বিয়ে । কথাটা শোনা মাত্রই প্রতিটি মানুষের মনে একটি কল্পনার জগৎ তৈরি হয় । প্রত্যেকের নিজস্ব জগৎ । একেবারে নিজস্ব । পাকা কথা থেকে শুরু করে আইবুড়োভাত, গায়ে হলুদ, বাসরঘর, কালরাত্রি, ফুল শয্যা । সবকিছু যেন নিমেষে চোখের সামনে চলে আসে । কিন্তু এই বিয়ের যাবতীয় রীতি কিন্তু একেবারে শুরু থেকে ছিল না । বিয়ের ইতিহাস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, আগে ছিল শুধুই পরিবারতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র । আবার কখনও বা ধর্মীয় অনুশাসন । তারপর ধীরে ধীরে সময়ের চাকা ঘোরে । রীতি-রেওয়াজ বদলায় । সমাজ বদলায় । দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের এই বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান ।
তবে কেমন ছিল তখনকার বিয়ে ? তখনও কি মানুষ এমন সাজগোজ করত ? জানতে ইচ্ছে করে ? চলুন তবে একবার বিয়ের ইতিহাসের পাতা উলটে দেখা যাক, কেমন ছিল তখনকার বিয়ে । বিয়ের ইতিহাসের প্রথম পাতা খুবই অস্পষ্ট । ঝাপসা । তবে সময়টা তখন খ্রিষ্টপূর্ব 2350 সাল । মেসোপটেমিয়া । সেখানেই ফুটেছিল প্রথম বিয়ের ফুল । যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় বিয়ের সম্বন্ধে তাতে সবথেকে প্রাচীন বিয়ে এখানেই হয়েছিল ।
এবার আর একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক । আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে । তখনও চাষাবাদের সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয়নি । মানব সভ্যতা তখন বন্য । শিকার করে খেত । তখন জনা তিরিশ মানুষ মিলে এক একটি দল থাকত । পুরুষ-মহিলা-শিশুদের দল । একজন দলপতি । দলের যে কোনও পুরুষ যে কোনও নারীর সঙ্গে মিলিত হত । এই প্রথাকে ঠিক বিয়ে বলা চলা না । এরপর মানুষ ধীরে ধীরে শিকার ছেড়ে চাষাবাদ শুরু করল । তৈরি হল বসতি । শুরু হল পরিবারতন্ত্র ।
প্রাচীন হিব্রু, গ্রিক ও রোমান ইতিহাসে বিয়ের ধারণা পাওয়া যায় । তখন বিয়ে মানে আজকের মতো এমন ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল না । তখন স্ত্রী ছিল পুরুষদের সম্পত্তি । এমন এক সম্পত্তি যার মাধ্যমে বংশের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় । এ এক এমন প্রথা, যেখানে পুরুষদের পরবর্তী বংশধর যাতে একেবারে তাঁদের নিজের রক্তের হয়, তা নিশ্চিত করত । এক বা একাধিক পুরুষ কোনও নারীর সঙ্গে সঙ্গম করলে তা আর একেবারে নিজস্ব রক্তের বংশধর হত না । তাই নারীকে এই প্রথায় একজন পুরুষের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় । তখন স্ত্রীরা যেন অনেকটা বংশের গতি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যন্ত্র ছিলেন । এখন যেমন কন্যাদান হয়, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাতেও তা ছিল । তবে তা ছিল খুবই ভয়ংকর । একজন বাবা তখন তাঁর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় বলতেন, "বৈধ বংশধরের জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমি আমার কন্যাকে উৎসর্গ করার অঙ্গীকার করছি।"
প্রাচীন হিব্রু সভ্যতায় আবার পুরুষরা একাধিক বিয়ে করতে পারতেন । গ্রিক ও রোমান পুরুষরা নিজেদের যৌন চাহিদা নিবৃত্তি করতে অন্য নারীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতেন । অনেকে পতিতালয়েও যেতেন । আর মহিলারা ঘরের কাজ করতেন । যদি স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হতেন, তবে তাঁকে বাপের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হত । স্বামী তারপর ফের অন্য কাউকে বিয়ে করতেন, যে তাঁকে বংশধর দিতে পারবে । কিন্তু তখনও ধর্মীয় ব্যাপারটা ঢোকেনি বিয়ের মধ্যে ।
বিয়েতে ধর্মীয় বিষয়ের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় প্রাচীন রোমান ইতিহাসে । আঠারো'শ শতাব্দী । রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলি অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে । তখন বিয়েকে সামাজিক ও আইনি স্বীকৃতি দিতে যাজকের আশীর্বাদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । আর এইভাবেই বিয়ের মধ্যে প্রথম ঢোকে ধর্মীয় অনুশাসন । তৈরি হয় আইন ।
ক্যাথলিক চার্চের ধর্মীয় অনুশাসন ও আইন আসার পর থেকে নারীদের বৈবাহিক জীবনে অনেকটা উন্নতি হয় । নারীদের সম্মান দিতে শেখানো হয় । একজন পুরুষকে একজন নারীর সঙ্গে বৈবাহিক জীবন কাটাতে গেলে তাঁকে বিশ্বস্ত হতে হবে যৌবন যাপনে । স্ত্রীকে কখনও ত্যাগ করা যাবে না । তবে তখনও পরিবারের প্রথম ছিলেন স্বামীই ।
তবে এতদিন পর্যন্ত বিয়েতে প্রেমের কোনও বিষয় ছিল না । গোটা ব্যাপারটাই ছিল বংশধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া । অনেকটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মতো । সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিয়েতে প্রথম ভালোবাসার ছোঁয়া নিয়ে আসে ফরাসিরা । ফরাসি নাইট ল্যান্সলর্ট রাজা আর্থারের স্ত্রী রানি গুইনেভারের প্রেমে পড়ে গেছিলেন । এরপরই ধীরে ধীরে বিয়েতে আসে প্রেম ।
এভাবেই বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন রীতি-রেওয়াজ বদলাতে বদলাতে আজকের বিয়ে । যত দিন এগিয়েছে, পুরুষতন্ত্র গেছে, পরিবারতন্ত্র গেছে । ভালোবাসা এসেছে । সম্মান এসেছে । সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে ।