হায়দরাবাদ: বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপ ! ছাত্র-ছাত্রীদের বহুল পরিচিত শব্দবন্ধ স্কুলের রচনার জনপ্রিয় 'বিষয়' ৷ স্কুল চিন্তা-ভাবনা, জীবনবোধের গোড়াপত্তন করলেও মুখস্তবিদ্যার দরুণ সভ্যতার অগ্রগতির এই চাকা কাকে কতদূর পৌঁছে দিয়েছে বা কতজনকে পিষে মেরেছে, তা তলিয়ে ভাবার সময় হয়নি ৷ অবশ্য ছাত্রাবস্থায় এই আপাত গুরুগম্ভীর বিষয়ের গভীরে গিয়ে অনুধাবন করাটাও হিমালয়ের চূড়ায় পৌঁছনোর মতোই কঠিন ৷
এই বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক সংযোজন এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (Artificial Intelligence) ৷ গোদা বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৷ যা দৌলতেই বিজ্ঞানের আশির্বাদ ও অভিশাপের দ্বন্দ্বের তফাৎ বোঝা গেল কয়েকদিন আগে, রেশ্মিকা মন্ধানার সুললিত মুখ এবং 'আপাত' যৌনগন্ধী শরীরের মেলবন্ধনে ৷ যেই অপরাধের মূলে রয়েছে ডিপফেক ৷
চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে ডিপফেক, সবই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফসল ৷ যার দৌলতে পৃথিবী এগোচ্ছে না বেআব্রু করে দিচ্ছে তার বাসিন্দাদের তা নিয়ে তরজা অব্যাহত ৷ যদিও চলতি বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গ্রাফ কতটা ঊর্দ্ধমুখী, তাই এই প্রতিবেদনের প্রতিপাদ্য ৷ ফলত কৃত্রিমতা কতটা হৃদয়গ্রাহী, তাতেই আমাদের ফোকাস থাকবে ৷
শিক্ষা থেকে বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা থেকে অর্থ, কৃষি থেকে বিভিন্নক্ষেত্রে উৎপাদন... অর্থাৎ সমাজের যা যা মূল ভিত্তি, প্রত্যেকটিতেই কৃত্রিমতা যে বাড়ছে এবং এই বুদ্ধিমত্তা যে উত্তরোত্তর নিজের ছাপ ফুটিয়ে তুলছে, তা দিবালোকের মতোই সুস্পষ্ট ৷
ফিরে দেখা কৃত্রিমতার উত্থান:
সালটা 1950 ৷ সবে স্বাধীনতার আলো দেখেছে ভারতবর্ষ ৷ কম্পিউটার তথ্যানুসন্ধানী জন ম্যাকার্থির মস্তিষ্কপ্রসূত শব্দ 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা' । শুরুর দিকে অগ্রগামীরা এমন যন্ত্রের কল্পনা করেছিলেন যা মানুষের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা এবং শেখার প্রক্রিয়াগুলিকে অনুকরণ করতে পারে ৷ পরবর্তী দশকগুলিতে প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি ঘটেছে ।
1960 থেকে শুরু হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাবলীল যাত্রা ৷ পরবর্তীতে 1970-80 সময়ে যার ভিত্তির গ্রাফ সবচেয়ে উর্ধমুখী ৷ ধীরে ধীরে শুরু মানুষের কর্মদক্ষতার সমতূল্য শুধু নয়, প্রত্যেকের ভবিষ্যৎ যাপনের চিত্রপট আঁকতেও পারদর্শী হয়ে উঠছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ৷ পার্থক্য শুধু, মানুষের মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের সম্পর্ক বরাবরই আদায়-কাঁচকলায় হলেও মস্তিষ্কের সমস্ত সিদ্ধান্তই হৃদয়গ্রাহী, আবেগ তাতে হলমার্কের মতো বরাবর ছাপ ফেলেছে ৷ বুদ্ধিমত্তার কৃত্রিম হতে শুরু করার পর তা কোনওভাবেই আবেগের ছোঁয়া পাচ্ছে না ৷
2023 সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা:
2023 সালকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বছর বললেও বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হবে না ৷ যা প্রতিনিয়ত রূপান্তরমূলক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ করেছে ৷ ওপেন-সোর্স এআই'য়ের বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ৷ একইসঙ্গে মাইক্রোসফ্ট ও গুগলের মতো টেক জায়ান্টদের শিল্পের মান নির্ধারণ করায় অবদান রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার । যদিও এই অগ্রগতি সত্ত্বেও কিছু বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না ৷ বিশেষত মেটা-এর লামা 2 প্রকাশের পর এআই'য়ের ওপেন সোর্সের প্রকৃত সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক দানা বেঁধেছে ।
চলতি বছরে জেনারেটিভ এআই মডেলের উত্থান, ভাষা প্রক্রিয়াকরণ এবং সৃজনশীল বিষয়বস্তু তৈরির নতুন আকার দেওয়া হয়েছে । ওপেন এআই'য়ের এর জিপিটি-4 একটি অসাধারণ টেক্সট-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন যা বিভিন্ন সৃজনশীল লেখা, কোডিং এবং জটিল সমস্যা সমাধানে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেছে । গুগল খুব তাড়াতাড়ি 4-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জেমিনি চালু করতে চলেছে ৷ যা পাঁচটি ফর্ম্যাটে- পাঠ্য, অডিয়ো, ভিডিয়ো, ছবি এবং কোডিংয়ের উপর কাজ করবে ৷
কোন কোন প্ল্যাটফর্মে প্রভাব ফেলেছে এআই ?
- এআইয়ের প্রভাব স্বাস্থ্যসেবা খাতে অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছে ৷ ডায়াগনস্টিকস এবং ওষুধ আবিষ্কারকে উন্নত করেছে । পাথ-এআই সিস্টেমের মতো সরঞ্জামগুলি ক্যানসার শনাক্তকরণের হার বাড়িয়েছে ৷
- ফাইন্যান্সে সুনির্দিষ্ট ট্রেডিংয়ের জন্য এআই অ্যালগরিদমকে জালিয়াতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী করে ৷
- টেসলা এবং ওয়েমোর যানবাহনগুলি এআইয়ের কারণে অগ্রগতি দেখেছে । টেসলার সম্পূর্ণ স্ব-ড্রাইভিং সিস্টেম ওয়েমো নতুন শহরে অটোমেটিক-ড্রাইভিং পরিষেবাগুলি বেড়েছে ।
- কোরসেরা (Coursera) এবং ইডিএক্স (edX)-এর মতো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এআই-এর সুবিধাও বেড়েছে ।
- এআই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ৷ ক্লাইম্যাট এআই (ClimateAI)-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলি এবং ভারডিগ্রিস (Verdigris)-এর মতো সিস্টেমগুলির খরচ কমিয়েছে । বেড়েছে ভবিষ্যৎবাণীর হার ৷
- সাইবারসিকিউরিটি এআইয়ের প্রভাবে সমাধানের হার বাড়িয়েছে । ডার্কট্রেস রিয়েল-টাইম হুমকি শনাক্তকরণের প্রস্তাব দিয়েছে এবং কোয়ালিসের দুর্বলতা স্ক্যানারগুলি সক্রিয় শনাক্তকরণ এবং প্যাচিংয়ে সহায়তা করেছে ।
ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলম্বিয়া অ্যান্ড বিসি ক্যানসারের গবেষকরা একটি এআই টুল তৈরি করেছেন যা ডাক্তারদের নোট বিশ্লেষণ করে ক্যানসারের বেঁচে থাকার 80% নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করে । একটি এআই টুল, 23-টেরাবাইট ডাটাবেস থেকে 200 মিলিয়ন প্রোটিনের কাঠামোর পূর্বাভাস দেয়, যা এই কাঠামোর উপর অনেক বেশি নির্ভর করে ওষুধের বিকাশের পথ খুলে দেয় । অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এআই মানুষের তুলনায় 400% নির্ভুল হিসেব দেয় । মানসিক স্বাস্থ্য মূল্যায়নের সুবিধা দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ।
কোন দিকে পিছিয়ে এআই ?
কৃত্রিমতা ৷ শব্দটা অনেক বেশি ক্যালকুলেটিভ, বাংলায় বললে আঙ্কিক ৷ যার মূলে রয়েছে কিছু ফর্মুলা, সংখ্যা ৷ এনকোড করা বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কপ্রসূত কিছু তথ্য ৷ মানুষের আবেগের সঙ্গে যার লক্ষ যোজন দূরত্ব ৷ ফলত এআই মানুষের মস্তিষ্কের ওপরও কেরামতি দেখায় কিছু নির্দিষ্ট ডেটা রিড করে ৷ ফলে অঙ্কের হিসেবে আবেগ মাপা হলে কাজটা যতটা ছন্নছাড়া হয়, মানব ঈন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে এআই'ও তাই ৷
- কমছে চাকরি: দুঃখ, কষ্ট, আনন্দের ভেলা পেরিয়ে সর্বোপরি ভালোবাসা, মেশিনকে এখনও শিখিয়ে উঠতে পারেনি বিজ্ঞান ৷ পাশাপাশি কৃত্রিমতার বাড়বাড়ন্তর সঙ্গে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক ৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্রমশ কমিয়ে ছোট করে আনছে চাকরির বাজার ৷ জনসংখ্যার বিস্ফোরণে যা বিশ্বের চিন্তার অন্যতম কারণ ৷
- বাড়ছে অপরাধ: রেশ্মিকা মন্ধানার সুললিত মুখ এবং 'আপাত' যৌনগন্ধী শরীরের মেলবন্ধন ৷ মাসকয়েক আগে একটি ভিডিয়োয় ছেঁয়ে গিয়েছিল নেটদুনিয়া ৷ ডিপফেকের ফলে বাড়ছে 'আইডেন্টিটি ক্রাইসিস', সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধ ৷ গত কয়েক বছরে ক্রমশ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার অপরাধ ৷ অন্যান্য জটিল বিষয় তো আছেই ৷
গুণিজনরা বলেন, সভ্যতার চাকা কতজনকে পিষল তা আপাত নিরিহ বিষয় ৷ বরং মূল কথা হল সেই চাকা সভ্যতাকে ঠিক কত কদম এগিয়ে দিল ৷ সুবিধা ও অসুবিধা একই মুদ্রার দু'টি পিঠ তা স্বীকার করেও জোর দিতে হয় সুবিধাতেই ৷ কারণ তার সঙ্গেই সাজুয্য়পূর্ণ মানুষের জীবনধারণ, যাপনের রাস্তা ৷ সেই রাস্তাকে আরও সরল ও সমান করাই সভ্যতার অন্যতম উদ্দেশ্য, একমাত্র বললেও বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হওয়ার কথা নয় ৷ ফলে 'অপরাধ', 'অসহায়তা', 'চাকরি নেই' এর মতো শব্দ ও শব্দবন্ধ মাথায় রেখে বলাই যায়, আবেগ ধরে রেখে কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম হলে আখেরে মানব সভ্যতারই লাভ, যা অস্বীকার করার রাস্তাটাই বরং বর্তমানে কণ্টকাদীর্ণ ৷
আরও পড়ুন: