হাতের কাগজটির দিকে তখনও একদৃষ্টে চেয়ে আছেন ৷ বিস্ময় তাঁর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়েছে ৷ হাসবেন না কাঁদবেন, কলকাতা পুলিশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কমিশনার সত্যিই বুঝতে পারছিলেন না ৷ তাঁর অবস্থা তখন শাঁখের করাতের মতো ৷ কেউ কি কখনও নিজেকে গ্রেপ্তার করতে পারে ? শত ভেবেও মাথায় ঢুকছিল না স্যার স্টুয়ার্ট হগের ৷
তাঁর অবস্থাটা কলকাতা পুলিশে নজিরবিহীন ৷ হয়ত দেশের ইতিহাসেও নজিরবিহীন ৷ এক কথায় অভাবনীয় ও অকল্পনীয় ৷ সেই গল্পের শুরুটা হয়েছিল এভাবে-
স্যার স্টুয়ার্ট সাউন্ডার্স হগ ৷ ছাত্রজীবনটা কাটিয়েছেন টেমস নদীর তীরে অভিজাত ইটন কলেজে ৷ পড়াশোনা শেষে 1853 সালে ভারতে এসে যোগ দিলেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে ৷ একসময় বাংলার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসলেন হগ ৷ বর্ধমান জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদে দক্ষ প্রশাসক হিসেবে যেমন সুনাম কুড়িয়েছিলেন তেমনই সৎ ও উদার মানসিকতার জন্য প্রশংসিত হন ৷ 1865-'66 সালের দুর্ভিক্ষের সময় হগ সাহেবের বাড়ি লাগোয়া অফিসের দরজা জনসাধারণের জন্য সবসময় খোলা থাকত ৷ সেসময় হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়ে সাধারণের চোখে ঈশ্বরের আসনে বসেছিলেন ৷
প্রশাসনিক কাজ দক্ষ হাতে সামলানোর জন্য নিঃসন্দেহে পুরস্কার প্রাপ্য ছিল স্যার স্টুয়ার্ট হগের ৷ পুরস্কার পেলেন তিনি ৷ 1866 সালের মাঝামাঝি দিকে বর্ধমান থেকে কলকাতায় এলেন হগ সাহেব ৷ দু'টি গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব নিয়ে ৷ প্রথমটি হল- পুলিশ কমিশনারের পদ ও অন্যটি কলকাতা পৌরনিগমের চেয়ারম্যান ৷ দিনের অর্ধেক সময় লালবাজারে থাকার পর বাকি সময়টা 8, জানবাজার স্ট্রিটে (পরে যার নাম হয় কর্পোরেশন স্ট্রিট ও আরও পরে S.N ব্যানার্জি রোড ) কর্পোরেশনের হেডকোয়ার্টারে কাটাতেন তিনি ৷ এই ফাঁকে তাঁর গড়া দু'টি মাইলস্টোনের কথা বলা যাক ৷ পৌরনিগমের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি একটি বাজার গড়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ৷ 1874 খ্রিস্টাব্দের 1 জানুয়ারি তৈরি হওয়া সেই বাজারকে প্রথম প্রথম হগ সাহেবের বাজার বলা হত ৷ 28 বছর পর 1903 সালে সরকারিভাবে এর নাম হয় স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট ৷ তবে শহরবাসীর কাছে এর একটিই পরিচয়, নিউ মার্কেট ৷ দ্বিতীয়টি হল, কলকাতার পুলিশ কমিশনার হিসেবে গোয়েন্দা বিভাগের স্রষ্টা হলেন হগ সাহেব ৷
পড়াশোনার সুবাদে অপরাধ বিষয়টি সম্পর্কে ধ্যান ধারণা ছিল স্যার স্টুয়ার্ট হগের ৷ কলকাতা পুলিশে অপরাধ বিভাগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তিনি ৷ তবে, একটি ঘটনার পরই তাঁর এই অনুভব জাগে ৷ 1868 সালের 1 এপ্রিল আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার কাছে একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ৷ হত্যা করা হয়েছিল রোজ ব্রাউন নামে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবতিকে ৷ সেই মার্ডার কেস নিয়ে হইচই পড়ে গেছিল কলকাতা পুলিশের অন্দরে ৷ তদন্তে নেমে ওই যুবতির হত্যাকারীকে ধরে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান রিচার্ড রেইড নামে এক অফিসার ৷ যাঁকে কলকাতা পুলিশের প্রথম গোয়েন্দা হিসেবে ধরা হয় ৷ সেই তদন্তে রেইডকে সাহায্য করেছিলেন স্টুয়ার্ট হগ ৷ তাঁর বই "Everyman his Own Detective"-এ তৎকালীন পুলিশ কমিশনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন রেইড ৷
এ তো গেল হগ সাহেবের পরিচয় ৷ এবার সেই শুরুর গল্পে যাওয়া যাক, যেখানে কমিশনার নিজেই নিজেকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছেন ৷ সময়টা তখনকার যখন- লন্ডনে ছুটি কাটিয়ে সদ্য ভারতে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন হগ ৷ কিন্তু ফেরার সময় বিপত্তি বাধালেন ৷ পথে তাঁর ব্যাগপত্র অন্যের সঙ্গে অদলাবদলি হয়ে গেল ৷ বাড়ি ফিরে বিষয়টি উপলব্ধি করতেই হইচই পড়ে গেল চারিদিকে ৷ কমিশনারের ব্যাগ বদল ! যেমন তেমন ব্যাপার নাকি ৷ গোটা ডিপার্টমেন্টে হইচই ৷ গোটা ভারতের পুলিশ হগ সাহেবের খোয়া যাওয়া ব্যাগের খোঁজে নেমে পড়ল ৷
অবশেষে শত খোঁজাখুঁজির পর ব্যাগ মিলল এলাহাবাদে ৷ হগ সাহেবের নামে সমন জারি করলেন স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট ৷ কলকাতা পৌরনিগমের চেয়ারম্যানকে বলা হল, এলাহাবাদ এসে কোর্টে হাজিরা দিয়ে ব্যাগ শনাক্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে ৷ কিন্তু দু'টো পদের দায়িত্ব সামলে এলাহাবাদ যাওয়ার সময় পেলেন না তিনি ৷ ফলে, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজিরাও দিতে পারলেন না ৷ তাঁর অনুপস্থিতির ফলে আরও একটি আদেশ জারি হল ৷ কলকাতার "পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ"কে বলা হল "পৌরনিগমের চেয়ারম্যান হগ"কে গ্রেপ্তার করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে পেশ করতে ৷
উদ্ভট সেই আদেশের কপি পেতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন হগ সাহেব ৷ অনেক বড় বড় পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন, কিন্তু এমন অবস্থার মধ্যে আগে কখনও পড়তে হয়নি তাঁকে ৷ এমন দ্বিধায় আগে কি কেউ পড়েছে? কোনও মানুষ কীভাবে নিজেকে গ্রেপ্তার করতে পারে? এমন উদ্ভট ঘটনার কথা কোনওদিন কেউ শুনেছে?
কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করা আদালত অবমাননার সমান ৷ তাই স্যার স্টুয়ার্ট হগ সেটাই করলেন যা কল্পনাতীত ৷ পুলিশ কমিশনার হিসেবে তিনি কলকাতা পৌরনিগমের চেয়ারম্যানের নামে গ্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করেন ও তারপর "সম্ভবত নিজেকে গ্রেপ্তার" করে এলাহাবাদের উদ্দেশে যাত্রা করেন ৷ বলা বাহুল্য যে এই হাস্যকর পরিস্থিতি কেউ ছাড়তে চায়নি ৷ 1871 সালে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় রসিয়ে গোটা ঘটনার বর্ণনা করা হয়েছিল ৷
মুখরক্ষার তাগিদে শেষ পর্যন্ত আদালতে উপস্থিত হন হগ সাহেব ৷ তবে শেষটা যে ভালোই ভালোই কেটেছিল তাও নয় ৷ বিরক্ত ম্যাজিস্ট্রেট সাফ বলে দিয়েছিলেন, স্টুয়ার্ট হগের কলকাতা থেকে এলাহাবাদ যাওয়ার খরচের একটি পাই পয়সাও বহন করবে না সরকার ৷ তাই কলকাতার পৌরনিগমের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিজেকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা থেকে এলাহাবাদ যাতায়াতের পুরো খরচ নিজেই বহন করেন ৷
নিয়তিও আড়ালে নিশ্চয় হেসেছিলেন ৷