ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কথা আজও সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য । যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, নির্বাচনে চূড়ান্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে জয়, মোটেই বিজয় নয় । রাজনৈতিক দলগুলি আইন দ্বারা নির্ধারিত নীতি লঙ্ঘণ করার জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে, এবং এ কারণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলি মারাত্মক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় । তামিলনাড়ু, পুদুচেরি, কেরালা এবং অসমে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে । পশ্চিমবঙ্গে এ মাসের 29 তারিখ পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে । এই পশ্চিমবঙ্গেই রাজনৈতিক চপানউতোরের পরিবেশ তৈরি হয়েছে ।
নির্বাচন কমিশন অতি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিল, তারা 6400টি ভোট কেন্দ্রকে সমস্যাবহুল হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং রাজ্যে অবাধ ও শান্তপূর্ণ নির্বাচন করানোর জন্য আট দফার নির্বাচনের তদারকির দায়িত্বে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে মোতায়েন করা হচ্ছে । তবে, আদর্শ নির্বাচন বিধি কার্যকর করার ব্যাপারে নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে । 2016 সালের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপি মাত্র তিনটি আসন জেতেছিল । 2019 সালের সাধারণ নির্বাচনে 18টি আসন পেয়ে বিজেপি হস্ত প্রসারিত করেছিল । দলটি এখন রাজ্য থেকে তৃণমূলকে উৎখাত করতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে । মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই চ্যালেঞ্জটি সর্বতভাবে গ্রহণ করেছেন । বিজেপির বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াই ছুঁড়ে দিতে গিয়ে নির্বাচন বিধিভঙ্গের দায়ে পড়েছেন ।
মমতা দিদি, তাঁর জনপ্রিয়তার জন্য পরিচিত ৷ অভিযোগ করেছেন, কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করছে, কিন্তু, বিজেপি নেতারা অনেক বাড়াবাড়ি করলেও সে বিষয় অন্ধ থেকে গিয়েছে ৷ 'মডেল কোড অব কনড্যাক্ট'কে 'মোদি কোড অব কনড্যাক্ট' বলেও কটাক্ষ করেছেন তিনি ৷ এই পুরো পর্বে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, যা নিঃসন্দেহে গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক ৷
এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, এম এস গিল মুখ্য নির্বাচন কমিশনার থাকার সময় বলেছিলেন, প্রতিটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের উচিত তাদের চারপাশে সাংবিধানিক বৃত্ত তৈরি করা ৷ এবং যাতে কোনওভাবেই তার বিচ্যুতি না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ৷
আরও পড়ুন: কমিশনের নির্দেশে রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ কর্তা সহ একাধিক বদল
প্রায় সাত দশক আগে সংবিধানের জনক ড. বিআর অম্বেদকর বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে বিতর্ক রোধ করতে আলাদা ব্যবস্থা করা উচিত ৷ অবাক করার মতো বিষয় হল, তাঁর এই পরামর্শ আজ পর্যন্ত কোনওভাবেই কার্যকর হয়নি ৷ কেন্দ্রের সদিচ্ছার কারণেই নির্বাচন কমিশনের উচ্চ আসনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় ৷ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে ৷ নবীন চাওলা পর্বে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ৷ গোপাল স্বামী চাওলা সম্পর্কে কড়া রিপোর্টে দেওয়ার পরও তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করেছিল ৷ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বাইরের লোকের কাছে সরকারের গোপন তথ্য ফাঁস করেছেন ৷ গত সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনার লাভাসা অভিযোগ তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং অমিত শাহের বিরুদ্ধে ক্লিন চিট দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের ৷ যদিও তাঁকে শেষ পর্যন্ত সরে যেতে হয় ৷
সংবিধানের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি তখনই গুরুত্ব পাবে এবং তার কার্যকারিতা সঠিক প্রমাণিত হবে, যখন এমন কোনও ব্যক্তির দ্বারা তা পরিচালিত হবে, যিনি সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে কোনও মূল্যেই আপস করবেন না ৷ প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, বিরোধী দলনেতার দ্বারা গঠিত একটি কমিটি বেছে নিক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার-- এই দাবি ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে ৷ বিজেপির লৌহ পুরুষ লালকৃষ্ণ আদবানিও এই পদ্ধতির উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন ৷ তবে, বিজেপি পুরো বিষয়টা আজ নিজেদের কৌশলে পরিণত করেছে ৷ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে কমিটি গঠনের বিষয়টি আজ সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের বিবেচনায় রয়েছে ৷
ভোটাধিকারের মাধ্যমে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী সরকার গঠনই হল গণতন্ত্রের আসল ভিত্তি ৷ এটা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া উচিত, জনসাধারণের আস্থাকে রক্ষা করতে হলে নির্বাচন কমিশন এবং মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টিকে স্বচ্ছ করতে হবে ৷ এ বিষয়ে সংসদের কাছে নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহিও করা উচিত ৷