ETV Bharat / bharat

কাশ্মীর বিতর্ক নিয়ে তালিবানরা মোটেই আগ্রহী না, মন্তব্য অমর সিনহার - Amar Sinha

দিল্লি থেকে স্মিতা শর্মার এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে NSAB সদস্য অমর সিনহা জানিয়েছেন যে তালিবানরা মোটেই কাশ্মীরের ব্যাপারে আগ্রহী নয় ।

ছবি
ছবি
author img

By

Published : May 22, 2020, 3:09 PM IST

Updated : May 23, 2020, 3:30 PM IST

এমন খবর এসেছিল যে, তালিবানের তরফে মুখ্য সংযোগকর্তা শের মহম্মদ আব্বাস আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার সমালোচনা করে নেতিবাচক আখ্যা দিয়েছিলেন । এমনও শোনা গেছিল যে, কিছু টুইটে তালিবান মুখপাত্র দাবি করেছেন, তাঁদের সঙ্গে নয়াদিল্লির বন্ধুত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হচ্ছে । এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন তৈরি হয়েছিল । যদিও তা কেটে গেল উচ্চপদস্থ এক ভারতীয় আধিকারিকের আশ্বাসে । তিনি বললেন, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থানে কোনও বদল আসেনি এবং তালিবানরা কাশ্মির বিবাদ নিয়ে একেবারেই আগ্রহী নয় । সাংবাদিক স্মিতা শর্মাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কাবুলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে NSAB–এর (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজ়রি বোর্ড) সদস্য অমর সিনহা জানিয়েছেন, " আমি মনে করি না তালিবান কখনও এ কথা বলেছে যে, তারা কাশ্মীর কিংবা একে নিয়ে হওয়া বিবাদে মনোযোগী ছিল। এই দুই বিষয়কে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা পাকিস্তানের একাংশ করেছে । খুব সহজ একটি কারণের জন্য তারা এটা করছে কারণ তারা মনে করে, এভাবেই তারা আমেরিকাকে এই বিবাদে জড়াতে পারবে । কারণ আমেরিকার কাছে আফগান সমীকরণের দিকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ । আর পাকিস্তানের কাছে সমীকরণের উভয় দিকই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা এই দুইয়ের মধে্য যোগসূত্র টানতে বা সামঞ্জস্য খুঁজে পেতে চায়।"

যুদ্ধবিদীর্ণ আফগানিস্তানে জাতীয় স্তরে শান্তি ফিরিয়ে আনা ও পুনর্মিলনের পক্ষে সওয়ালকারী আঞ্চলিক অংশীদারভুক্ত দেশগুলির তালিকায় অন্যতম হল ভারত। দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র পরে টুইট করে সেই বিতর্কিত টুইট খারিজ করেছিলেন এবং গুরুত্ব সহকারে জানিয়েছিলেন যে, এই ইসলামিক শক্তি অন্যান্য পড়শি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। অমর সিনহা জোর দিয়ে বলেছেন, " শুধুমাত্র দু’দিন আগে নয়। যখন সংবিধানের 370 ধারা রদবদল হল, তখনও তালিবান এই কথা বলেছিল । পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এর ফলে দোহায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে। সেবারও সঙ্গে সঙ্গে তালিবান মুখপাত্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে এই দু’টি বিষয়ের মধে্য কোনও যোগসূত্র নেই । সংবিধানের 370 ধারা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি এবং কাশ্মীর ইশু ও তালিবানের মধে্য আমরা কোনও যোগসূত্র পাইনি । গত সপ্তাহে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় কিছু তালিবান মন্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছিল, যেখানে তারা কীভাবে তারা কাশ্মীর ছিনিয়ে নেবে ইত্যাদির মতো একাধিক দাবি করেছি । কিন্তু আমি মনে করি যে গোটাটাই করা হয়েছিল অনিষ্ট করার উদ্দেশে্য আর তালিবান মুখপাত্র স্ট্যানিকজাই এবং সুহেল শাহিন নিজেদের মন্তবে্য তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এখানেই এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে ইতি টানা উচিত ।" 2018 সালে মস্কো আলোচনায় অ-সরকারি স্তরে যে দুই অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক নয়াদিল্লির প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং যঁরা অন্যদের পাশাপাশি সর্বপ্রথম তালিবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক ঘরে থেকেছিলেন, সিনহা তাঁদের মধে্য অন্যতম। বিগত 18 বছরে ভারত আফগান-নেতৃত্বাধীন, আফগান-অধীন এবং আফগান-নিয়ন্ত্রিত শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে, তালিবানের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসার প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। আমেরিকায় আফগানিস্তানের বিশেষ রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদ, তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারতের উচিত তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং আফগান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর ভূমিকা পালন করা । তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সিনহা বলেন, ভারত তালিবান-সহ সকলের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে চায় কিন্তু তার আগে তাদের জানাতে হবে, তারা ঠিক কী চায়।

অমর সিনহা বলেছেন, “আফগানিস্তানের সকল গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত আলোচনায় বসতে চায়। এটা খুবই স্পষ্ট। তারা আমাদের অন্যতম কাছের পড়শি দেশ। তাই দেশটির সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে চাই। কিন্তু তার আগে অন্তত তালিবানকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তারা হিংসার সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে এবং আফগানদের খুন করা বন্ধ করে দিয়েছে।” প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের কথায়, “ আমি এই মতে বিশ্বাসী নই যে পড়শি দেশগুলির ক্ষেত্রে কোনও ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দেওয়ার দরকার ভারতের আছে। আমি মনে করি, প্রতি ক্ষেত্রে ভারতের নিজস্ব নীতি থাকা উচিত এবং আমাদের এলাকার মধে্য সেই সব নীতির বাস্তবায়নের ফলে কী কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে এর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকা উচিত। না হলে আমাদের মুখের কথা এবং কাজে শক্তি প্রদর্শন করার দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুতর অবমাননা হিসাবেই দেখা হবে। তাই এই এলাকা নিয়ে অন্যরা যে বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, আমাদেরও উচিত সেই তালিকায় যোগদান করা। ”

দেখুন সাক্ষাৎকার...

যদিও তাঁর ইঙ্গিত, ভারত পিছনের দরজা দিয়ে আলাপ-আলোচনা বজায় রেখে চলেছে এবং এটা বলা ভুল যে নয়াদিল্লি দূর থেকে দেখছে, কাবুলে কী হচ্ছে। সিনহার জবাব, “ আমরা যে কিছুই করছি না, সেটা বলাটা ভুল। যোগাযোগ বজায় রাখা এবং পুনর্মিলন ঘটানো সংক্রান্ত অনেক কিছু প্রকাশে্য করা যায় না । কিন্তু আমি নিশ্চিত, পর্দার আড়ালে আমাদের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য আধিকারিকরা এ বিষয়ে সক্রিয়। তারা অন্তত আফগান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া চালিয়ে যাচ্ছে।” তাঁর আরও সংযোজন, “ আমি এর অংশ নই (পর্দার আড়ালে আলোচনা) কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভারত সরকার সারাক্ষণ পিঠে হেলান দিয়ে বসে নেই। অনেক কিছু ঘটে চলেছে। কিছু কিছু জিনিস চুপিসাড়েই করা উচিত, বিশেষ করে তা যখন আপনি আপনার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করতে চলেছেন। আমাদের সমস্যা হল এই যে, আমাদের (ভারত) বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই আমরা কারও পক্ষ নিতে পারি না, একজনকে ছাপিয়ে অন্যজনকে বাছতে পারি না। তাই চুপিসাড়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানাই, তাদের কাছে আবেদন করি এবং সেরা পথে হেঁটে, অগ্রগতির দিকে এগিয়ে চলি। " COVID-19 সংকটের আবহে জালালাবাদ এবং হেরাটে ভারতীয় কনসু্লেট বন্ধ হওয়ার খবর নিয়ে প্রশ্ন করলে অমর সিনহা বলেছেন, প্যানডেমিকের জন্যই আপাতত কনসু্লেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে । তাঁর কথায়, “হেরাট এবং জালালাবাদের অবস্থান দেখে বুঝতে পারছি, ভাইরাস সংক্রমণের ভয়েই এই পদক্ষেপ । হেরাট সংক্রমণের জেরে বিপর্যস্ত আর ইরান থেকে ভাইরাস সংক্রমণ যেখানে যেখানে হয়েছে, হেরাট তাদের মধে্য অন্যতম । তাই আমি বুঝতে পারছি, COVID -র জন্যই এই পদক্ষেপ আর এগুলো সাময়িক । আমরা অপেক্ষা করছি, নজর রাখছি । লকডাউনের এই সময়ে জালালাবাদ এবং হেরাটের মানুষের পাশে দাঁড়ানো কঠিন। তাই সম্ভবত, এটি চিকিৎসাজনিত একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ।”

স্মিতা শর্মা অমর সিনহার সঙ্গে কথা বলেছেন আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তি, আন্তঃআফগান আলোচনা, তালিবানের ক্ষমতা আসার অর্থ ১৯৯৬ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি কি না, IC-814 হাইজ্যাকের ঘটনায় ভারতের বিশ্বাসভঙ্গ এবং আরও নানা বিষয়ে ।

প্রশ্ন: এত ঘটা করে ফেব্রুয়ারি মাসে দোহায় যে আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল, আদপে তা কতটা ভঙ্গুর? এটা কী ইতিমধে্যই ভাঙতে বসেছে?

অমর সিনহা- এটা বাস্তবিক অর্থে কোনও শান্তি চুক্তি ছিল না। এটা ছিল আমেরিকা সরকার এবং তালিবানের মধে্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা আফগানিস্তানে শান্তি ফেরাতেই করা হয়েছিল। শান্তি হল আন্তঃআফগান আলোচনার অন্তিম ফলাফল। 29 ফেব্রুয়ারি হওয়া চুক্তি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা জানায়। সঙ্গে কিছু সময়সীমার হদিস দেয় এবং কিছু প্রতিশ্রুতির কথা জানায়, যে তালিকায় রয়েছে, কত বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হবে, কখন সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে, কোন কোন নির্দিষ্ট তারিখে আমেরিকার তালিবানদের উপর জারি করা বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা উচিত প্রভৃতি। গোটা বিষয়টা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে কারণ চুক্তিতে যে সময়সীমার কথা বলা হয়েছে, তা ধরনে-ধারণে প্রবল উচ্চাকাঙ্খী ছিল। তা সরকার গঠন এবং আফগানিস্তানে নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। এই দুই প্রক্রিয়াই সেখানে সমান্তরালভাবে চলছিল। আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর তারিখ ছিল 10 মার্চ, সেখানেই আবার প্রেসিডেন্ট ঘনি এবং আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ শপথ নিলেন 9 মার্চ। দু’জন প্রেসিডেন্টের জন্য দু’টো পৃথক পৃথক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত, সেই সমস্যা এখন মিটে গেছে । আফগান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তরফে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত অন্তত ঐক্যমতে্যর নিরিখে একটি সর্বসম্মত অবস্থানে আসতে পেরেছিলেন, যেখান থেকে তাঁরা বর্তমানে আন্তঃআফগান আলোচনায় তালিবানকে গুরুত্ব সহকারে যোগদান করতে বাধ্য করতে পেরেছেন ।

প্রশ্ন- গত দশকে আফগানিস্তান রাজনৈতিক স্তরে যে লাভ করেছে, তাতে কতটা ঝঁুকি মিশে আছে? আর আমেরিকা- তালিবান চুক্তির ক্ষেত্রেই বা তা কতটা?

অমর সিনহা- যেভাবে লেখা হয়েছিল, যদি ঠিক সেভাবেই সব কিছু এগোয়, তাহলে আমি মনে করি না, আমাদের কোনও সমস্যা হতে পারে । ওই চুক্তিতে সতি্যই তালিবানকে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসা এবং আফগান সরকার ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে সচেষ্ট করে । যদি তাকে বিশ্বাস করে তালিবানরা তা কার্যকর করে, তাহলে আমি মনে করি, ভাল ফল আসবে । প্রতে্যকে চায়, হিংসা শেষ হোক, বিশেষ করে আফগানরা তাই চান । এই চুক্তিকে তালিবানকে এই মর্মেও প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হয়েছে যে তারা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবে, বিশেষ করে তখন, যখন তারা কাবুলে ফিরে আসবে। আর সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি ছাড়াও তাদের সন্ত্রাসের মদতদাতাদের থেকেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। গত 18 বছর ধরে ওরা এর সুবিধাভোগী ছিল।

প্রশ্ন- ক্ষমতা বণ্টনের চুক্তি নিয়ে যে রফা হয়েছিল, তা অনুযায়ী আফগানিস্তানে হিংসা অন্তত 80 শতাংশ হ্রাস করবে তালিবান–আমেরিকার আধিকারিকদের এই বোঝাপড়া তালিবান এড়িয়ে গেছে । গত 24 থেকে 48 ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানকার 34 টি প্রদেশের কুড়িটিতে সংঘর্ষের খবর মিলেছে । প্রেসিডেন্ট ঘনিকে নিজের অবস্থান প্রতিরোধমূলক থেকে পরিবর্তন করে প্রতিঘাতমূলক করতে হয়েছে । এই চক্র কোথায় গিয়ে থামবে ?

অমর সিনহা- দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, এই চুক্তি আফগান এবং আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে হিংসার হার কমানোর ক্ষেত্রে কোনও শর্ত আরোপ করে না । চুক্তিতে বলা আছে যে, সাত দিন ধরে হিংসা কম হবে । প্রতিশ্রুতি এটাই যে তালিবান আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলির উপর আক্রমণ করবে না । আফগান সরকার কিংবা আফগান প্রদেশগুলিতে হিংসা বন্ধের কোনও প্রতিশ্রুতি সেখানে দেওয়া হয়নি। তালিবানের তরফে তাদের লাগাতার আক্রমণ তথা ‘স্প্রিং অফেনসিভ’ এখনও ঘোষণা করা না হলেও আমরা তাদের সংঘর্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে দেখছি । কিন্তু তালিবানরা তা না ঘোষণা করলেও (সচরাচর মার্চ বা এপ্রিলে তারা তা করে থাকে) সংঘর্ষের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে...এমন রিপোর্ট এসেছে, যাতে বলা হয়েছে তালিবান আন্তঃআফগান আলোচনায় বসার আগে বেশ কিছু প্রদেশ দখলের চেষ্টা করবে। কারণ তারা চাইবে শক্তি বাড়িয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে। আমি মনে করি, তালিবানকে অনেক বেশি বৈধতা দেওয়া হয়েছে যা তাদের সম্ভবত আলোচনায় বসার আগে যতটা দরকার, তার থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটাই তাদের সেনাবাহিনীর কৌশল।

প্রশ্ন- শিখ সংখ্যালঘুদের উপর, শিশু-প্রসূতি হাসপাতালে পর পর হামলা থেকে শুরু করে কুন্দুজে অন্তত 17 টি গোয়েন্দা পোস্ট- বিশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলছেন নেপথে্য ইসলামিক স্টেট খোরাসান আর প্রেসিডেন্ট ঘনি বলছেন, এটা তালিবানের কাজ। ভারত কী মনে করে?

অমর সিনহা- সতি্যটা হল এই যে, এই সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি পরস্পর যুক্ত। একের থেকে অন্যকে আলাদা করা খুবই কঠিন। এরা নিজেদের সম্পদ, সদস্য, কৌশল, মতাদর্শ–সবকিছুই লেনদেন করে । এবার কে ভাল আর কে মন্দ সন্ত্রাসবাদী, সেই বিভেদ করা সঠিক নীতি নয়। এই সব আক্রমণের একটা নির্দিষ্ট অর্থ আছে। এরা মৌলিকভাবে এমন একটা জরুরি অবস্থা জারি করতে চাইছে যেখানে সংঘর্ষদীর্ণ আফগানদের মানসিক অবস্থা নিয়ে তারা খেলতে পারে এবং আফগান সরকারকে চরম চাপের মধে্য রাখতে পারে এই বলে যে, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু করার আগে যতক্ষণ না তোমরা আমাদের দেওয়া সব শর্ত মানছো, ততক্ষণ অগুনতি নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হবে। এটা সেই সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির কাছে সুবিধাজনক হয়েছে, যাদের উত্থান হয়েছে গত কয়েক বছরের মধে্য। যে সব হামলায় দায় তালিবানের পক্ষে নেওয়া কঠিন হত, এই সংগঠনগুলি তার দায় স্বীকার করে নিচ্ছে । এগুলো সবই এক ধরনের খেলা আর তাই আমাদের এটা বিচার করা উচিত নয় যে, কোন সংগঠন এ সব করছে। সতি্যটা হল আফগানিস্তানে যে হিংসা চলছে, তার একটি ইতিহাস আছে, প্রেক্ষাপট আছে এবং আফগানরা তা জানে। আমি নিশ্চিত, মি. খলিলজাদও তা জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই সমীচিন হবে যে আমরা এই ধরনের সব দায় থেকে তালিবানকে মুক্ত করি কারণ তালিবানকে বর্তমানে তুলে ধরা হচ্ছে এমন একটি শক্তি হিসাবে, যারা বদলে গিয়েছে। বর্তমানে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি এবং হিংসাজনক কোনও শক্তি নয়। তবে তা হাতেকলমে প্রমাণ করা এখনও বাকি।

প্রশ্ন- দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারত লাল সতর্কতা জারি করেছে। যে দুই রাষ্ট্রদূত দৃষ্টিভঙ্গী বদলের পর অসরকারিভাবে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মস্কোয় তালিবানের সঙ্গে একই ঘরে থেকে, আপনি তঁাদের অন্যতম। গত বছর রাইসিনা আলোচনায় তত্কালীন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের উচিত, ব্যান্ডওয়াগনে ঝাঁপিয়ে পড়া। সরাসরিভাবে তালিবানের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের সুযোগ কোথায়?

অমর সিনহা- আফগানিস্তানে সব গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত কথা বলবে। এটা খুবই স্পষ্ট, এটি আমাদের নিকট পড়শি দেশ। আমরা প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু আগে তালিবান প্রমাণ করুক যে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, হিংসা ছেড়ে দিয়েছে এবং আফগানদের হত্যা বন্ধ করে দিয়েছে। বাকিরা কে কী বলেছে আমি শুনেছি। আমি বিশ্বাস করি না, পড়শি দেশ এলাকায় ভারতকে কোনও ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দিতে হবে। আমি মনে করি, ভারতের উচিত নিজস্ব নীতি নির্ধারণ করা এবং এই এলাকায় যে কোনও ফলাফলকে রূপ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকা। নচেৎ, আঞ্চলিক হওয়া নিয়ে আমাদের মুখের কথা এবং কাজে শক্তি প্রদর্শন করার দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুতর অবমাননা হিসাবেই দেখা হবে। তাই এই এলাকা নিয়ে অন্যরা যে বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, আমাদেরও উচিত সেই তালিকায় যোগদান করা।অসরকারিভাবে মস্কোয় গিয়ে এই প্রথম তালিবান আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে কথা বলেছিল। রাশিয়াও এ নিয়ে এগিয়েছিল। আন্তঃ আফগান আলোচনা ঐতিহাসিক ছিল। কারণ এটি প্রথম গোটা যোগাযোগকে গণতান্ত্রিক রূপ দিয়েছিল। তার আগে এই সব যোগাযোগের দরুণ, মার্কিন-তালিবান চুক্তিই হয়েছিল। আদপে যা ছিল আমেরিকা সরকার এবং তালিবানের মধে্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা। অতিথি দেশ কাতার ছাড়া সেই সময় ওই ঘরে কেউ ছিল না, NATO বা আফগানিস্তানের মতো প্রধান দলও নয়, যদিও না আবার তালিবানের ছদ্মবেশে সেখানে কোনও ISI-এর চর থেকে থাকে। তাই দোহা চুক্তিতে ভারতের যোগ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

বর্তমানে আমরা আগের থেকে আরও ভাল জায়গায় আছি। আর এখানে ভারতের পক্ষে বৃহত্তর গঠনাত্মক ভূমিকা পালন করারও সুযোগ আছে। যা আমাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী, আফগান প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্রকে নিরন্তর সমর্থন করে যাওয়ার আমাদের নীতি, গোটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র প্রভৃতি থেকে এই সত্য প্রকাশিত হয়। সুতরাং, যে বার্তা আমাদের পাঠাতে হবে তা হল, এটাই যথার্থ সময় যখন তালিবান-সহ সমস্ত আফগানদের একসঙ্গে বসে কথা বলে সেই যুদ্ধে ইতি টানতে হবে যা পরস্পরকে হত্যা করে চলেছে। তালিবানের জন্য আমি শুধু একটি পরীক্ষাই রাখতে চাই যে কেন তালিবানরা (যদি সতি্যই তারা সন্ত্রাস থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়, কারণ তারা প্রকাশে্য বলেছে যে ISIS তাদের শত্রু–সতি্য ISIS আফগানদের মারছে, তারা আমেরিকার শত্রু এবং তারা আফগানদেরও শত্রু এবং তালিবান দাবি করেছে আফগানিস্তানের ৩০ শতাংশ তাদের দখলে) ISIS এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগান সেনার সঙ্গে দিচ্ছে না? এটাই সেই পরীক্ষা যা স্পষ্ট করে দেবে যে তালিবানরা সতি্যই জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরছে না কি নিজের নাগরিকদের প্রাণরক্ষায় ভূমিকাও নিচ্ছে না কি তাদের শুধু হত্যা করছে।

প্রশ্ন- সতি্যই কি ভারতে বসে বসে কী হচ্ছে, তা দেখার বিলাসিতা আছে? নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মরিয়া হয়ে DC চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে থাকা বাকি মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে। জালমে খলিলজাদ তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে জানিয়েছিলেন, ভারতের উচিত সরাসরি তালিবানের সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনায় বসা।

অমর সিনহা- আন্তঃ আফগান আলোচনার গতি কেউ জোর করে নির্ধারণ করতে পারবে না। আপনি যদি মার্কিন তালিবান চুক্তির দিকে দেখেন, সেনা প্রত্যাহার করার আমেরিকার সময়সীমা আছে কিন্তু আন্তঃ আফগান আলোচনা শেষ হওয়ার কোনও সময়সীমা নেই। তাই এ কথা বলা যে, সময় সম্পর্কে আমাদের কোনও বিলাসিতা নেই তা সতি্য ঠিক নয়। শেষপর্যন্ত আফগান জনতাই ঠিক করবে কখন তঁাদের সঙ্গে তালিবানের পুনর্মিলন হবে, আদপে তারা একে অন্যকে ক্ষমা করে সব ভুলে যেতে পারবে কি না। তালিবানের ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। আমার মতে, তালিবান সেই গতিতেই এগিয়ে যাবে যেখান থেকে তারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করতে পারবে। আমরা কিছুই করছি না, এটা বলাটাই ভুল। সংযোগ রক্ষা করা এবং পুনর্মিলন করা সবসময় প্রকাশে্য হয় না। কিন্তু পর্দার নেপথে্য আমি নিশ্চিত আমাদের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য আধিকারিকরা এ নিয়ে যথেষ্ট সক্রিয়। তাঁরা অন্তত আফগান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করছেন। মি. খলিলজাদ এখানে এসেছিলেন যাতে ভারত নিজের আধিপত্য খাটিয়ে কাবুলের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে। আমি নিশ্চিত পর্দার নেপথে্যও কাজকর্ম হয়েছে। কারণ আমরা কিছু ফলাফল ইতিমধ্যেই দেখেছি। হতে পারে, এর কারণ আমেরিকার করা তদ্বির যা ভারতে ইরানের পরামর্শে হয়েছে। প্রতে্যকেই দু’পক্ষকে বলেছে তাদের একজোট হওয়া অত্যন্ত জরুরি এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কখনওই ‘বিজয়ী সব ভোগ করে’ পরিস্থিতি হিসাবে দেখা উচিত নয়। কারণ, তাতে কাবুলের শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত টালমাটাল হয়ে পড়বে।

প্রশ্ন- তাহলে পিছনের দরজা দিয়ে আলোচনার রাস্তা কি খোলা ?

অমর সিনহা- আমি এর অংশ নই। কিন্তু আমি নিশ্চিত ভারত সরকার কখনওই পিঠে হেলান দিয়ে বসে পরিস্থিতি দেখছে না । অনেক কিছু হচ্ছে। কিন্তু কিছু জিনিস চুপিসাড়ে করা ভাল, বিশেষ করে তা যদি পুরনো বন্ধু সংক্রান্ত কিছু হয়। আমাদের সমস্যা এই যে আমদের (ভারত) অনেক বন্ধু। তাই আমরা কারও পক্ষ নিতে পারি না, কাউকে বাছতে পারি না। তাই এ ক্ষেত্রে করণীয় হল চুপিসাড়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দাও, বন্ধুদের অনুরোধ করো এবং যা সঠিক, তাকে সমর্থন করে এগিয়ে যাও।

প্রশ্ন- IC-814-এর মতো পুরনো স্মৃতি এবং ক্ষতও নিশ্চয়ই আছে?

অমর সিনহা- যখন কাবুলে ছিলাম, তখন কিছু প্রাক্তন তালিবানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। এই হাইজ্যাকিং পর্ব তালিবানের পক্ষে খুবই নজিরবিহীন ছিল। কিন্তু তালিবানের এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা বলে, ওরা হাইজ্যাকার নয়, পাকিস্তানিরা বিমান হাইজ্যাক করেছিল। কাবুলে নয়, ঘটনাটি ঘটেছিল নেপালে। ওরা বলে ওরা ভারতের জন্য মানবিক পদক্ষেপ করেছিল কারণ, বিমানটিকে বিশ্বের কোথাও অবতরণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না, জ্বালানি কমে আসছিল এবং ইসলামাবাদে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে যা তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে মোল্লা ওমরকে বার্তা পাঠানো হয়েছিল যে, কান্দাহার এয়ার খোলা আছে এবং তার পরই বিমানটি অবতরণ করে। আমাদের ক্ষোভ সেখানে শুরু হচ্ছে যে, যখন বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হল তখন কেন তালিবান তাদের ধরে আমাদের ফিরিয়ে দিল না? সেই সময় তালিবান শাসনে যারা ছিল তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ওরা বলে রাষ্ট্রদূত আপনি নিজেই বলেন যে তালিবান শাসনকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় আর আমরা তা সামগ্রিকভাবে করি না। তাই আমরা ভারতকে সাহায্য করতে, নাগরিকদের বঁাচাতে যতটুকু সম্ভব ততটুকু করেছি। অপহরণকারীদের সঙ্গে এবং যারা মুক্তি পেয়েছিল তাদের সঙ্গে যা হয়েছে তার জন্য ভারত আমাদেরই দোষ দেয়। অর্থাৎ IC-814 নিয়ে ওদের ধ্যানধারণা সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রশ্ন- তালিবানের সঙ্গে একঘরে বসে আলোচনায় অংশ নেওয়া নিয়ে ভারতের প্রয়োজনীতা মতভেদ দেখছি। বির্তক এটা নিয়েও চলছে যে কাশ্মীর প্রসঙ্গে না কি তালিবানের মত বদল হয়েছে?

অমর সিনহা- আমি মনে করি না তালিবান কখনও বলেছে ওরা কাশ্মীর বা কাশ্মীর নিয়ে হওয়া বিবাদে আগ্রহী। পাকিস্তানের কিছু অংশ চেষ্টা করছে এই দু’টো ঘটনাকে একসূত্রে বাধার। তারা তা করতে চাইছে এই সহজ কারণের জন্য যে, তারা ভাবে এই করে আমেরিকাকে এর মধে্য জড়াতে পারবে কারণ, আফগান সমীকরণ আমেরিকার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার পাকিস্তানের কাছে সমীকরণের উভয়দিকই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, তারা এই দু’য়ের মধে্য সমতা তথা যোগসূত্র তৈরি করতে চায়। শুধু দু’দিন আগেই নয়, সংবিধানের 370 ধারা প্রত্যাহারের সময়েও তালিবান এ কথা বলেছিল। পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে এরফলে দোহায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে। তখনও তালিবান মুখপাত্র সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে এই দুই বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সংবিধানের 370 ধারা সম্পূর্ণভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমরা তাকে সম্মান করি আর আমরা কাশ্মীর এবং তালিবানের মধে্য কোনও যোগসূত্র দেখি না। গত সপ্তাহে আমরা দেখেছিলাম সোশাল মিডিয়ায় কিছু তালিবান মন্তব্য যেমন, কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়া হবে প্রভৃতি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু আমি মনে করি, অনিষ্ট করার জন্যই তা করা হয়েছিল এবং তালিবান মুখপাত্র স্ট্যানিকজাই এবং শাহিন এগিয়ে এসে তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। এখানেই ওই অর্থহীন বিতর্কের নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। কিছু কিছু পক্ষ তা করবে কিন্তু তালিবান বা আফগান, কারওই ভারতের বিরুদ্ধে অনিষ্টের কোনও ভাবনা নেই, যেমনটা পাকিস্তান চায় ।

প্রশ্ন- এর আগে আপনি বলেছিলেন, তালিবানের নীতি পাকিস্তানের পরামর্শে তৈরি হয় এবং যতক্ষণ না সেই যোগসূত্র আলগা হচ্ছে ততক্ষণ ভারতের তরফে কোনও উদে্যাগ নেওয়া অনর্থক। ভারত কি রাওয়ালপিন্ডির প্রিজম চোখে রেখে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে আছে?

অমর সিনহা- একেবারেই না। পাকিস্তানের প্রিজম চোখে চাপিয়ে আফগানিস্তানের িদকে তাকিয়ে থাকা ভুল হবে। আপনাকে আফগানিস্তানের দিকে তাকাতে হবে নিজের পড়শি দেশ হিসাবে এবং SAARC হিসাবে। সতি্যটা হল এই যে একজন বাদেও SAARC সক্রিয় এবং কার্যকর থাকে। তাই আমাদের পাকিস্তানের দিকে দেখা উচিত নয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাদের এক্ষেত্রে একটি ভূমিকা আছে পালন করার জন্য এবং এখনও পর্যন্ত তা নেতিবাচক। আমাদের তা নিরপেক্ষ করতে যা যা করা দরকার, করতে হবে। আফগানিস্তানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিকভাবে মানবাধিকারমূলক সহযোগিতা, পরিকাঠামোর পুননির্মাণের উপর নির্ভর করা উচিত যাতে তার ফলে আমাদের দেশের চারপাশে শান্তি এবং অগ্রগতি বহাল থাকে। আমরা অনুভব করি, শান্তিতে বিভেদ তৈরি করা যায় না এবং তা আমরা আমাদের চারপাশে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করবই। পাকিস্তান একে এমন একটি সমীকরণ হিসাবে দেখে, যার মাধ্যমে এক থেকে অন্য উদ্দেশ্য তারা সাধন করতে পারবে। কিন্তু আমাদের একে খারিজ করতেই হবে।

প্রশ্ন- কিন্তু আফগান রাজনৈতিক পুনর্মিলনে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন না করার ব্যাপারে ভারতের সংকোচ আদৌ কি যুক্তিযুক্ত, বিশেষ করে তখন, যখন তা ধারাবাহিকভাবে এই রাওয়ালপিণ্ডি-কাবুল সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে থাকার উপর নির্ভরশীল?

অমর সিনহা- ১৮ বছর ধরে পাকিস্তান একটাই নীতি অনুসরণ করে এসেছে আর তার জন্য তাকে মানুষের প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার মতো বিরাট মূল্য চোকাতে হয়েছে। ভালো হোক বা মন্দ, তারা একটি নির্দিষ্ট পথেই বরাবর হেঁটে এসেছে। আজ তারা মনে করে, তারা ফিনিশিং লাইনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘটনা হল, তারা কী তালিবানকে ছেড়ে দেবে আফগানিস্তানে গিয়ে আফগানদের সঙ্গে পুনর্মিলন করতে এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীনভাবে দেশ চালাতে? একবার তালিবান কাবুলে ফিরে এসে যদি আফগানিস্তান-নির্ভর জাতীয় শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারে এবং বিশ্বের কাছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, তাহলে ভারতের তাদের নিয়ে কোনও সংকোচ থাকবে না এবং ভারত নিজের নীতি অনুযায়ী চলবে। তালিবানও ভারতের উন্নয়নমূলক অংশীদারিত্বকে গত 18 বছর ধরে স্বাগত জানিয়ে এসেছে। কিছু ঘটনা যেমন দেলারম-জারাঞ্জ সড়কপথ যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন কয়েক দফা হামলা হওয়া ছাড়া আফগানিস্তানে আমাদের উদে্যাগে হওয়া কোনও প্রকল্পে কখনও তালিবানের তরফে কোনও হামলা হয়নি। পার্লামেন্ট, সলমা বঁাধ প্রভৃতিতেও কখনও আক্রমণ হয়নি, যা আমাদের মাথায় রাখা দরকার।

প্রশ্ন- আর ভারতীয়দের অপহরণ?

অমর সিনহা- ভারতীয়দের অপহরণের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এর পিছনে একাধিক স্থানীয় এবং অর্থনৈতিক কারণও ছিল যা তাদের এমন ঘটনা ঘটাতে বাধ্য করেছিল।

প্রশ্ন- ভারত কী সঠিক পদক্ষেপ করেছিল যখন এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল COVID-19 চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আফগানিস্তানে নিজেদের দুটি কনসু্লেট বন্ধ করে দেবে?

অমর সিনহা- খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিন পড়েই সম্প্রতি আমি এটা জানতে পেরেছি। হেরাট এবং জালালাবাদের অবস্থান দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি, এটা করা হয়েছে ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে। সংক্রমণের জেরে হেরাট বিপর্যস্ত ছিল এবং ইরান থেকে যেখানে যেখানে ভাইরাস ছড়িয়েছে, হেরাট ছিল তাদের অন্যতম। তাই এই পদক্ষেপের যে কারণ আমি জানি, তা COVID-এর সঙ্গেই সম্পর্কিত আর এগুলি সাময়িক পদক্ষেপ। আমরা অপেক্ষা করব এবং নজরে রাখব। লকডাউনের ফলে জালালাবাদ এবং হেরাটের মানুষের পাশে দাঁড়ানো কঠিন হবে। অতএব এটা কেবলমাত্র চিকিৎসাজনিত সতর্কতা হিসাবেই করা হয়েছে।

প্রশ্ন- দোহা থেকে কাবুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আপনি কী আশ্বাস দিতে পারবেন যে তালিবান যদি ক্ষমতায় ফেরে তাহলে নয়ের দশকের শেষাশেষি যা পরিস্থিতি ছিল, তা আবার ফিরে আসবে না? এই মুহূর্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক কী কী?

অমর সিনহা: আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় এটাই থাকবে যে তালিবান একেবারেই নিজেদের বদলে ফেলবে না এবং 1996 সালে যে রকম পরিস্থিতি ছিল, সেই ছবি ফেরাতে চাইবে। তাহলে আফগান সমাজ গভীরভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং সেই পুরনো সময়ে ফিরে যাবে যখন ভয়াবহ সংঘর্ষ আর যুদ্ধবৎ পরিস্থিতি হামেশা লেগেই থাকত। এটাই সবচেয়ে খারাপ হবে। আমরা যেটা বুঝছি, সেটা হল তালিবান প্রকাশে্য যা বলছে কিংবা তাদের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে যে দাবি জানাচ্ছে যে তারা আমূল বদলে গিয়েছে, যে তারা ক্ষমতার ভাগ পেতে রাজি নয়–এ সব কিন্তু এখনও প্রমাণ হয়নি। আলোচনার টেবিলে তাদের ফিরে আসতেই হবে এবং যারা, যেভাবে আলোচনার উদে্যাগ নিচ্ছে,তাতে তাদের অংশ নিতেই হবে। তার পর সেখান থেকে একটি ব্লু প্রিন্ট নিয়ে বেরোতে হবে। তালিবান কী কী চায় এবং কীভাবে দেশকে দেখতে চায়, সেই তালিকার কিছু কিছু অংশ ফাঁস হয়ে গেছে। কিন্তু তালিবান সেই তালিকা অস্বীকার করেছে। কিন্তু যদি তা সতি্য বলে ধরে নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তালিবানের কোনও বদল আসেনি। কিছু কিছু বিষয়ে তাদের স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেই যেমন নারীদের অধিকার, গণতন্ত্র এবং আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের ভূমিকা। বাকি যা যা, আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ সদর্থকভাবে আকর্ষণ করে নিয়েছে, তার মধে্য উল্লেখযোগ্য হল সন্ত্রাসের শিকড় কেটে ফেলা, হিংসায় ইতি, যা খুবই প্রতিশ্রুতিদায়ক। আমি শুধু আশা করব, তারা আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যেন খেলা না করে এবং মুখে যা বলছে, তা যেন স্রেফ কথার কথা হয়েই না থেকে যায়।

এমন খবর এসেছিল যে, তালিবানের তরফে মুখ্য সংযোগকর্তা শের মহম্মদ আব্বাস আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার সমালোচনা করে নেতিবাচক আখ্যা দিয়েছিলেন । এমনও শোনা গেছিল যে, কিছু টুইটে তালিবান মুখপাত্র দাবি করেছেন, তাঁদের সঙ্গে নয়াদিল্লির বন্ধুত্ব ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হচ্ছে । এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই আলোড়ন তৈরি হয়েছিল । যদিও তা কেটে গেল উচ্চপদস্থ এক ভারতীয় আধিকারিকের আশ্বাসে । তিনি বললেন, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থানে কোনও বদল আসেনি এবং তালিবানরা কাশ্মির বিবাদ নিয়ে একেবারেই আগ্রহী নয় । সাংবাদিক স্মিতা শর্মাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কাবুলে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে NSAB–এর (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজ়রি বোর্ড) সদস্য অমর সিনহা জানিয়েছেন, " আমি মনে করি না তালিবান কখনও এ কথা বলেছে যে, তারা কাশ্মীর কিংবা একে নিয়ে হওয়া বিবাদে মনোযোগী ছিল। এই দুই বিষয়কে একসূত্রে বাঁধার চেষ্টা পাকিস্তানের একাংশ করেছে । খুব সহজ একটি কারণের জন্য তারা এটা করছে কারণ তারা মনে করে, এভাবেই তারা আমেরিকাকে এই বিবাদে জড়াতে পারবে । কারণ আমেরিকার কাছে আফগান সমীকরণের দিকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ । আর পাকিস্তানের কাছে সমীকরণের উভয় দিকই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তারা এই দুইয়ের মধে্য যোগসূত্র টানতে বা সামঞ্জস্য খুঁজে পেতে চায়।"

যুদ্ধবিদীর্ণ আফগানিস্তানে জাতীয় স্তরে শান্তি ফিরিয়ে আনা ও পুনর্মিলনের পক্ষে সওয়ালকারী আঞ্চলিক অংশীদারভুক্ত দেশগুলির তালিকায় অন্যতম হল ভারত। দোহায় তালিবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের মুখপাত্র পরে টুইট করে সেই বিতর্কিত টুইট খারিজ করেছিলেন এবং গুরুত্ব সহকারে জানিয়েছিলেন যে, এই ইসলামিক শক্তি অন্যান্য পড়শি দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কখনও হস্তক্ষেপ করে না। অমর সিনহা জোর দিয়ে বলেছেন, " শুধুমাত্র দু’দিন আগে নয়। যখন সংবিধানের 370 ধারা রদবদল হল, তখনও তালিবান এই কথা বলেছিল । পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এর ফলে দোহায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে। সেবারও সঙ্গে সঙ্গে তালিবান মুখপাত্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে এই দু’টি বিষয়ের মধে্য কোনও যোগসূত্র নেই । সংবিধানের 370 ধারা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি এবং কাশ্মীর ইশু ও তালিবানের মধে্য আমরা কোনও যোগসূত্র পাইনি । গত সপ্তাহে আমরা দেখেছিলাম কীভাবে সোশাল মিডিয়ায় কিছু তালিবান মন্তব্য নিয়ে ঝড় উঠেছিল, যেখানে তারা কীভাবে তারা কাশ্মীর ছিনিয়ে নেবে ইত্যাদির মতো একাধিক দাবি করেছি । কিন্তু আমি মনে করি যে গোটাটাই করা হয়েছিল অনিষ্ট করার উদ্দেশে্য আর তালিবান মুখপাত্র স্ট্যানিকজাই এবং সুহেল শাহিন নিজেদের মন্তবে্য তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এখানেই এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে ইতি টানা উচিত ।" 2018 সালে মস্কো আলোচনায় অ-সরকারি স্তরে যে দুই অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক নয়াদিল্লির প্রতিনিধি হিসাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং যঁরা অন্যদের পাশাপাশি সর্বপ্রথম তালিবান প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক ঘরে থেকেছিলেন, সিনহা তাঁদের মধে্য অন্যতম। বিগত 18 বছরে ভারত আফগান-নেতৃত্বাধীন, আফগান-অধীন এবং আফগান-নিয়ন্ত্রিত শান্তি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে, তালিবানের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসার প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। আমেরিকায় আফগানিস্তানের বিশেষ রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদ, তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে মন্তব্য করেছিলেন যে, ভারতের উচিত তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় বসা এবং আফগান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর ভূমিকা পালন করা । তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সিনহা বলেন, ভারত তালিবান-সহ সকলের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে চায় কিন্তু তার আগে তাদের জানাতে হবে, তারা ঠিক কী চায়।

অমর সিনহা বলেছেন, “আফগানিস্তানের সকল গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত আলোচনায় বসতে চায়। এটা খুবই স্পষ্ট। তারা আমাদের অন্যতম কাছের পড়শি দেশ। তাই দেশটির সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করতে চাই। কিন্তু তার আগে অন্তত তালিবানকে এটা প্রমাণ করতে হবে যে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তারা হিংসার সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছে এবং আফগানদের খুন করা বন্ধ করে দিয়েছে।” প্রাক্তন রাষ্ট্রদূতের কথায়, “ আমি এই মতে বিশ্বাসী নই যে পড়শি দেশগুলির ক্ষেত্রে কোনও ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দেওয়ার দরকার ভারতের আছে। আমি মনে করি, প্রতি ক্ষেত্রে ভারতের নিজস্ব নীতি থাকা উচিত এবং আমাদের এলাকার মধে্য সেই সব নীতির বাস্তবায়নের ফলে কী কী প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে এর যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকা উচিত। না হলে আমাদের মুখের কথা এবং কাজে শক্তি প্রদর্শন করার দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুতর অবমাননা হিসাবেই দেখা হবে। তাই এই এলাকা নিয়ে অন্যরা যে বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, আমাদেরও উচিত সেই তালিকায় যোগদান করা। ”

দেখুন সাক্ষাৎকার...

যদিও তাঁর ইঙ্গিত, ভারত পিছনের দরজা দিয়ে আলাপ-আলোচনা বজায় রেখে চলেছে এবং এটা বলা ভুল যে নয়াদিল্লি দূর থেকে দেখছে, কাবুলে কী হচ্ছে। সিনহার জবাব, “ আমরা যে কিছুই করছি না, সেটা বলাটা ভুল। যোগাযোগ বজায় রাখা এবং পুনর্মিলন ঘটানো সংক্রান্ত অনেক কিছু প্রকাশে্য করা যায় না । কিন্তু আমি নিশ্চিত, পর্দার আড়ালে আমাদের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য আধিকারিকরা এ বিষয়ে সক্রিয়। তারা অন্তত আফগান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ দেওয়া-নেওয়া চালিয়ে যাচ্ছে।” তাঁর আরও সংযোজন, “ আমি এর অংশ নই (পর্দার আড়ালে আলোচনা) কিন্তু আমি নিশ্চিত, ভারত সরকার সারাক্ষণ পিঠে হেলান দিয়ে বসে নেই। অনেক কিছু ঘটে চলেছে। কিছু কিছু জিনিস চুপিসাড়েই করা উচিত, বিশেষ করে তা যখন আপনি আপনার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে শুরু করতে চলেছেন। আমাদের সমস্যা হল এই যে, আমাদের (ভারত) বন্ধুর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই আমরা কারও পক্ষ নিতে পারি না, একজনকে ছাপিয়ে অন্যজনকে বাছতে পারি না। তাই চুপিসাড়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানাই, তাদের কাছে আবেদন করি এবং সেরা পথে হেঁটে, অগ্রগতির দিকে এগিয়ে চলি। " COVID-19 সংকটের আবহে জালালাবাদ এবং হেরাটে ভারতীয় কনসু্লেট বন্ধ হওয়ার খবর নিয়ে প্রশ্ন করলে অমর সিনহা বলেছেন, প্যানডেমিকের জন্যই আপাতত কনসু্লেট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে । তাঁর কথায়, “হেরাট এবং জালালাবাদের অবস্থান দেখে বুঝতে পারছি, ভাইরাস সংক্রমণের ভয়েই এই পদক্ষেপ । হেরাট সংক্রমণের জেরে বিপর্যস্ত আর ইরান থেকে ভাইরাস সংক্রমণ যেখানে যেখানে হয়েছে, হেরাট তাদের মধে্য অন্যতম । তাই আমি বুঝতে পারছি, COVID -র জন্যই এই পদক্ষেপ আর এগুলো সাময়িক । আমরা অপেক্ষা করছি, নজর রাখছি । লকডাউনের এই সময়ে জালালাবাদ এবং হেরাটের মানুষের পাশে দাঁড়ানো কঠিন। তাই সম্ভবত, এটি চিকিৎসাজনিত একটি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ।”

স্মিতা শর্মা অমর সিনহার সঙ্গে কথা বলেছেন আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তি, আন্তঃআফগান আলোচনা, তালিবানের ক্ষমতা আসার অর্থ ১৯৯৬ সালের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি কি না, IC-814 হাইজ্যাকের ঘটনায় ভারতের বিশ্বাসভঙ্গ এবং আরও নানা বিষয়ে ।

প্রশ্ন: এত ঘটা করে ফেব্রুয়ারি মাসে দোহায় যে আমেরিকা-তালিবান শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হল, আদপে তা কতটা ভঙ্গুর? এটা কী ইতিমধে্যই ভাঙতে বসেছে?

অমর সিনহা- এটা বাস্তবিক অর্থে কোনও শান্তি চুক্তি ছিল না। এটা ছিল আমেরিকা সরকার এবং তালিবানের মধে্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা আফগানিস্তানে শান্তি ফেরাতেই করা হয়েছিল। শান্তি হল আন্তঃআফগান আলোচনার অন্তিম ফলাফল। 29 ফেব্রুয়ারি হওয়া চুক্তি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কথা জানায়। সঙ্গে কিছু সময়সীমার হদিস দেয় এবং কিছু প্রতিশ্রুতির কথা জানায়, যে তালিকায় রয়েছে, কত বন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হবে, কখন সেই প্রক্রিয়া শুরু হবে, কোন কোন নির্দিষ্ট তারিখে আমেরিকার তালিবানদের উপর জারি করা বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা উচিত প্রভৃতি। গোটা বিষয়টা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে কারণ চুক্তিতে যে সময়সীমার কথা বলা হয়েছে, তা ধরনে-ধারণে প্রবল উচ্চাকাঙ্খী ছিল। তা সরকার গঠন এবং আফগানিস্তানে নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। এই দুই প্রক্রিয়াই সেখানে সমান্তরালভাবে চলছিল। আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর তারিখ ছিল 10 মার্চ, সেখানেই আবার প্রেসিডেন্ট ঘনি এবং আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ শপথ নিলেন 9 মার্চ। দু’জন প্রেসিডেন্টের জন্য দু’টো পৃথক পৃথক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। সৌভাগ্যবশত, সেই সমস্যা এখন মিটে গেছে । আফগান রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের তরফে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল যে তাঁরা শেষ পর্যন্ত অন্তত ঐক্যমতে্যর নিরিখে একটি সর্বসম্মত অবস্থানে আসতে পেরেছিলেন, যেখান থেকে তাঁরা বর্তমানে আন্তঃআফগান আলোচনায় তালিবানকে গুরুত্ব সহকারে যোগদান করতে বাধ্য করতে পেরেছেন ।

প্রশ্ন- গত দশকে আফগানিস্তান রাজনৈতিক স্তরে যে লাভ করেছে, তাতে কতটা ঝঁুকি মিশে আছে? আর আমেরিকা- তালিবান চুক্তির ক্ষেত্রেই বা তা কতটা?

অমর সিনহা- যেভাবে লেখা হয়েছিল, যদি ঠিক সেভাবেই সব কিছু এগোয়, তাহলে আমি মনে করি না, আমাদের কোনও সমস্যা হতে পারে । ওই চুক্তিতে সতি্যই তালিবানকে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসা এবং আফগান সরকার ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত হতে সচেষ্ট করে । যদি তাকে বিশ্বাস করে তালিবানরা তা কার্যকর করে, তাহলে আমি মনে করি, ভাল ফল আসবে । প্রতে্যকে চায়, হিংসা শেষ হোক, বিশেষ করে আফগানরা তাই চান । এই চুক্তিকে তালিবানকে এই মর্মেও প্রতিশ্রুতি দিতে বলা হয়েছে যে তারা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করবে, বিশেষ করে তখন, যখন তারা কাবুলে ফিরে আসবে। আর সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি ছাড়াও তাদের সন্ত্রাসের মদতদাতাদের থেকেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। গত 18 বছর ধরে ওরা এর সুবিধাভোগী ছিল।

প্রশ্ন- ক্ষমতা বণ্টনের চুক্তি নিয়ে যে রফা হয়েছিল, তা অনুযায়ী আফগানিস্তানে হিংসা অন্তত 80 শতাংশ হ্রাস করবে তালিবান–আমেরিকার আধিকারিকদের এই বোঝাপড়া তালিবান এড়িয়ে গেছে । গত 24 থেকে 48 ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানকার 34 টি প্রদেশের কুড়িটিতে সংঘর্ষের খবর মিলেছে । প্রেসিডেন্ট ঘনিকে নিজের অবস্থান প্রতিরোধমূলক থেকে পরিবর্তন করে প্রতিঘাতমূলক করতে হয়েছে । এই চক্র কোথায় গিয়ে থামবে ?

অমর সিনহা- দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, এই চুক্তি আফগান এবং আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে হিংসার হার কমানোর ক্ষেত্রে কোনও শর্ত আরোপ করে না । চুক্তিতে বলা আছে যে, সাত দিন ধরে হিংসা কম হবে । প্রতিশ্রুতি এটাই যে তালিবান আমেরিকা এবং তার মিত্র দেশগুলির উপর আক্রমণ করবে না । আফগান সরকার কিংবা আফগান প্রদেশগুলিতে হিংসা বন্ধের কোনও প্রতিশ্রুতি সেখানে দেওয়া হয়নি। তালিবানের তরফে তাদের লাগাতার আক্রমণ তথা ‘স্প্রিং অফেনসিভ’ এখনও ঘোষণা করা না হলেও আমরা তাদের সংঘর্ষের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে দেখছি । কিন্তু তালিবানরা তা না ঘোষণা করলেও (সচরাচর মার্চ বা এপ্রিলে তারা তা করে থাকে) সংঘর্ষের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে...এমন রিপোর্ট এসেছে, যাতে বলা হয়েছে তালিবান আন্তঃআফগান আলোচনায় বসার আগে বেশ কিছু প্রদেশ দখলের চেষ্টা করবে। কারণ তারা চাইবে শক্তি বাড়িয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে। আমি মনে করি, তালিবানকে অনেক বেশি বৈধতা দেওয়া হয়েছে যা তাদের সম্ভবত আলোচনায় বসার আগে যতটা দরকার, তার থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটাই তাদের সেনাবাহিনীর কৌশল।

প্রশ্ন- শিখ সংখ্যালঘুদের উপর, শিশু-প্রসূতি হাসপাতালে পর পর হামলা থেকে শুরু করে কুন্দুজে অন্তত 17 টি গোয়েন্দা পোস্ট- বিশেষ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলছেন নেপথে্য ইসলামিক স্টেট খোরাসান আর প্রেসিডেন্ট ঘনি বলছেন, এটা তালিবানের কাজ। ভারত কী মনে করে?

অমর সিনহা- সতি্যটা হল এই যে, এই সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি পরস্পর যুক্ত। একের থেকে অন্যকে আলাদা করা খুবই কঠিন। এরা নিজেদের সম্পদ, সদস্য, কৌশল, মতাদর্শ–সবকিছুই লেনদেন করে । এবার কে ভাল আর কে মন্দ সন্ত্রাসবাদী, সেই বিভেদ করা সঠিক নীতি নয়। এই সব আক্রমণের একটা নির্দিষ্ট অর্থ আছে। এরা মৌলিকভাবে এমন একটা জরুরি অবস্থা জারি করতে চাইছে যেখানে সংঘর্ষদীর্ণ আফগানদের মানসিক অবস্থা নিয়ে তারা খেলতে পারে এবং আফগান সরকারকে চরম চাপের মধে্য রাখতে পারে এই বলে যে, আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু করার আগে যতক্ষণ না তোমরা আমাদের দেওয়া সব শর্ত মানছো, ততক্ষণ অগুনতি নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হবে। এটা সেই সব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির কাছে সুবিধাজনক হয়েছে, যাদের উত্থান হয়েছে গত কয়েক বছরের মধে্য। যে সব হামলায় দায় তালিবানের পক্ষে নেওয়া কঠিন হত, এই সংগঠনগুলি তার দায় স্বীকার করে নিচ্ছে । এগুলো সবই এক ধরনের খেলা আর তাই আমাদের এটা বিচার করা উচিত নয় যে, কোন সংগঠন এ সব করছে। সতি্যটা হল আফগানিস্তানে যে হিংসা চলছে, তার একটি ইতিহাস আছে, প্রেক্ষাপট আছে এবং আফগানরা তা জানে। আমি নিশ্চিত, মি. খলিলজাদও তা জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই সমীচিন হবে যে আমরা এই ধরনের সব দায় থেকে তালিবানকে মুক্ত করি কারণ তালিবানকে বর্তমানে তুলে ধরা হচ্ছে এমন একটি শক্তি হিসাবে, যারা বদলে গিয়েছে। বর্তমানে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি এবং হিংসাজনক কোনও শক্তি নয়। তবে তা হাতেকলমে প্রমাণ করা এখনও বাকি।

প্রশ্ন- দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারত লাল সতর্কতা জারি করেছে। যে দুই রাষ্ট্রদূত দৃষ্টিভঙ্গী বদলের পর অসরকারিভাবে ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মস্কোয় তালিবানের সঙ্গে একই ঘরে থেকে, আপনি তঁাদের অন্যতম। গত বছর রাইসিনা আলোচনায় তত্কালীন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, তালিবানের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের উচিত, ব্যান্ডওয়াগনে ঝাঁপিয়ে পড়া। সরাসরিভাবে তালিবানের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে ভারতের সুযোগ কোথায়?

অমর সিনহা- আফগানিস্তানে সব গোষ্ঠীর সঙ্গে ভারত কথা বলবে। এটা খুবই স্পষ্ট, এটি আমাদের নিকট পড়শি দেশ। আমরা প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কথা বলতে চাই। কিন্তু আগে তালিবান প্রমাণ করুক যে তারা একটি রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, হিংসা ছেড়ে দিয়েছে এবং আফগানদের হত্যা বন্ধ করে দিয়েছে। বাকিরা কে কী বলেছে আমি শুনেছি। আমি বিশ্বাস করি না, পড়শি দেশ এলাকায় ভারতকে কোনও ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দিতে হবে। আমি মনে করি, ভারতের উচিত নিজস্ব নীতি নির্ধারণ করা এবং এই এলাকায় যে কোনও ফলাফলকে রূপ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকা। নচেৎ, আঞ্চলিক হওয়া নিয়ে আমাদের মুখের কথা এবং কাজে শক্তি প্রদর্শন করার দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুতর অবমাননা হিসাবেই দেখা হবে। তাই এই এলাকা নিয়ে অন্যরা যে বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, আমাদেরও উচিত সেই তালিকায় যোগদান করা।অসরকারিভাবে মস্কোয় গিয়ে এই প্রথম তালিবান আঞ্চলিক দেশের সঙ্গে কথা বলেছিল। রাশিয়াও এ নিয়ে এগিয়েছিল। আন্তঃ আফগান আলোচনা ঐতিহাসিক ছিল। কারণ এটি প্রথম গোটা যোগাযোগকে গণতান্ত্রিক রূপ দিয়েছিল। তার আগে এই সব যোগাযোগের দরুণ, মার্কিন-তালিবান চুক্তিই হয়েছিল। আদপে যা ছিল আমেরিকা সরকার এবং তালিবানের মধে্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা। অতিথি দেশ কাতার ছাড়া সেই সময় ওই ঘরে কেউ ছিল না, NATO বা আফগানিস্তানের মতো প্রধান দলও নয়, যদিও না আবার তালিবানের ছদ্মবেশে সেখানে কোনও ISI-এর চর থেকে থাকে। তাই দোহা চুক্তিতে ভারতের যোগ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

বর্তমানে আমরা আগের থেকে আরও ভাল জায়গায় আছি। আর এখানে ভারতের পক্ষে বৃহত্তর গঠনাত্মক ভূমিকা পালন করারও সুযোগ আছে। যা আমাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী, আফগান প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্রকে নিরন্তর সমর্থন করে যাওয়ার আমাদের নীতি, গোটা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র প্রভৃতি থেকে এই সত্য প্রকাশিত হয়। সুতরাং, যে বার্তা আমাদের পাঠাতে হবে তা হল, এটাই যথার্থ সময় যখন তালিবান-সহ সমস্ত আফগানদের একসঙ্গে বসে কথা বলে সেই যুদ্ধে ইতি টানতে হবে যা পরস্পরকে হত্যা করে চলেছে। তালিবানের জন্য আমি শুধু একটি পরীক্ষাই রাখতে চাই যে কেন তালিবানরা (যদি সতি্যই তারা সন্ত্রাস থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়, কারণ তারা প্রকাশে্য বলেছে যে ISIS তাদের শত্রু–সতি্য ISIS আফগানদের মারছে, তারা আমেরিকার শত্রু এবং তারা আফগানদেরও শত্রু এবং তালিবান দাবি করেছে আফগানিস্তানের ৩০ শতাংশ তাদের দখলে) ISIS এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আফগান সেনার সঙ্গে দিচ্ছে না? এটাই সেই পরীক্ষা যা স্পষ্ট করে দেবে যে তালিবানরা সতি্যই জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরছে না কি নিজের নাগরিকদের প্রাণরক্ষায় ভূমিকাও নিচ্ছে না কি তাদের শুধু হত্যা করছে।

প্রশ্ন- সতি্যই কি ভারতে বসে বসে কী হচ্ছে, তা দেখার বিলাসিতা আছে? নভেম্বরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মরিয়া হয়ে DC চেষ্টা করছে আফগানিস্তানে থাকা বাকি মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে। জালমে খলিলজাদ তাঁর সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে জানিয়েছিলেন, ভারতের উচিত সরাসরি তালিবানের সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনায় বসা।

অমর সিনহা- আন্তঃ আফগান আলোচনার গতি কেউ জোর করে নির্ধারণ করতে পারবে না। আপনি যদি মার্কিন তালিবান চুক্তির দিকে দেখেন, সেনা প্রত্যাহার করার আমেরিকার সময়সীমা আছে কিন্তু আন্তঃ আফগান আলোচনা শেষ হওয়ার কোনও সময়সীমা নেই। তাই এ কথা বলা যে, সময় সম্পর্কে আমাদের কোনও বিলাসিতা নেই তা সতি্য ঠিক নয়। শেষপর্যন্ত আফগান জনতাই ঠিক করবে কখন তঁাদের সঙ্গে তালিবানের পুনর্মিলন হবে, আদপে তারা একে অন্যকে ক্ষমা করে সব ভুলে যেতে পারবে কি না। তালিবানের ক্ষেত্রেও এ কথা খাটে। আমার মতে, তালিবান সেই গতিতেই এগিয়ে যাবে যেখান থেকে তারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করতে পারবে। আমরা কিছুই করছি না, এটা বলাটাই ভুল। সংযোগ রক্ষা করা এবং পুনর্মিলন করা সবসময় প্রকাশে্য হয় না। কিন্তু পর্দার নেপথে্য আমি নিশ্চিত আমাদের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য আধিকারিকরা এ নিয়ে যথেষ্ট সক্রিয়। তাঁরা অন্তত আফগান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করছেন। মি. খলিলজাদ এখানে এসেছিলেন যাতে ভারত নিজের আধিপত্য খাটিয়ে কাবুলের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পারে। আমি নিশ্চিত পর্দার নেপথে্যও কাজকর্ম হয়েছে। কারণ আমরা কিছু ফলাফল ইতিমধ্যেই দেখেছি। হতে পারে, এর কারণ আমেরিকার করা তদ্বির যা ভারতে ইরানের পরামর্শে হয়েছে। প্রতে্যকেই দু’পক্ষকে বলেছে তাদের একজোট হওয়া অত্যন্ত জরুরি এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কখনওই ‘বিজয়ী সব ভোগ করে’ পরিস্থিতি হিসাবে দেখা উচিত নয়। কারণ, তাতে কাবুলের শাসনব্যবস্থা অত্যন্ত টালমাটাল হয়ে পড়বে।

প্রশ্ন- তাহলে পিছনের দরজা দিয়ে আলোচনার রাস্তা কি খোলা ?

অমর সিনহা- আমি এর অংশ নই। কিন্তু আমি নিশ্চিত ভারত সরকার কখনওই পিঠে হেলান দিয়ে বসে পরিস্থিতি দেখছে না । অনেক কিছু হচ্ছে। কিন্তু কিছু জিনিস চুপিসাড়ে করা ভাল, বিশেষ করে তা যদি পুরনো বন্ধু সংক্রান্ত কিছু হয়। আমাদের সমস্যা এই যে আমদের (ভারত) অনেক বন্ধু। তাই আমরা কারও পক্ষ নিতে পারি না, কাউকে বাছতে পারি না। তাই এ ক্ষেত্রে করণীয় হল চুপিসাড়ে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দাও, বন্ধুদের অনুরোধ করো এবং যা সঠিক, তাকে সমর্থন করে এগিয়ে যাও।

প্রশ্ন- IC-814-এর মতো পুরনো স্মৃতি এবং ক্ষতও নিশ্চয়ই আছে?

অমর সিনহা- যখন কাবুলে ছিলাম, তখন কিছু প্রাক্তন তালিবানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। এই হাইজ্যাকিং পর্ব তালিবানের পক্ষে খুবই নজিরবিহীন ছিল। কিন্তু তালিবানের এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ আলাদা। ওরা বলে, ওরা হাইজ্যাকার নয়, পাকিস্তানিরা বিমান হাইজ্যাক করেছিল। কাবুলে নয়, ঘটনাটি ঘটেছিল নেপালে। ওরা বলে ওরা ভারতের জন্য মানবিক পদক্ষেপ করেছিল কারণ, বিমানটিকে বিশ্বের কোথাও অবতরণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না, জ্বালানি কমে আসছিল এবং ইসলামাবাদে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অনুরোধে যা তাদের দূতাবাসের মাধ্যমে মোল্লা ওমরকে বার্তা পাঠানো হয়েছিল যে, কান্দাহার এয়ার খোলা আছে এবং তার পরই বিমানটি অবতরণ করে। আমাদের ক্ষোভ সেখানে শুরু হচ্ছে যে, যখন বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হল তখন কেন তালিবান তাদের ধরে আমাদের ফিরিয়ে দিল না? সেই সময় তালিবান শাসনে যারা ছিল তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। ওরা বলে রাষ্ট্রদূত আপনি নিজেই বলেন যে তালিবান শাসনকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় আর আমরা তা সামগ্রিকভাবে করি না। তাই আমরা ভারতকে সাহায্য করতে, নাগরিকদের বঁাচাতে যতটুকু সম্ভব ততটুকু করেছি। অপহরণকারীদের সঙ্গে এবং যারা মুক্তি পেয়েছিল তাদের সঙ্গে যা হয়েছে তার জন্য ভারত আমাদেরই দোষ দেয়। অর্থাৎ IC-814 নিয়ে ওদের ধ্যানধারণা সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রশ্ন- তালিবানের সঙ্গে একঘরে বসে আলোচনায় অংশ নেওয়া নিয়ে ভারতের প্রয়োজনীতা মতভেদ দেখছি। বির্তক এটা নিয়েও চলছে যে কাশ্মীর প্রসঙ্গে না কি তালিবানের মত বদল হয়েছে?

অমর সিনহা- আমি মনে করি না তালিবান কখনও বলেছে ওরা কাশ্মীর বা কাশ্মীর নিয়ে হওয়া বিবাদে আগ্রহী। পাকিস্তানের কিছু অংশ চেষ্টা করছে এই দু’টো ঘটনাকে একসূত্রে বাধার। তারা তা করতে চাইছে এই সহজ কারণের জন্য যে, তারা ভাবে এই করে আমেরিকাকে এর মধে্য জড়াতে পারবে কারণ, আফগান সমীকরণ আমেরিকার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার পাকিস্তানের কাছে সমীকরণের উভয়দিকই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, তারা এই দু’য়ের মধে্য সমতা তথা যোগসূত্র তৈরি করতে চায়। শুধু দু’দিন আগেই নয়, সংবিধানের 370 ধারা প্রত্যাহারের সময়েও তালিবান এ কথা বলেছিল। পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে এরফলে দোহায় শান্তি প্রক্রিয়ায় প্রভাব পড়বে। তখনও তালিবান মুখপাত্র সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছিলেন যে এই দুই বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। সংবিধানের 370 ধারা সম্পূর্ণভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমরা তাকে সম্মান করি আর আমরা কাশ্মীর এবং তালিবানের মধে্য কোনও যোগসূত্র দেখি না। গত সপ্তাহে আমরা দেখেছিলাম সোশাল মিডিয়ায় কিছু তালিবান মন্তব্য যেমন, কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়া হবে প্রভৃতি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু আমি মনে করি, অনিষ্ট করার জন্যই তা করা হয়েছিল এবং তালিবান মুখপাত্র স্ট্যানিকজাই এবং শাহিন এগিয়ে এসে তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। এখানেই ওই অর্থহীন বিতর্কের নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। কিছু কিছু পক্ষ তা করবে কিন্তু তালিবান বা আফগান, কারওই ভারতের বিরুদ্ধে অনিষ্টের কোনও ভাবনা নেই, যেমনটা পাকিস্তান চায় ।

প্রশ্ন- এর আগে আপনি বলেছিলেন, তালিবানের নীতি পাকিস্তানের পরামর্শে তৈরি হয় এবং যতক্ষণ না সেই যোগসূত্র আলগা হচ্ছে ততক্ষণ ভারতের তরফে কোনও উদে্যাগ নেওয়া অনর্থক। ভারত কি রাওয়ালপিন্ডির প্রিজম চোখে রেখে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে আছে?

অমর সিনহা- একেবারেই না। পাকিস্তানের প্রিজম চোখে চাপিয়ে আফগানিস্তানের িদকে তাকিয়ে থাকা ভুল হবে। আপনাকে আফগানিস্তানের দিকে তাকাতে হবে নিজের পড়শি দেশ হিসাবে এবং SAARC হিসাবে। সতি্যটা হল এই যে একজন বাদেও SAARC সক্রিয় এবং কার্যকর থাকে। তাই আমাদের পাকিস্তানের দিকে দেখা উচিত নয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাদের এক্ষেত্রে একটি ভূমিকা আছে পালন করার জন্য এবং এখনও পর্যন্ত তা নেতিবাচক। আমাদের তা নিরপেক্ষ করতে যা যা করা দরকার, করতে হবে। আফগানিস্তানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাথমিকভাবে মানবাধিকারমূলক সহযোগিতা, পরিকাঠামোর পুননির্মাণের উপর নির্ভর করা উচিত যাতে তার ফলে আমাদের দেশের চারপাশে শান্তি এবং অগ্রগতি বহাল থাকে। আমরা অনুভব করি, শান্তিতে বিভেদ তৈরি করা যায় না এবং তা আমরা আমাদের চারপাশে শান্তির বাতাবরণ তৈরি করবই। পাকিস্তান একে এমন একটি সমীকরণ হিসাবে দেখে, যার মাধ্যমে এক থেকে অন্য উদ্দেশ্য তারা সাধন করতে পারবে। কিন্তু আমাদের একে খারিজ করতেই হবে।

প্রশ্ন- কিন্তু আফগান রাজনৈতিক পুনর্মিলনে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন না করার ব্যাপারে ভারতের সংকোচ আদৌ কি যুক্তিযুক্ত, বিশেষ করে তখন, যখন তা ধারাবাহিকভাবে এই রাওয়ালপিণ্ডি-কাবুল সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে থাকার উপর নির্ভরশীল?

অমর সিনহা- ১৮ বছর ধরে পাকিস্তান একটাই নীতি অনুসরণ করে এসেছে আর তার জন্য তাকে মানুষের প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার মতো বিরাট মূল্য চোকাতে হয়েছে। ভালো হোক বা মন্দ, তারা একটি নির্দিষ্ট পথেই বরাবর হেঁটে এসেছে। আজ তারা মনে করে, তারা ফিনিশিং লাইনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘটনা হল, তারা কী তালিবানকে ছেড়ে দেবে আফগানিস্তানে গিয়ে আফগানদের সঙ্গে পুনর্মিলন করতে এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীনভাবে দেশ চালাতে? একবার তালিবান কাবুলে ফিরে এসে যদি আফগানিস্তান-নির্ভর জাতীয় শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারে এবং বিশ্বের কাছে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, তাহলে ভারতের তাদের নিয়ে কোনও সংকোচ থাকবে না এবং ভারত নিজের নীতি অনুযায়ী চলবে। তালিবানও ভারতের উন্নয়নমূলক অংশীদারিত্বকে গত 18 বছর ধরে স্বাগত জানিয়ে এসেছে। কিছু ঘটনা যেমন দেলারম-জারাঞ্জ সড়কপথ যখন তৈরি হচ্ছিল, তখন কয়েক দফা হামলা হওয়া ছাড়া আফগানিস্তানে আমাদের উদে্যাগে হওয়া কোনও প্রকল্পে কখনও তালিবানের তরফে কোনও হামলা হয়নি। পার্লামেন্ট, সলমা বঁাধ প্রভৃতিতেও কখনও আক্রমণ হয়নি, যা আমাদের মাথায় রাখা দরকার।

প্রশ্ন- আর ভারতীয়দের অপহরণ?

অমর সিনহা- ভারতীয়দের অপহরণের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু এর পিছনে একাধিক স্থানীয় এবং অর্থনৈতিক কারণও ছিল যা তাদের এমন ঘটনা ঘটাতে বাধ্য করেছিল।

প্রশ্ন- ভারত কী সঠিক পদক্ষেপ করেছিল যখন এটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল COVID-19 চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে আফগানিস্তানে নিজেদের দুটি কনসু্লেট বন্ধ করে দেবে?

অমর সিনহা- খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিন পড়েই সম্প্রতি আমি এটা জানতে পেরেছি। হেরাট এবং জালালাবাদের অবস্থান দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি, এটা করা হয়েছে ভাইরাস সংক্রমণের আতঙ্কে। সংক্রমণের জেরে হেরাট বিপর্যস্ত ছিল এবং ইরান থেকে যেখানে যেখানে ভাইরাস ছড়িয়েছে, হেরাট ছিল তাদের অন্যতম। তাই এই পদক্ষেপের যে কারণ আমি জানি, তা COVID-এর সঙ্গেই সম্পর্কিত আর এগুলি সাময়িক পদক্ষেপ। আমরা অপেক্ষা করব এবং নজরে রাখব। লকডাউনের ফলে জালালাবাদ এবং হেরাটের মানুষের পাশে দাঁড়ানো কঠিন হবে। অতএব এটা কেবলমাত্র চিকিৎসাজনিত সতর্কতা হিসাবেই করা হয়েছে।

প্রশ্ন- দোহা থেকে কাবুলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আপনি কী আশ্বাস দিতে পারবেন যে তালিবান যদি ক্ষমতায় ফেরে তাহলে নয়ের দশকের শেষাশেষি যা পরিস্থিতি ছিল, তা আবার ফিরে আসবে না? এই মুহূর্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক কী কী?

অমর সিনহা: আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় এটাই থাকবে যে তালিবান একেবারেই নিজেদের বদলে ফেলবে না এবং 1996 সালে যে রকম পরিস্থিতি ছিল, সেই ছবি ফেরাতে চাইবে। তাহলে আফগান সমাজ গভীরভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং সেই পুরনো সময়ে ফিরে যাবে যখন ভয়াবহ সংঘর্ষ আর যুদ্ধবৎ পরিস্থিতি হামেশা লেগেই থাকত। এটাই সবচেয়ে খারাপ হবে। আমরা যেটা বুঝছি, সেটা হল তালিবান প্রকাশে্য যা বলছে কিংবা তাদের আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে যে দাবি জানাচ্ছে যে তারা আমূল বদলে গিয়েছে, যে তারা ক্ষমতার ভাগ পেতে রাজি নয়–এ সব কিন্তু এখনও প্রমাণ হয়নি। আলোচনার টেবিলে তাদের ফিরে আসতেই হবে এবং যারা, যেভাবে আলোচনার উদে্যাগ নিচ্ছে,তাতে তাদের অংশ নিতেই হবে। তার পর সেখান থেকে একটি ব্লু প্রিন্ট নিয়ে বেরোতে হবে। তালিবান কী কী চায় এবং কীভাবে দেশকে দেখতে চায়, সেই তালিকার কিছু কিছু অংশ ফাঁস হয়ে গেছে। কিন্তু তালিবান সেই তালিকা অস্বীকার করেছে। কিন্তু যদি তা সতি্য বলে ধরে নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তালিবানের কোনও বদল আসেনি। কিছু কিছু বিষয়ে তাদের স্পষ্ট কোনও অবস্থান নেই যেমন নারীদের অধিকার, গণতন্ত্র এবং আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের ভূমিকা। বাকি যা যা, আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগ সদর্থকভাবে আকর্ষণ করে নিয়েছে, তার মধে্য উল্লেখযোগ্য হল সন্ত্রাসের শিকড় কেটে ফেলা, হিংসায় ইতি, যা খুবই প্রতিশ্রুতিদায়ক। আমি শুধু আশা করব, তারা আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যেন খেলা না করে এবং মুখে যা বলছে, তা যেন স্রেফ কথার কথা হয়েই না থেকে যায়।

Last Updated : May 23, 2020, 3:30 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.