নয়াদিল্লি, 5 অক্টোবর: গত মাসে নয়াদিল্লিতে সফলভাবে জি20 শীর্ষ সম্মেলন করেছে ভারত ৷ এর পরবর্তী একমাসে আচমকাই প্রতিবেশী থেকে বিশ্বের অন্য অংশে দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির ক্ষেত্রে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছে নয়াদিল্লি ৷
এই চ্যালেঞ্জ প্রথম শুরু হয় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে দিয়ে ৷ তিনি অভিযোগ করেন যে কানাডায় হরদীপ সিং নিজ্জর খুনে হাত রয়েছে ভারতীয় এজেন্টদের ৷ নিজ্জর কানাডার নাগরিক হলেও ভারতের কাছে তিনি ছিলেন খালিস্তানি জঙ্গি ৷ তাঁর বিরুদ্ধে এদেশে অনেক অভিযোগ দায়ের হয়েছিল ৷
তার পরও জি20 শীর্ষ সম্মেলন থেকে ফিরে কানাডার হাউজ অফ কমন্সে দাঁড়িয়ে ট্রুডোর এই অভিযোগ বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলে দেয় ৷ উল্লেখ্য, জি20 শীর্ষ সম্মেলনের সময় নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ট্রুডো ৷ সেই বৈঠকে কানাডায় খালিস্তানিদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে কড়াবার্তা দেওয়া হয়েছিল ভারতের তরফে ৷
এর পর দুই দেশের সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৷ কূটনীতিক বহিষ্কার থেকে ভিসা দেওয়া বন্ধের মতো পদক্ষেপ করতে দেখা যায় ভারতকে ৷ কানাডা অবশ্য ট্রুডো অভিযোগ করার পরপরই এক ভারতীয় কূটনীতিক বহিষ্কার করে ৷ নয়াদিল্লি আবার কানাডাকে এখানে থাকা দূতাবাসের কর্মী সংকোচনও করতে বলেছে ৷ তাছাড়া নিজ্জরকে খুন নিয়ে কানাডার দাবি বিদেশমন্ত্রকের তরফে বিবৃতি দিয়ে খারিজ করা হয় ৷
তবে পরের দিকে কানাডা কিছুটা সুর নরম করে ৷ ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সমস্যা দূর করতে ‘ব্যক্তিগত আলোচনা’ চায় ৷ ওই দেশের বিদেশমন্ত্রী মেলানি জলি গ্লোবাল নিউজকে এই কথা জানান ৷ তিনি বলেন, "আমরা কানাডিয়ান কূটনীতিকদের নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিই, এবং আমরা ব্যক্তিগতভাবে জড়িত থাকব ৷ কারণ, আমরা মনে করি যে কূটনৈতিক কথোপকথনগুলি যতক্ষণ ব্যক্তিগত থাকে, ততক্ষণই সর্বোত্তম ।"
সেপ্টেম্বরের শুরুতে ভারতের তরফে আর্লি প্রগ্রেস ট্রেড এগ্রিমেন্ট বা ইপিটিএ আলোচনা স্থগিত করা হয়েছিল । এই চুক্তি ভারত ও কানাডার মধ্যে একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির বা সিইপিএ দিকে প্রথম পদক্ষেপ । ওই আলোচনা থেমে যাওয়ার পরই ট্রুডো এই বিস্ফোরক অভিযোগ করেন ৷
জানা গিয়েছে, কানাডা তাদের মাটিতে ধ্বংসাত্মক শক্তিকে সাহায্য করছে বলেই বাণিজ্য আলোচনা ভারতের তরফে স্থগিত করে দেওয়া হয় ৷ তাছাড়া কানাডা থেকে যে সামগ্রী ভারত আমদানি করে, তা অন্য কোনও বন্ধু দেশ থেকে আমদানি করতে পারবে ৷ শিল্পের অনুমান অনুসারে, সিইপিএ ভারত-কানাডা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে 6.5 বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাড়িয়ে দিতে পারে, যা 2035 সালের মধ্যে কানাডার জন্য 3.8 বিলিয়ন থেকে 5.9 বিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপি লাভে সাহায্য করবে ।
ভারত ও কানাডার মধ্যে এই দ্বন্দ্বের মধ্যে নয়াদিল্লি আরও একটি কূটনৈতিক ধাক্কা খেয়েছে ৷ কারণ, আজারবাইজানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আর্মেনিয়া নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চলটি হারিয়েছে ৷ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ ককেশাসের ওই অঞ্চলটি, আজারবাইজানের কাছে হারিয়েছে আর্মেনিয়া ৷ আর এই যুদ্ধে ভারত আর্মেনিয়াকে সমর্থন করে আসছে ।
আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান বিতর্কিত নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে একটি জাতিগত এবং আঞ্চলিক সংঘর্ষে জড়িত । গত 19 সেপ্টেম্বর আজারবাইজান একটি আকস্মিক সামরিক আক্রমণ শুরু করে । পরেরদিনই নাগর্নো-কারাবাখ সরকার আত্মসমর্পণে সম্মত হয় ৷ যার ফলে একটি যুদ্ধবিরতি ঘটে । নাগর্নো-কারাবাখ সরকার আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র হিসেবে কার্যত একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল ৷ 28 সেপ্টেম্বর আর্টসাখের সভাপতি সামভেল শাহরামানিয়ান একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেন, যাতে বলা হয়েছে যে আগামী 1 জানুয়ারির মধ্যে সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যাবে ৷ এর ফলে প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্বের অবসান ঘটবে । আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধের সাম্প্রতিক পরিণতি নিয়ে এখনও ভারতের তরফে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি ৷
যদিও ভারত মধ্য এশিয়ার উভয় দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখে ৷ তার পরও এই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পাশে ছিল নয়াদিল্লি ৷ তাদের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্যও করেছিল ৷ সেই কারণে দুই দেশের মধ্যে আড়াই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তিও হয় ৷ ককাসাস ও ইউরেশিয়ার অংশে তুরস্কের প্রভাব বৃদ্ধি আটকাতেই আর্মেনিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত ৷
উল্লেখ্য, এই যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে ছিল পাকিস্তান ৷ তারা লোকবল ও সামরিক সাহায্য করেছিল মধ্য এশিয়ার এই দেশকে ৷ কারণ, তুরস্ক, আজাকবাইজান, পাকিস্তান এবং অন্য তুরস্ক কেন্দ্রিক দেশগুলি আর্মিনিয়ার ভূখণ্ডে কর্তৃত্ব কায়েম করতে চায় ৷ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এই দেশগুলি সমস্বরে 2019 সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ধারা 370 তুলে দেওয়ার বিরোধিতা করেছিল ৷
ভারতের তরফে আর্মেনিয়াকে সমর্থন করার আরেকটি কারণ হল ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর ৷ যাতে ভারতের একটি বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে । এই করিডরে ভারত, ইরান, আজারবাইজান, রাশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহণ হবে ৷ এর জন্য জাহাজ, রেল এবং সড়ক পথের একটি 7,200 কিমি দীর্ঘ মাল্টি-মডেল নেটওয়ার্ক তৈরি হবে । এই রুটে প্রাথমিকভাবে ভারত, ইরান, আজারবাইজান এবং রাশিয়া থেকে জাহাজ, রেল ও সড়কপথে পণ্য পরিবহণ হবে । যেহেতু প্রকল্পটি খুব বেশি অগ্রগতি করছে না, আর্মেনিয়াকে এমন একটি দেশ হিসাবে দেখা হচ্ছে, যা আজারবাইজানের পরিবর্তে একটি কার্যকর বিকল্প করিডর সরবরাহ করতে পারে ।
ভারত তৃতীয় কূটনৈতিক ধাক্কা এসেছে মালদ্বীপ থেকে ৷ সেখানে চিনপন্থী হিসেবে পরিচিত মহম্মদ মুইজু প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৷ তিনি হারিয়েছেন ওই দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহকে ৷ এই সোলিহ ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত ৷
তিনি আগামী 17 নভেম্বর দায়িত্ব ৷ তার পর তিনি ভারত সম্পর্কে কী নীতি নেন, সেই দিকেই তাকিয়ে নয়াদিল্লি ৷ মালদ্বীপ যেহেতু ভারত মহাসাগরে অবস্থিত ৷ তাই ওই দেশের কূটনৈতিক অবস্থান ভারতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ৷ 2013 থেকে 2018 পর্যন্ত ওই দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল না ৷ সোলিহর সময়ে তা ভালো হয় ৷ তা কি আবার খারাপ হবে ৷ মুইজ্জু ইতিমধ্যে জানিয়েছেন যে ভারতের সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলি তিনি খতিয়ে দেখবেন কিন্তু ওই প্রকল্পগুলি রূপায়ণে কোনও বিঘ্ন ঘটাবেন না ৷ তাঁর অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয় ৷
মনোহর পর্রীকর ইনস্টিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিস-এর অ্যাসোসিয়েট ফেলো আনন্দ কুমার বলেন, "গত বছর, যখন মুইজু চিন সফর করেন, তখন তিনি চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বৈঠকের সময় বলেছিলেন যে তাঁর দল ক্ষমতায় এলে মালদ্বীপ ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি হবে । চিনের সুবিধার জন্য তিনি ভারতের স্বার্থের কতটা ক্ষতি করেন, সেটাই দেখার বিষয় ।"
মালদ্বীপে চিনের প্রভাব কাটাতে ভারত সেখানে বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়নে সাহায্য করেছিল ৷ চিনও পালটা মালদ্বীপকে ঋণের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে ৷ এই পরিস্থিতিতে আগামিদিনে ভারতের বৈদেশিক কূটনীতি কোন পথে যায়, সেটাই এখন দেখার ৷
আরও পড়ুন: ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে খুবই গুরুত্ব দেয় কানাডা, বললেন ট্রুডো