বারাসত, 20 ফেব্রুয়ারি: দত্তপুকুর-কাণ্ডে রহস্য উদঘাটন করে ফেলল পুলিশ ৷ স্ত্রী'র সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বদলা নিতেই হজরত লস্করকে কুপিয়ে খুন করেছেন মহম্মদ জলিল গাজি । বৃহস্পতিবার দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করে এমনটাই জানালেন বারাসত পুলিশ জেলার এসপি প্রতীক্ষা ঝাড়খাড়িয়া ৷
এই নৃশংস খুনের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে পুলিশ সুপারের কথাতে বারবার উঠে এসেছে নিহত হজরত এবং ধৃত জলিলের পূর্ব অপরাধের প্রসঙ্গও । সেই সঙ্গে খুনের পর আততায়ী জলিল নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছিলেন বলেও জানিয়েছেন তিনি ।
প্রতীক্ষা ঝাড়খাড়িয়া বলেন, "দত্তপুকুরের বাজিতপুরে চাষের জমিতে হজরতের মুন্ডু কেটে ব্যাগে ভরে বামনগাছি স্টেশন লাগোয়া ডোবায় ফেলার পর নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল মহম্মদ জলিল গাজি । পরের দিন অর্থ্যাৎ 3 ফেব্রুয়ারি ভোরে মুন্ডুহীন দেহ উদ্ধারের পর চাষের খেতে পুলিশ ও গ্রামবাসীরা জড়ো হলে ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত থেকে সবটার ওপর নজর রাখছিলেন তিনি । ভেবেছিলেন অকুস্থল থেকে প্রায় 2 কিলোমিটার দূরে মুন্ডু ফেলে আসায় পুলিশ হদিশ পাবে না । তাই যখন মুন্ডুহীন দেহ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় পড়ে গিয়েছে, তখনও নিশ্চিন্তে স্ত্রীর সঙ্গে বাড়িতে দিন কাটাচ্ছিল মূল অভিযুক্ত । কিন্তু তাল কাটে হজরতের স্ত্রী'র রাতের ফোনে । জলিলের স্ত্রী সুফিয়াকে ফোন করে সে স্বামীর খোঁজ জানতে চায় ।"
তিনি আরও বলেন, "ঘটনার দিন অর্থাৎ 2 ফেব্রুয়ারি গাইঘাটার বাড়ি থেকে বেরনোর সময় হজরত তাঁর স্ত্রীকে জলিলের বাড়ি যাচ্ছে বলে জানিয়েছিল । কিন্তু জলিল বাড়িতে নেই, এমনকি হজরতের বিষয়েও জানে না, এমনটা জলিলের স্ত্রীকে জানানোর পরই জম্মুতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেয় মূল অভিযুক্ত । সেই মতো 4 ফেব্রুয়ারি সকালে বামনগাছি রেল স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা স্টেশনে পৌঁছয় জলিল । সেখান থেকে আবারও ট্রেনে করে সে যায় জম্মুতে । সেখানে গিয়েও জলিল মোবাইলে সারাক্ষণ খবরের দিকে নজর রাখে । স্ত্রীর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ কলেও এই বিষয়ে খবর নিত সে । শেষে সুফিয়া গ্রেফতার হলে জম্মুর প্রথম আস্তানা পালটে পাকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন সাম্বা গ্রামে আশ্রয় নেয় মূল অভিযুক্ত । এই সংক্রান্ত তথ্য ইতিমধ্যেই হাতে এসেছে ।"
কিন্তু, কেন এত আক্রোশ হজরতের উপর? কেনই বা এতটা নৃশংসতা? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খাড়িয়া বলেন, "বিভিন্ন কারণে হজরতের উপর আক্রোশ জন্মেছিল জলিলের । তিনি ও তাঁর বন্ধু হজরত, দু'জনেই দাগী দুষ্কৃতী । চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই-সহ একাধিক অপরাধের সঙ্গে জড়িত এঁরা । এ নিয়ে গঙ্গাপাড়ের এপার এবং ওপারে, বিভিন্ন থানায় অভিযোগও রয়েছে তাদের নামে । চুরির মালপত্র নিয়ে মাঝে মধ্যেই গোলমাল লেগে থাকত হজরত ও জলিলের মধ্যে । জলিলের ধারণা ছিল, চুরির ভাগের বেশি অংশ নিজের কাছে রেখে অন্যদের কম দিচ্ছেন হজরত ।"
তিনি জানান, সম্প্রতি 400 গ্রাম সোনার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও মনোমালিন্য তৈরি হয়েছিল হজরত ও জলিলের দলবলের মধ্যে । পুলিশের চর হিসাবেও হজরত জলিলের বাংলাদেশি সঙ্গীকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন । এসব নিয়ে আগে থেকেই হজরতের উপর আক্রোশ ছিল জলিলের । কিন্তু, সেই সবকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে স্ত্রী'র উপর 'বিকৃত' যৌন নির্যাতন । তার জেরেই এই নৃশংসতা এবং পরিকল্পনা মাফিক খুন । তবে, এই খুনে হজরতের প্রাক্তন প্রেমিকা ও তাঁর মামাতো ভাই ওবায়দুল গাজির কোনও যোগ এখনও অবধি পাওয়া যায়নি বলে দাবি করেছেন পুলিশ সুপার ।
এদিকে, খুনের আগে 'টোপ' দিয়ে হজরতকে জলিলের স্ত্রী-ই ফোন করে গাইঘাটা থেকে হজরতকে দত্তপুকুরে ডেকে নিয়ে এসেছিল বলে জানিয়েছেন বারাসত জেলার পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝাড়খাড়িয়া । তাঁর কথায়, "জলিলের স্ত্রী'র 'মোহেই' হজরত গিয়েছিল সেখানে । মদের আসরের জন্য সবকিছু কেনা হলেও আদতে ঘটনাস্থলে কোনও মদের আসর বসেনি । উদ্দেশ্য ছিল, অন্ধকার নামলেই হজরতকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া । সেই মতোই জলিল ও তাঁর স্ত্রী কাজ হাসিল করেছিল । পুলিশকে 'বিভ্রান্ত' করতেই ঘটনাস্থলে মদের বোতল, গ্লাস এবং চিপসের প্যাকেট রেখে যাওয়া হয়েছিল ।" অন্যদিকে, জলিলের সঙ্গে হজরতও কয়েকবার জম্মুতে গিয়েছিল বলে দাবি করেছেন বারাসত জেলার পুলিশ সুপার ।
প্রসঙ্গত, গত 3 ফেব্রুয়ারি দত্তপুকুরের ছোট জাগুলিয়া পঞ্চায়েতের মালিয়াকুর এলাকার একটি চাষের জমি থেকে বছর চল্লিশের এক যুবকের মুন্ডুহীন দেহ উদ্ধার করে পুলিশ । প্রমাণ লোপাটে দেহটি'র হাত-পা বেঁধে পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল । যৌনাঙ্গও ছিল ক্ষতবিক্ষত । হাড়হিম করা সেই ঘটনার দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছিল মালিয়াকুর গ্রাম । ঘটনাস্থল থেকে রক্তমাখা মদের গ্লাস, চিপ্সের বেশ কিছু প্যাকেটও খুঁজে পেয়েছিল পুলিশ । ঘটনার দু'দিনের মাথায় যুবকের বাঁ হাতের ট্যাটু ও পোশাকের ছেঁড়া অংশের সূত্র ধরে পরিচয় মেলে যুবকের । উদ্ধার হয়েছে খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রটিও ।
জানা যায়, নিহত যুবকের নাম হজরত লস্কর । আদতে দক্ষিণ 24 পরগনার লক্ষ্মীকান্তপুরের বাসিন্দা তিনি । তবে,বছর খানেক হল তিনি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গাইঘাটার আঙুলকাটা গ্রামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকছিলেন । ওই একই গ্রামে বাড়ি হজরতের মামাতো ভাই ওবায়দুল গাজিরও । যাকে হজরত হত্যা-কাণ্ডে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ । গ্রেফতার হয়েছেন হজরতের প্রাক্তন প্রেমিকা এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ এক বান্ধবীও ।
যাঁর স্বামী জলিলকে জম্মুর সাম্বা থেকে গ্রেফতার করে এ রাজ্যে নিয়ে এসেছে বারাসত জেলা পুলিশ । এই জলিলই হজরত লস্কর খুনের মাস্টারমাইন্ড । তাঁকে জেরা করেই খুনের 15 দিনের মাথায় বামনগাছি থেকে হদিস মেলে হজরতের কাটা মুন্ডুর । ইতিমধ্যে উদ্ধার হওয়া কাটা মুন্ডু চিহ্নিত করতে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হলেও এখনও হজরতের মোবাইল এবং তাঁর সিম কার্ড উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ ।