ভারতের সীমায় পাকিস্তানের অনুপ্রবেশ রুখতে আমাদের ভারতীয় তরুণ অফিসার এবং সেনা জওয়ানরা সবসময় সাহস , দৃঢ়তা এবং সংকল্পের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । এইভাবেই অনেকে দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে ।
বিভিন্ন পদে নিযুক্ত চারজন তরুণ সেনা জওয়ান , দু'জন অফিসার , দু'জন সৈনিক যাঁরা ভারতের সর্বোচ্চ বীরত্বের পুরস্কার পরম বীর চক্র পুরস্কার পেয়েছেন , তাঁদের সাহসিকতা ও বীরত্বের গল্পগুলি জেনে নেওয়া যাক...
গ্রেনেডিয়ার যোগেন্দ্র সিং যাদব : টাইগার হিল দখলের সময় প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন এই গ্রেনেডিয়ার । সেই কারণে তিনি পরম বীর চক্র পুরস্কার পেয়েছেন ।
- গ্রেনেডিয়ার যোগেন্দ্র সিং যাদব ঘাতক কমান্ডো দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন । 1999-এর 3 বা 4 জুলাই রাতে টাইগার হিল দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁকে ।
- গন্তব্যস্থান ছিল প্রায় 16 হাজার 500 ফিট উচ্চতায় খাড়া , তুষার আবৃত , পাথুরে এলাকা । তিনি স্বেচ্ছায় এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং একটি দড়ি জোগাড় করে তার সাহায্য নিয়ে উপরে ওঠার জন্য দলের বাকি সদস্যদের অনুসরণ করতে বলেছিলেন ।
- ঘাতক কমান্ডো শত্রুদের অবাক করে দিতে সক্ষম হয়েছিল । তাদের দলকে উপরে পৌঁছাতে দেখে শত্রুপক্ষের তরফ থেকে যোগেন্দ্র সিং যাদব এবং আরও দুই ভারতীয় সেনার উপর গোলা বর্ষণ , গ্রেনেড হামলা শুরু হয় ।
- এরপর দলের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যায় ।
- পরিস্থিতি বুঝে , এই হামলা বন্ধ করার জন্য যোগেন্দ্র সিং যাদব হামাগুড়ি দিয়ে নিজে শত্রু স্থানে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক গুলির আঘাত সহ্য করেন ।
- সমস্ত আঘাত সহ্য করে এবং সাহসের সঙ্গে তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিজের রাইফেল থেকে গুলি চালাতে চালাতে ক্রমাগত শত্রুপক্ষের ঘাঁটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন এবং এই অবস্থাতেই গ্রেনেড ছোড়েন ।
- তিনি খুব কাছ থেকে বলা যেতে পারে হাতাহাতি পর্যায়ে গিয়ে চারজন পাকিস্তানি সেনাকে খতম করেন ।
- এই ঘটনার সময় যখন পালটা আক্রমণ চলছিল তখন তাঁর বাঁদিকের বাহুতে এবং ডানদিকের পায়ে আঘাত লাগে ।
- এই অবস্থাতেও অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি আর একটি শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন । তাঁর এই সাহস এবং মনের জোড় দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ঘাতক দলের বাকি সদস্যরা প্রতিহিংসায় শত্রপক্ষের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং টাইগার হিলের দখল নিতে সক্ষম হন ।
রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমার
মাশকোহ উপত্যকায় পয়েন্ট 4875 দখলে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তিনি ।
- 4 জুলাই 1999 । মাশকোহ উপত্যকায় 4875 পয়েন্টের উচ্চ এলাকা দখল করার জন্য তিনি আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ।
- তাদের পথ আটকানোর জন্য ও অগ্রগতি রুখে দেওয়ার জন্য শত্রুপক্ষের একটি বাঙ্কার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয় । রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমার তাঁর ব্যক্তিগত সুরক্ষাকে উপেক্ষা করে শত্রু বাঙ্কারকে চার্জ করেছিলেন ।
- এরপর তিনি হাতাহাতি সংঘর্ষে গিয়ে তিনজন পাকিস্তানি সেনা জওয়ানকে খতম করেন এবং নিজেও গুরুতর আহত হন ।
- সমস্ত আঘাতকে উপেক্ষা তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং দ্বিতীয় শত্রু বাঙ্কারে আক্রমণ করেন ।
- শত্রুপক্ষ ঘটনাস্থানে একটি বন্দুক ফেলে রেখে সেখান থেকে পালিয়ে যায় ।
- যদিও রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমারের ক্ষতস্থান থেকে ক্রমাগত রক্ত ঝরছিল , কিন্তু সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে কোনওভাবে রাজি ছিলেন না ।
- তাঁর এই সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ শত্রুপক্ষের থেকে ওই এলাকা দখলের জন্য কমরেডদের অনুপ্রাণিত করেছিল ।
- সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি এই এলাকা দখলে যে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন তার জন্য তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ বীরত্বের পুরস্কার পরম বীর চক্র প্রদান করা হয়েছিল ।
ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা
- 7 জুলাই 1999 ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা 4875 পয়েন্টের উত্তর অঞ্চলটি দখল করতে আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । যেখানে শত্রুপক্ষ 13 JAK রাইফেলস অপারেশনে হস্তক্ষেপ করেছিল ।
- এই কাজটি খুব কঠিন ছিল এবং কাজটি করার জন্য বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে তাদের যেতে হয়েছিল ।
- ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণটির নেতৃত্ব দিয়ে ক্যাপ্টেন বাত্রা পয়েন্ট-ব্ল্যাক রেঞ্জে শত্রুকে জড়িত করেছিলেন
- আক্রমণ চলাকালীন তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন তবে তিনি এই যুদ্ধের জমি ছেড়ে যেতে চাননি ।
- তিনি তাঁর দলের লোকেদের একত্র করেছিলেন এবং আক্রমণের জন্য চাপ দিয়েছিলেন , যা শেষপর্যন্ত সফলতা অর্জনে সাহায্য করেছিল । যা সামরিকভাবে অসম্ভব কাজ ।
- এই সাহসিকতা ও বীরত্বের প্রদর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে দল শত্রুদের পরাজিত করতে সক্ষম হয় এবং নিজের অবস্থান দখল করেন ।
- 20 জুন , 1999 । দ্রাস সেক্টরে 5140 পয়েন্টে শত্রুদের অবস্থান ধ্বংস করার জন্য ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন । এই এলাকা পুনর্দখলের জন্য তিনি যে বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন , তার জন্য তাঁকে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়েছিল ।
- তিনি সাহসের সঙ্গে আক্রমণ শুরু করেছিলেন এবং হাতাহাতি লড়াইয়ে চারজন অনুপ্রবেশকারীকে খতম করেছিলেন ।
- মৃত্যুর পর ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রাকে পরম বীর চক্র পুরস্কার প্রদান করা হয় ।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি
- আমি হয় তেরঙ্গা উত্তোলনের পর ফিরে আসব অথবা আমি এতেই আবৃত হয়ে ফিরে আসব , কিন্তু আমি ঠিক ফিরে আসব ।
- ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর
লেফটেন্যান্ট মনোজ কুমার পান্ডে
- লেফটেন্যান্ট মনোজ কুমার পান্ডে 1/11 এর এক তরুণ অফিসার , যিনি খালুবার আক্রমণের সিরিজ়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন ।
- 1999-এর 2 বা 3 জুলাইয়ের রাতের বেলা । বেশ কয়েক ঘণ্টা কষ্টকর অভিযানের পর তাঁর দল একটি লক্ষ্যে পৌঁছায় । এরপরই আশপাশের উচ্চতা থেকে শত্রুদের ক্রমাগত গুলিবর্ষণের কবলে পড়ে তারা ।
- শত্রুপক্ষের অবস্থানকে পুরো সাফ করে দেওয়ার জন্য মনোজের দলকে মনোনীত করা হয়েছিল । তিনি তাঁর দলকে একটি সুবিধাজনক স্থানে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ডান দিক থেকে পাকিস্তানি বাঙ্কারগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য একটি বিভাগকে সেইদিকে পাঠিয়েছিলেন ।
- তিনি নিজে আরও চারটি শত্রু বাঙ্কার খতম করার উদ্দেশে বাঁ দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন ।
- নির্ভীকভাবে প্রথম বাঙ্কারটি চার্জ করার পর সাহসিকতার সঙ্গে গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে যান এবং দুই শত্রু সৈনিককে খতম করেন । পাশাপাশি দ্বিতীয় বাঙ্কারটিকে ধ্বংস করতে এগিয়ে যান ।
- তিনি দ্বিতীয় বাঙ্কারটিও ধ্বংস করেন এবং আরও দুই শত্রুপক্ষের সৈনিককে খতম করেন ।
- এরপর যখন তিনি তৃতীয় বাঙ্কারটিতে অভিযান চালাচ্ছিলেন তখন তাঁর কাঁধে , হাতে গুলি লাগে ।
- গুরুতর আঘাত লাগার পরও তিনি তা উপেক্ষা করেই সেনাদের আহ্বান জানিয়ে নিজেই চতুর্থ বাঙ্কারটিতে আক্রমণ চালিয়েছিলেন ।
- গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তিনি ওই চতুর্থ বাঙ্কারটি নষ্ট করতে সক্ষম হন । এর পাশাপাশি তিনি একটি গ্রেনেড মজুত ঘাঁটিও ধ্বংস করেন । সেইসময় শত্রুপক্ষের মাঝারি মেশিন গানে খুব কাছ থেকে তাঁর কপালে গুলি লাগে । এবং তিনি মারা যান ।
- তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপে শেষপর্যন্ত খালুবার দখল করতে সক্ষম হয়েছিল ।
- লেফটেন্যান্ট মনোজ কুমার পান্ডেকে তাঁর বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য পরম বীর চক্র প্রদান করা হয়েছিল ।
তাঁর বিখ্যাত উক্তি
- আমার রক্ত প্রমাণ করার আগে যদি আমার মৃত্যু হয় , তবে আমি শপথ করছি আমি মৃত্যুকে হত্যা করব - ক্যাপ্টেন মনোজ কুমার পান্ডে PVC 1/11 গোর্খা রাইফেলস ।
সার্ভিস সিলেকশন বোর্ড(SSB)-এর ইন্টারভিউতে তাঁর বাছাই পর্বের আগে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল , "আপনি কেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান ? " তিনি ততক্ষণাৎ জবাব দেন , " আমি পরম বীর চক্র জিততে চাই । " আর তাঁর কথাই সত্য হয়ে যায় । ক্যাপ্টেন মনোজ কুমার পান্ডে মৃত্যুর পর দেশের সর্বোচ্চ বীরত্বের পুরস্কার পেয়েছিলেন । "