কলকাতা, 31 অগাস্ট : মিরাটি থেকে রাইসিনা হিলস । প্রায় 6 দশকের রাজনৈতিক জীবন । 1969 সালে রাজ্যসভা দিয়ে যার শুরু । আর 2012 সালের 24 জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ ৷ এরপর 5 বছর দেশের সাংবিধানিক প্রধান ৷ কিন্তু শুরুর আগেও সলতে পাকানোর একটা সময় । বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য । 1952 থেকে 1964 পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য । জাতীয় কংগ্রেসের বীরভূম জেলার সভাপতি । সুতরাং রাজনীতির পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ।
ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন 2019 সালে । 1935 সালের 11 ডিসেম্বর বীরভূমে জন্ম ৷ বেড়ে ওঠা সেখানেই । তারপর উল্লেখযোগ্য শিক্ষাজীবন । 1957 সালে বিবাহ । শুভ্রার সঙ্গে । তিন সন্তান । শর্মিষ্ঠা, অভিজিৎ, ইন্দ্রজিৎ । 2015 সালে হঠাৎ মৃত্যু হয় স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের ।
সেটা 1965 সাল । কংগ্রেসের ভিতর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৈরি হল বাংলা কংগ্রেস । সুশীল ধারার ভাবশিষ্য প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কংগ্রেস ভেঙে বাংলা কংগ্রেসের নেতা । 1967 মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচন কংগ্রেস প্রার্থী সচীন্দ্রনাথ মাইতির বিরুদ্ধে বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী জি কে সিংহের হয়ে প্রচারে প্রণব মুখোপাধ্যায় । বাংলা কংগ্রেসের প্রার্থী হেরে গিয়েছিলেন । কিন্তু সুবাগ্মী প্রণব চোখে পড়ে যান দলনেত্রী ইন্দিরা গান্ধির । 1969 সাল । রাজ্যসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার সংসদে যান প্রণব মুখোপাধ্যায় । তখন তাঁর বয়স মাত্র 34 । সেবার মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জিতে আসেন ভি কে কৃষ্ণ মেনন । 1973 সালে প্রথমবার মন্ত্রী । শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটে যোগদান । পরবর্তী সময়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে সামলেছেন একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব । দু-দুবার অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছাড়াও একাধিক মন্ত্রক সামলেছেন । সামলেছেন পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের দায়িত্বও । নিজে অর্থমন্ত্রী হিসেবে যাকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছিলেন । সেই মনমোহন মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন হাসিমুখেই ।
তবে সবটাই মসৃণ পদচারণায় হয়নি । কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজার নিজের রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার ক্রাইসিসের মুখোমুখি হয়েছেন । স্বভাব সিদ্ধ বিচক্ষণতায় সামলেছেন সেইসব কঠিন অধ্যায়ও । একাধিকবার তাঁর নাম এসেছিল দলের শীর্ষ পদে বসার । হয়নি । কংগ্রেস ভেঙে 1986 সালে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস গড়েছিলেন । সফল হননি । ফের ফিরে গেছেন পুরানো দলে । নিজস্ব দক্ষতায় ফের পৌঁছেছেন শীর্ষবৃত্তে । ফের কাজ করেছেন কংগ্রেসের সংকটমোচন রূপে ।
কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষক হিসেবে । আজীবন সেই শিক্ষকের মেজাজ নিয়েই চলেছেন । নিজে শিখেছেন । অন্যকে শিখিয়েছেন । কেমন অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণববাবু? 1982 থেকে 1984 । প্রথম দফায় দেশের অর্থমন্ত্রক সামলাতে গিয়ে তার পরিচয় দিয়েছেন । IMF এর শেষ দফার ঋণের 1.1 বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর নিতে হয়নি ভারতকে । 1984 সালে বিশ্বের সেরা পাঁচ অর্থমন্ত্রীর একজন হিসেবে শিরোপা দেওয়া হয় ইউরোমানির পক্ষ থেকে । 1997 সালে হন সেরা সাংসদ । অর্থমন্ত্রকের পাশাপাশি সামলাচ্ছিলেন রাজ্যসভায় সংসদীয় দলনেতার পদও । 1980 থেকে 1986 । পরবর্তীতে 2004 সাল থেকে লোকসভাতেও কংগ্রেস দলনেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভায় । ইন্দিরা গান্ধির বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন । ইন্দিরা হত্যার পর তাঁর নামই উঠে এসেছিল পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে । কিন্তু জ্যোতি বসুর মতো এই বাঙালিরও প্রধানমন্ত্রী হওয়া হয়নি । কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েনে । বরং ইন্দিরা হত্যার পর সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল ইন্দিরাপুত্র রাজীবের সঙ্গে । কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির টানাপোড়েনে একসময় কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়েও আসেন । 1986 সালে তৈরি করেন নিজের দল রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস । যদিও তিন বছরের মধ্যেই ফের মিশে যান মূল কংগ্রেসে । 1991 সালে পি ভি নরসিমা রাওয়ের আমলে তাঁকে ট্রেনিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে ফিরিয়ে আনা হয় । শুরু হয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কামব্যাক ইনিংস । তবে এবার আর উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসেননি । বরং পিচ কামড়ে পড়ে থেকে একের পর এক বর্ণময় রাজনৈতিক ঘটনার কারিগর হয়েছেন ।
ভারতীয় অর্থনীতিতে উদারীকরণের নীতিও শুরু হয় 1980 পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরে । যা সফল করিয়ে নেন মনমোহন সিং 1991 সালে নয়া অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগ করে । রাও ক্যাবিনেটে 95-96 সালে বিদেশমন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন । সে সময় থেকেই মার্কিনিদের সঙ্গে সুসম্পর্কের শুরু । আবার রাশিয়ার হাত না ছেড়ে । 98-99 সালে AICC-র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান । রাজীব হত্যার পর সোনিয়া গান্ধির রাজনীতিতে যোগদান । কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব পালন, এই গোটা পর্বে দলের বিশ্বস্ত সেনানী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় । 2000 সালে দ্বিতীয়বারের জন্য টানা দশ বছর প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন । এর আগে 1985 সালে প্রথমবার প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ।
সাংসদ হয়েছেন কয়েকবার । প্রতিবারই রাজ্যসভায় কংগ্রেস মনোনীত । খেদ ছিল । নিজস্ব বৃত্তে বলতেনও মানুষের ভোটে জিতে সাংসদ হওয়ার ইচ্ছের কথা । 2004 সালে সেটাই করে দেখালেন । প্রথমবার যেতেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে । এরপর ফের 2009 -এ । কেরিয়ারের শেষ লগ্নে এসে ফের চমক দেখালেন । 2012- র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে 71 শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেন । প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবেও নিজের কাজের উদাহরণ রেখেছেন প্রণব মুখোপাধ্যায় ।
আক্ষরিক অর্থে স্টেটসম্যান বলতে যা বোঝায় । প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন তাই । যে ক'জন ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দুনিয়া এক ডাকে চেনে । প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই গুটিকয় মেধাবী ভারতীয় রাজনীতিবিদদের অন্যতম ।