উত্তরকাশী, 23 নভেম্বর: 398 ঘণ্টা পর অবশেষে টানেলের বাইরে এলেন শ্রমিকরা ৷ উদ্ধারকারী দলের 16 দিনেরও বেশি সময় ধরে নিরলস পরিশ্রমের পর দক্ষিণ আমেরিকার চিলি থেকে শুরু করে থাইল্যান্ডের সঙ্গে জুড়ল ভারতের নাম ৷ চিলিতে শ্রমিকদের উদ্ধার করা হয়েছিল 59 দিন পর ৷ থাইল্যান্ডের ফুটবলারদের উদ্ধার করতে লেগেছিল 18 দিন ৷ এবার 12 দিনের মাথায় উত্তরকাশীর নির্মীয়মান টানেলে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করে নজির গড়ল ভারত ৷ কোন পথে এগোলো উদ্ধারকার্য ? রইল তার টাইমলাইন ৷
12 নভেম্বর, 2023: দীপাবলির দিন ধস নামল টানেলে ৷ উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে ভোর 5.30টা নাগাদ নির্মীয়মান সিল্কিয়ারা-বারকোট টানেলে ধস নামে ৷ টানেলটি শুরুর কাছে প্রায় 150-200 মিটার অংশ ভেঙে পড়ে ৷ ভিতরে আটকে পড়েন 41 জন শ্রমিক ৷ চার ধাম অল ওয়েদার প্রজেক্টের অংশ এই সিল্কিয়ারা টানেলটি ব্রহ্মখাল-যমুনোত্রী হাইওয়েতে অবস্থিত ৷ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় স্থানীয় প্রশাসন ৷ শ্রমিকদের অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে থাকেন আধিকারিকরা ৷ একটি কমপ্রেসড পাইপের মাধ্যমে আটকে পড়া শ্রমিকদের কাছে শুকনো খাবার, জল, ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছনোর ব্যবস্থা করা হয় ৷ এনডিআরএফ, এসডিআরএফ, বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন বা বিআরও, এনএইচআইডিসিএল, ইন্দো-টিবেতান বর্ডার পুলিশ বা আইটিবিটির একটি যৌথ উদ্ধারকারী দল উদ্ধারকার্য শুরু করে ৷
13 নভেম্বর, 2023: পাইপের মাধ্যমে টানেলে আটকে থাকা শ্রমিকদের কাছে অক্সিজেন পৌঁছয় ৷ এই পাইপ দিয়েই ওই শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় ৷ জানা যায়, তাঁরা নিরাপদে আছেন ৷ মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামী সিল্কিয়ারা টানেলে পৌঁছন ৷ শ্রমিকদের উদ্ধারে 6 সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে উত্তরাখণ্ড সরকার ৷
পাশাপাশি চলতে থাকে টানেলের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ ৷ এর মধ্যে নতুন করে টানেলের উপর থেকে চাঙড় খসে পড়তে থাকে ৷ প্রায় 30 মিটার জুড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের আয়তন বেড়ে হয় 60 মিটার ৷ ওই স্তূপের মধ্যে দিয়ে 900 মিমি ব্যাসের স্টিলের পাইপ প্রবেশ করিয়ে, তার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের বের করার কথা ভাবে প্রশাসন ৷
14 নভেম্বর, 2023: সিল্কিয়ারা টানেলে পৌঁছয় 800 মিটার ও 900 মিটার ব্যাসের কয়েকটি স্টিলের পাইপ ৷ ধ্বংসস্তূপে অনুভূমিকভাবে ড্রিল করার কাজ শুরু হয় ৷ এদিকে ওই পাইপের মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অক্সিজেন, শুকনো খাবার, জল পাঠানোর ব্যবস্থা চলতে থাকে ৷
15 নভেম্বর, 2023: ভারতীয় বায়ু সেনার হারকিউলিস বিমানের সাহায্যে দিল্লি থেকে আমেরিকান ড্রিল মেশিন পৌঁছল উত্তরকাশীর টানেলে ৷ এদিনই এই অগার মেশিন দিয়ে টানেলের ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার কাজ শুরু হয় ৷ এর আগে যে ড্রিল মেশিনটি দিয়ে কাজ হচ্ছিল, তাতে গতি আসছিল না বলে মনে করে উদ্ধারকারী দল ৷ তাই দিল্লি থেকে নতুন মেশিন এসে পৌঁছয় ৷
16 নভেম্বর, 2023: হাই-পারফরম্যান্স আমেরিকান অগার মেশিন ইনস্টল করা হয় ৷ শুরু হল টানেলের মধ্যে ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার কাজ ৷
17 নভেম্বর, 2023: সারারাত কাজ করে ওই ড্রিল মেশিনের মাধ্য়মে ধ্বংসস্তূপের মাত্র 24 মিটার পর্যন্ত এগোনো সম্ভব হয়েছে ৷ 6 মিটার দীর্ঘ চারটি পাইপ বসানো হয় ৷ তবে পাঁচ নম্বর পাইপটি বসানোর সময় মেশিনের যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে ৷ ফের বাধার সম্মুখীন হয় উদ্ধারকারী দল ৷ থামানো হয় কাজ ৷ এনএইচআইডিসিএলের অনুরোধে ভারতীয় বায়ু সেনার বিমানে ইন্দোর থেকে আরও একটি ড্রিল মেশিন নিয়ে আসা হয় টানেলে ৷
18 নভেম্বর, 2023: শনিবারও থমকে থাকে উদ্ধারকার্য ৷ আমেরিকান অগার বা ড্রিল মেশিন চালানোর ফলে টানেলের মধ্য়েই ভাইব্রেশন তৈরি হয় ৷ আশঙ্কা করা হয়, ফের ধস নামতে পারে টানেলে ৷ এরই মধ্যে অনুভূমিকভাবে খোঁড়ার পাশাপাশি উল্লম্বভাবে খোঁড়ার কথাও ভাবেন উদ্ধারকারী দলের আধিকারিকরা ৷
19 নভেম্বর, 2023: এদিন কার্যত কাজ বন্ধই রাখা হয় ৷ উত্তরকাশীর নির্মীয়মান সিল্কিয়ারা টানেলটিকে লম্বালম্বি খোঁড়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছয় টানেলের কাছে ৷ তবে পাহাড়ি রাস্তায় ওই ভারী যন্ত্র নিয়ে যাওয়ায় সমস্যা তৈরি হয় ৷ এর মধ্যে টানেলের মধ্যে দিয়ে 6 ইঞ্চি ব্যাসের 39 মিটার দীর্ঘ একটি পাইপ স্থাপনের কাজ শুরু হয় ৷ অন্য সব বিকল্প পথ খোঁজা হলেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতীন গড়কড়ি পরামর্শ দেন, অনুভূমিকভাবে ধ্বংসস্তূপ খোঁড়াই নিরাপদ ৷ এদিনই শ্রমিকদের খাবারের সঙ্গে অ্য়ান্টিডিপ্রেস্যান্টও দেওয়া হয় ৷
20 নভেম্বর, 2023: সোমবার ভারতীয় বায়ুসেনার সি-16 এবং দু'টি সি-130 জে সুপার হারকিউলিস বিমান উদ্ধারকার্যে নিযুক্ত করা হয় ৷ এদিনও আইএএফের বিমানে 36 টন ওজনের জটিল যন্ত্রপাতি পৌঁছয় উত্তরকাশীর সিল্কইয়ারা টানেলের কাছে ৷ উত্তরকাশীর ঘটনাস্থলে আসেন আন্তর্জাতিক টানেলিং বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড ডিক্স ৷ এদিন রাতেই 6 ইঞ্চির পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রথম শ্রমিকদের কাছে গরম খাবার পাঠানো হয় ৷ আটকে থাকার নবম দিন রাতে তাঁরা গরম খিচুড়ি, ডাল খান ৷
21 নভেম্বর, 2023: ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দিয়ে 6 ইঞ্চির পাইপ স্থাপন করাটা একটা মাইলফলক ছিল ৷ এর মধ্যে দিয়ে এন্ডোস্কোপিক ক্যামেরা পাঠানো হয় শ্রমিকদের কাছে ৷ এই ক্যামেরার মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় ৷ মঙ্গলবার সকালে সেই ভিডিয়ো প্রকাশ করে উদ্ধারকারী দল ৷ শ্রমিকরা জানান, তাঁরা নিরাপদে আছেন এবং সুস্থ ৷ এদিনও তাঁদের এই পাইপের মধ্যে দিয়ে ভেজ পোলাও, মটর পনির, মাখন দেওয়া রুটি খেতে দেওয়া হয় ৷ পাশাপাশি অনুভূমিকভাবে খোঁড়ার কাজটিও শুরু করে উদ্ধারকারী দল ৷
22 নভেম্বর, 2023: মঙ্গলবার রাতভর ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার কাজ চলতে থাকে ৷ বুধবারও একইভাবে কাজ চলে ৷ এদিন রাতে প্রায় 50 মিটার পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের ভিতরে স্টিলের ছ'টি পাইপ বসানো হয় ৷ তবে পাইপের ব্যাস 900 মিমি থেকে কমিয়ে 800 মিমি করা হয় ৷ আর পাশাপাশি উল্লম্বভাবে খোঁড়ার জায়গাগুলি চিহ্নিত করার কাজও চলতে থাকে ৷ ইতিমধ্যে টানেলের মধ্যে ঢুকেছেন এনডিআরএফের উদ্ধারকারী কর্মীরা ৷ টানেলের ভিতরে রাখা হয়েছে অ্যাম্বুলেন্স ৷ রয়েছেন চিকিৎসকের একটি দল ৷ স্থানীয় একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে 41টি শয্যার হাসপাতালের বন্দোবস্তও করা হয়েছে ৷ উদ্ধারের পরেই শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হবে ৷
23 নভেম্বর, 2023: আজ 12 দিন ৷ উদ্ধারকারী আধিকারিকদের আশ্বাস, টানেলে আটকে থাকা শ্রমিকদের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছেন তাঁরা ৷ তবে এর মধ্যে ফের ধ্বংসস্তূপের মাঝে লোহার টুকরোয় ধাক্কা লেগে সাময়িক বন্ধ হল খোঁড়ার কাজ ৷ 6 ঘণ্টা ধরে সেই লোহাগুলি সরানোর পর ফের শুরু হল ধ্বংসস্তূপ খোঁড়ার কাজ ৷
24 নভেম্বর, 2023: বৃহস্পতিবার মনে করা হয়েছিল, হয়তো এদিন রাতেই টানেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন 41 জন শ্রমিক ৷ তবে তা হয়নি ৷ অগার মেশিনের প্ল্যাটফর্মে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে এবং ড্রিলিংয়ের কাজ বন্ধ করতে হয় ৷ এদিকে শুক্রবার সকালেই সিল্কিয়ারা টানেলের উদ্ধারকারী দলের অন্যতম শীর্ষ আধিকারিক ভাস্কর খুলবে সাংবাদিকদের জানান, সব ঠিক থাকলে এদিন সন্ধ্যা নাগাদই শ্রমিকদের কাছে পৌঁছনো যাবে ৷ 800 মিমি পাইপের রাস্তা দিয়ে শ্রমিকদের বের করে আনার মহড়া দেন এনডিআরএফ কর্মীরা নিজেরাই ৷ একটি স্ট্রেচারে শুয়ে ওই পাইপের মধ্য়ে দিয়ে বেরিয়ে আসেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা ৷
25 নভেম্বর, 2023: শুক্রবার বিকেল থেকে বিশাল ওজনের অগার মেশিনে কাজ শুরু হয় ৷ তবে এরপরেই 25 টন ওজনের মেশিনটিতে ফের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যায় ৷ একটি মেটাল গার্ডারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে ওই অগার মেশিনের ৷ ফের বন্ধ হয়ে যায় উদ্ধারকার্য ৷
26 নভেম্বর, 2023: অগার মেশিনের ব্লেড ভেঙে কাজ থমকে যায় ৷ জানা যায়, মেশিনের যন্ত্রাংশগুলি ওই টানেলের মধ্যে আটকে গিয়েছে ৷ সেগুলি বের না করা পর্যন্ত কাজ শুরু করা সম্ভব নয় ৷ পাশাপাশি অন্য উপায়ে 41 জন শ্রমিককে উদ্ধারের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন উদ্ধারকারী দলের বিশেষজ্ঞরা ৷ হাত দিয়ে খোঁড়া, ভার্টিকাল ড্রিলিংয়ের কথা ভাবা হয় ৷
27 নভেম্বর, 2023: ম্যানুয়াল ড্রিলিং বা হাতে ধ্বংসস্তূপর খোঁড়ার কাজ শুরু হয় ৷ এর জন্য ব়্যাট হোল প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হয় ৷ পাশাপাশি চলতে থাকে ভার্টিকাল ড্রিলিং অর্থাৎ টানেলের উপর দিয়ে ড্রিলিংয়ের কাজও ৷
28 নভেম্বর, 2023: আজ 17তম দিনে অসম্ভবকে সম্ভব করল উদ্ধারকারী দল ৷ মঙ্গলবার দুপুর 2টোর খানিক আগেই ড্রিলিংয়ের কাজ শেষ করেন উদ্ধারকারী দল ৷ 16 দিনেরও বেশি সময় উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারা টানেলে বন্দি 41 জন শ্রমিক ৷ আলো দেখলেন বন্দি শ্রমিকরা ৷
আরও পড়ুন: