কলকাতা, 9 অগস্ট: কয়েক দশকের ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার ও অন্যায় সহ্য করে বহু ত্যাগ ও প্রাণের বিনিময়ে 1947 সালে 15 অগস্ট মুক্তির স্বাদ পেয়েছিল দেশ ৷ বিদেশি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে সেদিন স্বাধীনতার এক অনির্বাণ জ্যোতি জ্বেলেছিল ভারতবাসী ৷ যা আজও স্বগর্বে প্রজ্জ্বলিত ৷ ওইদিন লালকেল্লা থেকে প্রথমবারের জন্য উত্তোলিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা, তেরঙা ৷ উত্তোলন করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ৷ বড় সাধের সেই স্বাধীনতা ৷ গর্বের, আবেগের, দেশের কোটি কোটি নাগরিকের পরিচয়ের সেই স্বাধীনতা নানা পথ পেরিয়ে 75 বছরে পড়ছে ৷ বলা যায় 1947 সালের 15 অগস্ট যে চারা গাছ মাথা তুলেছিল আজ তা 75 বছরের মহীরূহ ৷
স্বাধীনতার 75 বছর উদযাপন করছে দেশ ৷ দেশের প্রতিটি নাগরিককে বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ চলছে বর্ষব্যাপী 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' ৷ আজ দেশ যে স্বাধীনতার 75 বছর উদযাপন করছে (75 Years of Independence), তার কৃতিত্বের সর্বপ্রথম দাবিদার নাম জানা-অজানা এমন বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী যাঁরা ব্রিটিশ দাসত্ব-শৃঙ্খল মোচনে লড়েছিলেন ৷ বলা যায়, বহু বছর আগে নিজেদের রক্ত, ত্যাগ, ব্যক্তি স্বার্থ বিসর্জন, প্রাণ বলিদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার ভিত নির্মাণ করেছিলেন তাঁরা ৷ সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে কখনও অহিংস, কখনও বা অস্ত্রের হাত ধরে ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন আমার-আপনার পূর্ব পুরুষরা ৷ স্বাধীনতার 75 বর্ষ পূরণের এই প্রাকলগ্নে আমরা স্মরণ করব দেশের এমনই কিছু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, যাঁদের অবদান, ত্যাগ, লড়াই ও নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভবত এই মুক্তির শিখা প্রজ্জ্বলন সম্ভব হত না ৷
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার 75 বছরে অস্ত্রসম্ভারে আধুনিক হয়েছে ভারতীয় সেনা
মহাত্মা গান্ধি: ভারতের স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ ধরা হয় মহাত্মা গান্ধিকে (Mahatma Gandhi) ৷ যাঁর আসল নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ৷ সঠিক অর্থেই তাঁকে আজও 'জাতির জনক' নামে অভিহিত করা হয় ৷ অহিংস পথে, পালটা রক্ত না-ঝরিয়েও যে ব্রিটিশ শাসনের শিকড় এদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলা সম্ভব তা দেখিয়েছিলেন মহাত্মা ৷ চম্পারণ সত্যাগ্রহ থেকে অসহযোগ আন্দোলন, লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলন থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন, গান্ধির ডাকে পথে নেমেছিলেন লাখ লাখ দেশবাসী ৷ 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে' ডাক দিয়ে একবৃদ্ধ লাঠি হাতে, ঝুঁকে পড়া শরীরে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছেন, আর তাঁর পিছন পিছন হাঁটছেন দেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতা ৷ দেশের স্বার্থে তিনি অনশন করেছেন, মাসের পর মাস জেল খেটেছেন ৷ কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের অদম্য জেদ ছাড়েননি ৷ মহাত্মা গান্ধি পেরেছিলেন এভাবেই সম্পূর্ণ অহিংস পথে হেঁটে ব্রিটিশ শাসকের রাতের ঘুম কেড়ে নিতে ৷ বলা যায় স্বাধীনতা অর্জনে দেশবাসীকে পথ দেখিয়েছিলেন মহাত্মা, তাই আক্ষরিক অর্থেই তিনি 'জাতির জনক' ৷
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু: ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের আরেক নায়ক হলেন সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji Subhas Chandra Bose) ৷ মহাত্মা গান্ধির কিছুটা উলটো পথে হেঁটেই সশস্ত্র আন্দোলন ও লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশমাতৃকাকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এই বাঙালি বীর সন্তান ৷ ব্রিটিশ রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে গড়েছিলেন পরাধীন ভারতের প্রথম সরকার ৷ তাঁর নেতৃত্বেই পূর্ণতা পেয়েছিল 'আজাদ হিন্দ বাহিনী' ৷ তাঁর দৃপ্ত কণ্ঠে, "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" এই আহ্বান শতশত তরুণ-তরুণীকে উদ্বুদ্ধ করেছিল দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিতে ৷
আরও পড়ুন: পিস্তলে মাত্র একটা গুলি, আর তাতেই নিজেকে শেষ করেছিলেন বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদ
ভগৎ সিং: ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক উল্লেখযোগ্য নাম ভগৎ সিং (Bhagat Singh) ৷ সেই অগ্নিযুগের শহিদ বিপ্লবীদের মধ্যে অন্যতম হলেন তিনি ৷ দেশের স্বার্থে মাত্র 23 বছর বয়সে নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন এই বীর বিপ্লবী ৷ ব্রিটিশ শাসকদের বার্তা দিতে 1929 সালের 8 এপ্রিল সঙ্গী বটুকেশ্বর দত্তকে নিয়ে দিল্লির সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বোমা মেরেছিলেন ভগৎ সিং ৷ যদিও কাউকে হত্যা নয়, ব্রিটিশদের ভয় পাওয়ানোই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য ৷ গ্রেফতার করা হয় তাঁকে ৷ এরপর জন সন্ডার্সের হত্যা-সহ একাধিক মামলায় তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় ৷ 1931 এর 23 মার্চ লাহৌর সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি হয় এই বিপ্লবীর ৷
লক্ষ্মীবাঈ: দেশের স্বাধীনতার জন্যে পুরুষদের পাশাপাশি যে মহিলারা নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ (Rani of Jhansi Lakshmibai) ৷ স্বামীর মৃত্যুর পর ইংরেজদের হাত থেকে নিজের প্রাণের ঝাঁসিকে বাঁচাতে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন তিনি ৷ পিঠে শিশুপুত্রকে বেঁধে তলোয়ার হাতে ইংরেজ সৈনিকদের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই আজও ভারতীয় মহিলাদের অদম্য জেদ ও সাহসিকতার প্রতীক ৷ গোয়ালিয়রের যুদ্ধে মাত্র 29 বছর বয়সে 1858 সালের 18 জুন প্রাণ হারান তিনি ৷
আরও পড়ুন: 'হর ঘর তিরঙ্গা', স্বাধীনতার 75 বছরে রেকর্ড চাহিদা জাতীয় পতাকার
মাতঙ্গিনী হাজরা ও ক্ষুদিরাম বসু: ভারত তথা বাংলার মহিলা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম করলে যে নামগুলি সবার আগে উঠে আসে তাঁদের মধ্যে অন্যতম মাতঙ্গিনী হাজরা (Matangini Hazra) ৷ অবিভক্ত মেদিনীপুরের এই বীরাঙ্গনা 'গান্ধি বুড়ি' নামেও পরিচিত ৷ পিছাবুনি গ্রামের এই বৃদ্ধা মহিলা মহাত্মা গান্ধির আহ্বানে সাড়া দিয়ে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনে' যোগ দিয়ে ইংরেজ পুলিশ বাহিনীর গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন 72 বছর বয়সে ৷ তমলুক পুলিশ স্টেশনের সামনে তাঁকে গুলি করেছিল ইংরেজরা ৷ দু'হাতে ও মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়েও জাতীয় পতাকা মাটিতে পড়তে দেননি মাতঙ্গিনী ৷ 'বন্দেমাতরম, ইংরেজ ভারত ছাড়ো' বলতে বলতেই 1942 সালের 29 সেপ্টেম্বর শহিদ হন 'গান্ধি বুড়ি' ৷
দেশের কনিষ্ঠতম স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাঁরা দেশের স্বার্থে প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বঙ্গ সন্তান ক্ষদিরাম বসু (Khudiram Bose) ৷ মাত্র 15 বছর বয়সে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে ব্রতী করেছিলেন মেদিনীপুরের এই বীর সন্তান ৷ কুখ্যাত ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম ও তাঁর সঙ্গী প্রফুল্ল চাকি ৷ সেই চেষ্টা সফল না-হলেও ভুলবশত তাঁদের নিক্ষেপ করা বোমাতে মারা যান মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা ৷ পুলিশ ধরার আগেই প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন ৷ ক্ষুদিরাম বসুকে গ্রেফতার করা হয় ৷ বিচারের পরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয় ৷ 1908 সালের 11 অগস্ট মাত্র 18বছর বয়সে হাঁসতে হাঁসতে ফাসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেন তিনি ৷
দীর্ঘ কয়েক দশকের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে, বিপ্লবীদের সংখ্যা ও অবদান বলে শেষ করার নয় ৷ এখানে আলোচিত এই সংগ্রামীরা সেই ভাণ্ডারেরই কয়েকজন রত্ন মাত্র ৷ এরকম হাজারো বিপ্লবীর সাহস ও তাঁদের ত্যাগের উপর ভর করেই আজ আমরা 75 বছরের স্বাধীনতা উদযাপন করছি ৷ দেশের প্রত্যেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ইটিভি ভারতের শ্রদ্ধা ও প্রণাম ৷