সবার জন্য সমান অধিকার থাকবে এমন এক আদর্শ সমাজ স্থাপন করতে শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি । শিক্ষা সংক্রান্ত গান্ধির চিন্তাধারা তাঁর নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ । গান্ধি অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইংরেজদের চাকরি ও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে বর্জন করতে বলেছিলেন । সেই সময় এই ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে ভারতীয়দের 'মৌলিক শিক্ষা'-কে রূপ দিতে তৎপর হন । সেই মতো গান্ধির নেতৃত্বে ও জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদনক্রমে কংগ্রেস শাসিত বিভিন্ন প্রাদেশিক শিক্ষা দপ্তর "নই তালিম" বা বুনিয়াদি শিক্ষাকে তাদের শিক্ষানীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল ।
গান্ধি দীর্ঘসময় ধরে নানা পরীক্ষার পর তাঁর শিক্ষাচিন্তা ভারতবাসীর সামনে উপস্থিত করেছিলেন । গান্ধির এই "নই তালিম" নীতির মূলে ছিল হস্তশিল্প শিক্ষার মাধ্যমে ভারতীয়দের স্বনির্ভর করে তোলা । তবে স্বাধীনতার পর গান্ধির এই নয়া শিক্ষাপদ্ধতি ধীরে ধীরে ব্রাত্য হয় ।
ভারতের প্রয়োজন গান্ধি অনুধাবন করেছিলেন । নানা জাতি নানা ভাষা নানা ধর্ম নানা সংস্কৃতির মানুষকে ভারতে একত্রিত রাখতে হলে চাই জাতীয় সংহতির চেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতার মানসিকতা, চাই অস্পৃশ্যতার বর্জন, চাই পরমত সহিষ্ণুতা, চাই অহিংসাকে জীবনে প্রয়োগ । গান্ধি তাই তাঁর শিক্ষানীতির কয়েকটি মূলসূত্র রচনা করেছিলেন : প্রীতি (সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব), মুক্তি, অভিব্যক্তি (নানা সৃজনশীল কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা), অহিংসা, সত্যাগ্রহ (সত্যের প্রতি আগ্রহ, অসত্যের প্রতিরোধ), সাফাই (পরিবেশ চেতনা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা) ।
গান্ধি বলতেন, পাশ্চাত্যের শিল্প ও বাণিজ্য ভিত্তিক সমাজ হিংসার উৎস । তাঁর মত ছিল আধুনিক সভ্যতা যন্ত্র নির্ভর । এই সভ্যতা থেকে উঠে আসে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধভিত্তিক অর্থনীতি । আধুনিক সমাজে যন্ত্রের ব্যবহার করে অর্থ ভোগ করবে শুধু মুষ্টিমেয় মানুষ । কিন্তু গোটা বিশ্বের শান্তি বা সুখ এইভাবে আসবে না । একটা শিল্পসমাজ কেবল পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে যাবে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে । সেটাই বারবার অর্থনীতিতে ধস আনবে । পশ্চিমের সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের বদলে গান্ধি তাই গ্রাম নির্ভর অর্থনীতি ও কর্মকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন ।
একুশ শতকে গোটা বিশ্ব আর্থ-সামাজিক সংকটের মুখে । তাই ফের গান্ধির নয়া শিক্ষানীতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে । পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে আলোচনা প্রয়োজন । আধুনিক শিক্ষাধারায় গান্ধির শিক্ষানীতি অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না? বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা লক্ষ্য করে গান্ধির আদর্শে অনুপ্রাণিত কিছু শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবী এখনকার পটভূমিতে বুনিয়াদি শিক্ষাকে প্রয়োগ করার কথা বলছেন । পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী ভাবে জীবনমুখী এক সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করা যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা আশু প্রয়োজন ।