠীর মধ্যে এমনই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ৷ এরপর 1997 সালেও কুকি ও পাইতে জনজাতির মধ্যেও সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মণিপুর ৷
মে মাস থেকে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে মণিপুরে ৷ তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সময় এই বিষয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি ৷ 20 জুলাই সংসদের বাদল অধিবেশ শুরু হয় ৷ তার আগের দিন দুই তরুণীকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর একটি ভিডিয়ো সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ৷ জানা যায়, মণিপুরে এই ঘটনাটি ঘটেছে 4 মে ৷ ওই তরুণীদের গণধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে ৷ এর আড়াই মাস পরে ভিডিয়োটি ভাইরাল হতেই তা প্রকাশ্যে আসে ৷ স্বভাবতই এমন ঘটনায় কেন্দ্রে বিজেপি সরকার বিরোধীদের কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে ৷
ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পরদিন সংসদীয় বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার মণিপুর নিয়ে মন্তব্য করেন ৷ মণিপুরে হিংসার ঘটনা শুরু হওয়ার 78 দিন পর তিনি পুরনো সংসদ ভবনের বাইরে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, "আমি গভীরভাবে ব্যথিত ৷ এই ঘটনা পুরো সমাজের জন্য নিন্দনীয় ৷ রাগে ফেটে পড়ছি ৷" এদিকে জুন মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজে মণিপুর সফরে গিয়েছিলেন ৷ তারপরে প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধিও মণিপুরে যান ৷ সেখানে ত্রাণশিবিরে থাকা হাজার হাজার সাধারণ মানুষের অবস্থা দেখেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন ৷
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী নিজে কেন মণিপুর যাচ্ছেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে রাজনৈতিক মহলে ৷ মণিপুর যখন জ্বলছে, সেই সময় তিনি আমেরিকা, মিশর এবং আরব আমির শাহি সফরে গিয়েছেন ৷ জি-20 শীর্ষ সম্মেলনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেছিলেন ৷ কিন্তু মণিপুরে পা রাখেননি ৷ সংসদের বাদল অধিবেশনে মণিপুরে হিংসার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবিতে লোকসভা ও রাজ্যসভা- দুই কক্ষই উত্তাল হয়ে ওঠে ৷ বারবার মুলতুবি হয়ে যায় সংসদের দুই কক্ষের অধিবেশন ৷
প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির বিবৃতির দাবিতে অনড় বিরোধীরা লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্ত নেয় ৷ 26 জুলাই বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোটের পক্ষে কংগ্রেস সাংসদ গৌরব গগৈই লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন ৷ এই বিতর্কে বিজেপি বনাম বিরোধী দলগুলির বিবাদ চরমে ওঠে ৷ কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধি বিজেপি সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে তীব্র আক্রমণ করেন ৷ তিনি অভিযোগ করেন, "ভারত মাতার হত্যা করা হয়েছে ৷" কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই বিতর্কে কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন, "কংগ্রেস এই আলোচনা চায় না ৷ তারা শুধু প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করতে চায় ৷"
9 অগস্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ লোকসভায় জানান, 152 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র মে মাসেই 107 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ সংসদীয় অধিবেশন শেষ হওয়ার আগের দিন 10 অগস্ট প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দেন ৷ তিনি কংগ্রেসকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন ৷ খুব সামান্য সময় মণিপুর বিষয়ে বলেন ৷ তিনি আশ্বস্ত করেন, মণিপুরে শান্তি ফিরে আসবে ৷ বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে বিরোধীরাই পরাস্ত হয় ৷ 2027 সালে মণিপুরে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ৷ মণিপুরে হিংসাত্মক ঘটনার প্রভাব এই নির্বাচনে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল ৷ তার আগে 2024 সালের লোকসভা নির্বাচনে মণিপুর আবার অশান্ত হবে না তো ? চিন্তিত ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ ৷
আরও পড়ুন: