ETV Bharat / bharat

শারজিল ইমামের এক বছরের হাজতবাস : গণতন্ত্রের এক ধাঁধা

author img

By

Published : Jan 29, 2021, 7:18 PM IST

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক । পরে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা । ইতিবাচক রাজনীতির উপর ভরসা করে । সমালোচনাও করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের । অনেকে বলেন, দিনবদলের আশা দেখাত শারজিলের লেখা... তাঁর ভাষণ । কিন্তু কে ভেবেছিল জেএনইউয়ের এই ছাত্রের জীবন গোটা একটা বছর এক জেল থেকে অন্য জেলে ঘুরতে ঘুরতে আর একের পর এক শুনানিতে কেটে যাবে !

Sharjeel Imam
ফাইল ছবি

হায়দরাবাদ : এক বছর ৷ 366 দিন ৷ 8 হাজারও ঘণ্টারও বেশি সময় ৷ তিনটি জেল ৷ চারটি শহর ৷ অগুনতি শুনানি ৷ একজন অপরাধীর মতো ছোটানো হয়েছে ৷ জেএনইউ - এর ছাত্র শারজিল ইমামের 2020 সালের 28 জানুয়ারি থেকে 2021 সালের 28 জানুয়ারির জীবনকে সংক্ষিপ্তসার কি এটা হতে পারে ? অবশ্যই নয় ! জেলে থাকাকালীন সময়কে এভাবে এক লাইনে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় ৷

একজন উজ্জ্বল ছাত্র, যিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে গুরুত্বপূর্ণ এক সময় ও পরিসরে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের ভালোর জন্য কিছু করবেন ৷ কিন্তু তাঁকে একজন অপরাধীর মতো ছোটানো হচ্ছে ৷ ভারতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশ্বাস করার জন্যই তাঁর সঙ্গে এটা করা হচ্ছে ৷ শারজিলের লেখা ও তাঁর ভাষণে আশার প্রকাশ পেত ৷ তিনি মনে করতেন যে ভারতের মুসলিমরা যদি এক হয়, তাহলে তাদের উপরের দিকে ওঠা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেউ আটকাতে পারবে না ৷ তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি মানুষের ইচ্ছাশক্তির উপর ভিত্তি করে কাজ করতে ভালোবাসেন ৷ প্রকাশ্যে শারজিল যেগুলি লিখতেন এবং বলতেন, তার থেকে বোঝা যায় যে তিনি বিশ্বাস করেন অবাধ কোনও ব্যবস্থা তৈরি করা তখনই সম্ভব, যখন মানুষ সেই সম্ভাবনা ও তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হবেন ৷

শারজিলের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং তাঁর কাজের পদ্ধতি তাঁর সম্পর্কে আমাদের আরও অনেক কিছু জানায় ৷ তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন স্নাতক ৷ পরে তিনি সামাজিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে ইতিহাসের দিকে সরে আসেন ৷ তাঁর চারপাশে যে ঘটনাগুলি ঘটছিল, তার থেকেই তাঁর এই পছন্দের বিষয়টি বোঝা যায় ৷ তিনি ওই পরিস্থিতির সঙ্গেই কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ৷ আর ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন ৷ আর এই প্রেক্ষিতেই দেখতে হবে তাঁর সিএএ-এনআরসি-এনপিআর আন্দোলনে যোগদানের বিষয়টি ৷ যেখানে তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে মুসলিমদের একটি সম্প্রদায় হিসেবে শক্তিশালী হওয়া উচিত, কোনও ব্যক্তি হিসেবে নয় ৷

রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে যে রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় থেকেছে বা আছে, শারজিল তাদের সমালোচনা করেছে ৷ রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনতার পর থেকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করেন শারজিল ৷ সেটাই এই সমালোচনায় প্রকাশ পেয়েছে ৷ এই রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিমদের জন্য কিছুই করেনি ৷ বরং তাদের নীতির মাধ্যমে বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছে ৷ এটা ব্যাখ্যা করার পর শারজিল বলেছেন মুসলিমদের নিজের অধিকারের দাবি তুলে ধরে এখন থেকে এগিয়ে যেতে হবে ৷ মুসলিমদের তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে ৷ তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থার সমস্যাগুলি তুলে ধরে এই বিষয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে লড়াই করা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন ৷ তাই তাঁর বিশ্বাস সিএএ বিরোধী আন্দোলনই ছিল সঠিক সময় যখন ভারতীয় সমাজের গণতান্ত্রিক শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দর কষাকষি করা যায় ৷ আর ভারতীয় মুসলিমদের দেশের নাগরিক হিসেবে সমানাধিকার অর্জন করে নিন ৷ পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপও করতে হবে ৷

আরও পড়ুন : রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিহার থেকে গ্রেপ্তার সারজিল ইমাম

শারজিল তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন প্রকাশ্যে ৷ তিনি অন্তত সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে এমন কিছু বিশ্বাস পোষন করেন না যা তাঁকে কারাগারের পিছনে ঠেলে দিতে পারে ৷ অথবা মুসলিম সমাজের প্রতি তাঁর যে বক্তব্য, তার জন্য তাঁকে একজন অপরাধীর মতো ছুটিয়ে বেড়ানো হচ্ছে ৷ তবে সমসাময়িক ভারতে তাঁর মুসলিম পরিচয় অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন একটি বিষয় যার ভারতীয় সংস্কৃতিতে কোনও স্থান নেই বা সম্ভবত কখনও হয়নি । নিজের সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর বেশি কিছু দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৷ আর তাঁর সত্যি বলার জন্য অকুতোভয় মনোভাবের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি রাজ্যে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে ৷ তাঁর বক্তব্যের জেরে কোনও হিংসা হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ দায়ের হয়েছে ৷ যদি তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলির টাইমলাইনে চোখ রাখি এবং কীভাবে ঘটনাগুলি ঘটল, তা দেখি, তাহলে দেখা যাবে এই ঘটনাগুলি পর পর ঘটানো হয়েছিল ৷

এটা শুধুমাত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে শারজিলের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে তা নয়, এর মধ্যে তাদের শরিকরাও অংশ নিয়েছে ৷ শারজিল যেভাবে তাঁর সম্প্রদায়ের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের মুখোমুখি হতে অনেকটা এগিয়েছিল, উদারপন্থী এবং প্রগতিশীল কণ্ঠস্বরগুলির একটি বৃহত্তর অংশও একই ভাবে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার ব্যথা অনুভব করেছিল ৷ তাঁদের কাছে পৌঁছে শারজিল শুধু ভালো মুসলিম হিসেবে না থেকে সমান নাগরিক হিসাবে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন ৷ একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি হিসেবে সত্যিকে সত্যি হিসেবে বলেছিলেন । তাদের কাছে, কীভাবে একজন মুসলিম তাঁদের প্রতিনিধিত্বের দয়ায় থাকতে অস্বীকার করতে পারেন এবং কীভাবে কোনও মুসলিম যিনি নিজের চারিদিকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে, তিনি কীভাবে সীমার মধ্যে থাকতে অস্বীকার করতে পারেন ।

আরও পড়ুন : ফের তপ্ত জাফরাবাদ, চলল গুলি ; মৃত বেড়ে 13

শারজিল ইমাম এমন একজন মুসলিম, যাঁর অস্তিত্ব লিবারেল, প্রগতিবাদী এবং নাগরিক সমাজের বাকি অংশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের কল্পনার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় ৷ এই সমালোচক মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাষাও রয়েছে ৷ সেখানে সমানদের মতো কথা বলা এবং সমান নাগরিকের মতো অধিকার দাবি করা এবং মুসলিম হওয়ার অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি নিয়ে সমালোচনা করা হয় ৷ তাঁর রাজনৈতিক ভাষা কেবল ডানপন্থী রক্ষণশীলদের কাছেই নয়, কেন্দ্রীয়বাদী ও বামপন্থী উদারপন্থী ও প্রগতিবাদীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয় । এখন এই বিষয়টি কেন্দ্র এবং বামপন্থী নাগরিক সমাজ নিয়ে বেশি কথা বলে শারজিলের চেয়ে ৷

শারজিল ইমামকে দোষী সাব্যস্ত না করে তাঁ কারাবাস করার এক বছর হয়ে গিয়েছে । এই এক বছরে, তিনি অবশ্যই তাঁর পছন্দগুলি, তাঁর সিদ্ধান্তগুলি এবং তাঁর বর্তমান অবস্থার প্রতিফলন নিয়ে চিন্তা করেছেন । তাঁর ভাই মুজাম্মিল বারবার প্রকাশ্যে এটা বলেছেন যে শারজিল নিজেকে দোষী হিসেবে দেখেন না ৷ তিনি নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে দেখেন ৷ যিনি তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য লড়াইয়ে বিশ্বাস করেন এবং ক্ষমা চাইতে না চাওয়া একজন মুসলিম হওয়ার জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত আছেন তিনি । তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত যদি গণতন্ত্র হয় এবং জনগণের বাকস্বাধীনতার অধিকার থাকে, তাহলে এটা কেন হচ্ছে ? কোনও ব্যক্তির বক্তব্য কেঁপে উঠতে পারে, ভারতের ঐক্য ও সুরক্ষা কি এতই স্পর্শকাতর ?

শারজিলের ঘটনায় 28 বছর বয়সী মুসলিম স্ট্যান্ড আপ কৌতুক অভিনেতা মুনাওয়ার ফারুকির সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে ৷ তিনি একটা হাস্যকৌতুক বলার জন্য প্রায় এক মাস ধরে জেল খাটছেন ৷ অথচ তিনি তা বলতে চাননি ৷ তবে মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করেছেন । হিন্দু দেবদেবী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে বিজেপির এক বিধায়কের পুত্র অভিযোগ দায়ের করেন ৷ তার পর গত 1 জানুয়ারি রাতে ইন্দোর থেকে মুনাওয়ার ফারুকি এবং আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয় । কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্দোরের পুলিশ সুপার বিজয় ক্ষত্রি জানিয়েছেন যে ফারুকি একটি অনুষ্ঠানে হাস্যকৌতুক বলেননি ৷ তবে ‘বলতে যাচ্ছিলেন’ । এই একই পুলিশ প্রাথমিকভাবে দাবি করেছিল যে ফারুকি হিন্দু দেবদেবীদের বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন’ ।

শারজীল ও ফারুকি উভয়ই এমন একটা কারণের জন্য জেলে গিয়েছেন, যা তাঁরা বলেননি ৷ আর তাঁরা দু’জনেই মুসলিম ৷ তাঁরা দুজনেই ভেবেছিলেন যে ভারতে একজন মুসলিম হিসেবে ও মুক্ত নাগরিক হিসেবে তাঁদের অধিকারগুলি এই দেশের সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে ।

কিন্তু এই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি এখন কোথায়, যেখানে নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতা ধরে রাখার কথা বলা হয় ৷ সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলিকে হয় তাদের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য ভালো ভাবে দেখভাল করা হয় না ৷ অথবা সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের মুসলমানদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে অক্ষম । জামিন হল বিধি এবং জেল তার ব্যতিক্রম ৷ এই আইনী নীতি কি মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ৷ যেখানে গোটা প্রক্রিয়াটিকেই শাস্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে ৷ তাঁদের সাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকার প্রয়োগের জন্য এই ধরনের কোনও সমালোচনা মূলক কণ্ঠস্বর পাওয়া যাচ্ছে না ।

হায়দরাবাদ : এক বছর ৷ 366 দিন ৷ 8 হাজারও ঘণ্টারও বেশি সময় ৷ তিনটি জেল ৷ চারটি শহর ৷ অগুনতি শুনানি ৷ একজন অপরাধীর মতো ছোটানো হয়েছে ৷ জেএনইউ - এর ছাত্র শারজিল ইমামের 2020 সালের 28 জানুয়ারি থেকে 2021 সালের 28 জানুয়ারির জীবনকে সংক্ষিপ্তসার কি এটা হতে পারে ? অবশ্যই নয় ! জেলে থাকাকালীন সময়কে এভাবে এক লাইনে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় ৷

একজন উজ্জ্বল ছাত্র, যিনি হয়তো ভেবেছিলেন যে গুরুত্বপূর্ণ এক সময় ও পরিসরে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের ভালোর জন্য কিছু করবেন ৷ কিন্তু তাঁকে একজন অপরাধীর মতো ছোটানো হচ্ছে ৷ ভারতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা বিশ্বাস করার জন্যই তাঁর সঙ্গে এটা করা হচ্ছে ৷ শারজিলের লেখা ও তাঁর ভাষণে আশার প্রকাশ পেত ৷ তিনি মনে করতেন যে ভারতের মুসলিমরা যদি এক হয়, তাহলে তাদের উপরের দিকে ওঠা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন কেউ আটকাতে পারবে না ৷ তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি মানুষের ইচ্ছাশক্তির উপর ভিত্তি করে কাজ করতে ভালোবাসেন ৷ প্রকাশ্যে শারজিল যেগুলি লিখতেন এবং বলতেন, তার থেকে বোঝা যায় যে তিনি বিশ্বাস করেন অবাধ কোনও ব্যবস্থা তৈরি করা তখনই সম্ভব, যখন মানুষ সেই সম্ভাবনা ও তা পরিবর্তন করার ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হবেন ৷

শারজিলের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং তাঁর কাজের পদ্ধতি তাঁর সম্পর্কে আমাদের আরও অনেক কিছু জানায় ৷ তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একজন স্নাতক ৷ পরে তিনি সামাজিক বিজ্ঞান, বিশেষ করে ইতিহাসের দিকে সরে আসেন ৷ তাঁর চারপাশে যে ঘটনাগুলি ঘটছিল, তার থেকেই তাঁর এই পছন্দের বিষয়টি বোঝা যায় ৷ তিনি ওই পরিস্থিতির সঙ্গেই কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন ৷ আর ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন ৷ আর এই প্রেক্ষিতেই দেখতে হবে তাঁর সিএএ-এনআরসি-এনপিআর আন্দোলনে যোগদানের বিষয়টি ৷ যেখানে তিনি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে মুসলিমদের একটি সম্প্রদায় হিসেবে শক্তিশালী হওয়া উচিত, কোনও ব্যক্তি হিসেবে নয় ৷

রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে যে রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতায় থেকেছে বা আছে, শারজিল তাদের সমালোচনা করেছে ৷ রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনতার পর থেকে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করেন শারজিল ৷ সেটাই এই সমালোচনায় প্রকাশ পেয়েছে ৷ এই রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিমদের জন্য কিছুই করেনি ৷ বরং তাদের নীতির মাধ্যমে বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছে ৷ এটা ব্যাখ্যা করার পর শারজিল বলেছেন মুসলিমদের নিজের অধিকারের দাবি তুলে ধরে এখন থেকে এগিয়ে যেতে হবে ৷ মুসলিমদের তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে ৷ তিনি নির্বাচনী ব্যবস্থার সমস্যাগুলি তুলে ধরে এই বিষয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে লড়াই করা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন ৷ তাই তাঁর বিশ্বাস সিএএ বিরোধী আন্দোলনই ছিল সঠিক সময় যখন ভারতীয় সমাজের গণতান্ত্রিক শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দর কষাকষি করা যায় ৷ আর ভারতীয় মুসলিমদের দেশের নাগরিক হিসেবে সমানাধিকার অর্জন করে নিন ৷ পাশাপাশি মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপও করতে হবে ৷

আরও পড়ুন : রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বিহার থেকে গ্রেপ্তার সারজিল ইমাম

শারজিল তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন প্রকাশ্যে ৷ তিনি অন্তত সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে এমন কিছু বিশ্বাস পোষন করেন না যা তাঁকে কারাগারের পিছনে ঠেলে দিতে পারে ৷ অথবা মুসলিম সমাজের প্রতি তাঁর যে বক্তব্য, তার জন্য তাঁকে একজন অপরাধীর মতো ছুটিয়ে বেড়ানো হচ্ছে ৷ তবে সমসাময়িক ভারতে তাঁর মুসলিম পরিচয় অপ্রত্যাশিত ভাবে এমন একটি বিষয় যার ভারতীয় সংস্কৃতিতে কোনও স্থান নেই বা সম্ভবত কখনও হয়নি । নিজের সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর বেশি কিছু দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ৷ আর তাঁর সত্যি বলার জন্য অকুতোভয় মনোভাবের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি রাজ্যে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে ৷ তাঁর বক্তব্যের জেরে কোনও হিংসা হয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ দায়ের হয়েছে ৷ যদি তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলির টাইমলাইনে চোখ রাখি এবং কীভাবে ঘটনাগুলি ঘটল, তা দেখি, তাহলে দেখা যাবে এই ঘটনাগুলি পর পর ঘটানো হয়েছিল ৷

এটা শুধুমাত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা যে শারজিলের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে তা নয়, এর মধ্যে তাদের শরিকরাও অংশ নিয়েছে ৷ শারজিল যেভাবে তাঁর সম্প্রদায়ের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের মুখোমুখি হতে অনেকটা এগিয়েছিল, উদারপন্থী এবং প্রগতিশীল কণ্ঠস্বরগুলির একটি বৃহত্তর অংশও একই ভাবে অনেকটা এগিয়ে যাওয়ার ব্যথা অনুভব করেছিল ৷ তাঁদের কাছে পৌঁছে শারজিল শুধু ভালো মুসলিম হিসেবে না থেকে সমান নাগরিক হিসাবে কথা বলার সাহস দেখিয়েছিলেন ৷ একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি হিসেবে সত্যিকে সত্যি হিসেবে বলেছিলেন । তাদের কাছে, কীভাবে একজন মুসলিম তাঁদের প্রতিনিধিত্বের দয়ায় থাকতে অস্বীকার করতে পারেন এবং কীভাবে কোনও মুসলিম যিনি নিজের চারিদিকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে, তিনি কীভাবে সীমার মধ্যে থাকতে অস্বীকার করতে পারেন ।

আরও পড়ুন : ফের তপ্ত জাফরাবাদ, চলল গুলি ; মৃত বেড়ে 13

শারজিল ইমাম এমন একজন মুসলিম, যাঁর অস্তিত্ব লিবারেল, প্রগতিবাদী এবং নাগরিক সমাজের বাকি অংশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের কল্পনার কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় ৷ এই সমালোচক মুসলিমদের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাষাও রয়েছে ৷ সেখানে সমানদের মতো কথা বলা এবং সমান নাগরিকের মতো অধিকার দাবি করা এবং মুসলিম হওয়ার অভিজ্ঞতা ও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি নিয়ে সমালোচনা করা হয় ৷ তাঁর রাজনৈতিক ভাষা কেবল ডানপন্থী রক্ষণশীলদের কাছেই নয়, কেন্দ্রীয়বাদী ও বামপন্থী উদারপন্থী ও প্রগতিবাদীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য নয় । এখন এই বিষয়টি কেন্দ্র এবং বামপন্থী নাগরিক সমাজ নিয়ে বেশি কথা বলে শারজিলের চেয়ে ৷

শারজিল ইমামকে দোষী সাব্যস্ত না করে তাঁ কারাবাস করার এক বছর হয়ে গিয়েছে । এই এক বছরে, তিনি অবশ্যই তাঁর পছন্দগুলি, তাঁর সিদ্ধান্তগুলি এবং তাঁর বর্তমান অবস্থার প্রতিফলন নিয়ে চিন্তা করেছেন । তাঁর ভাই মুজাম্মিল বারবার প্রকাশ্যে এটা বলেছেন যে শারজিল নিজেকে দোষী হিসেবে দেখেন না ৷ তিনি নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে দেখেন ৷ যিনি তাঁর সম্প্রদায়ের জন্য লড়াইয়ে বিশ্বাস করেন এবং ক্ষমা চাইতে না চাওয়া একজন মুসলিম হওয়ার জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত আছেন তিনি । তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত যদি গণতন্ত্র হয় এবং জনগণের বাকস্বাধীনতার অধিকার থাকে, তাহলে এটা কেন হচ্ছে ? কোনও ব্যক্তির বক্তব্য কেঁপে উঠতে পারে, ভারতের ঐক্য ও সুরক্ষা কি এতই স্পর্শকাতর ?

শারজিলের ঘটনায় 28 বছর বয়সী মুসলিম স্ট্যান্ড আপ কৌতুক অভিনেতা মুনাওয়ার ফারুকির সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে ৷ তিনি একটা হাস্যকৌতুক বলার জন্য প্রায় এক মাস ধরে জেল খাটছেন ৷ অথচ তিনি তা বলতে চাননি ৷ তবে মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করেছেন । হিন্দু দেবদেবী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগে বিজেপির এক বিধায়কের পুত্র অভিযোগ দায়ের করেন ৷ তার পর গত 1 জানুয়ারি রাতে ইন্দোর থেকে মুনাওয়ার ফারুকি এবং আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয় । কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্দোরের পুলিশ সুপার বিজয় ক্ষত্রি জানিয়েছেন যে ফারুকি একটি অনুষ্ঠানে হাস্যকৌতুক বলেননি ৷ তবে ‘বলতে যাচ্ছিলেন’ । এই একই পুলিশ প্রাথমিকভাবে দাবি করেছিল যে ফারুকি হিন্দু দেবদেবীদের বিরুদ্ধে ‘আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন’ ।

শারজীল ও ফারুকি উভয়ই এমন একটা কারণের জন্য জেলে গিয়েছেন, যা তাঁরা বলেননি ৷ আর তাঁরা দু’জনেই মুসলিম ৷ তাঁরা দুজনেই ভেবেছিলেন যে ভারতে একজন মুসলিম হিসেবে ও মুক্ত নাগরিক হিসেবে তাঁদের অধিকারগুলি এই দেশের সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থা দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে ।

কিন্তু এই দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি এখন কোথায়, যেখানে নাগরিকের জীবন ও স্বাধীনতা ধরে রাখার কথা বলা হয় ৷ সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলিকে হয় তাদের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য ভালো ভাবে দেখভাল করা হয় না ৷ অথবা সেই সব প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের মুসলমানদের ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে অক্ষম । জামিন হল বিধি এবং জেল তার ব্যতিক্রম ৷ এই আইনী নীতি কি মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় ৷ যেখানে গোটা প্রক্রিয়াটিকেই শাস্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে ৷ তাঁদের সাংবিধানিক ও মৌলিক মানবাধিকার প্রয়োগের জন্য এই ধরনের কোনও সমালোচনা মূলক কণ্ঠস্বর পাওয়া যাচ্ছে না ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.