COVID-19 প্যানডেমিক এক ভয়ঙ্কর, ক্ষতিকারক ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে । আমাদের দেশে ভয়ঙ্কর এই প্রবৃত্তি শুরু হয়েছিল এপ্রিলের প্রথমদিকে ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিষয়টা সে ভাবে কারও নজরে পড়েনি । বিষয়টি মিডিয়া সংক্রান্ত এবং এটি আমাদের দেশের সাম্যের ক্ষতি করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তারও ক্ষতি করতে পারে ।
মার্চের মাঝামাঝি সময় দিল্লির নিজা়মউদ্দিনে 1927 সালে প্রতিষ্ঠিত রক্ষণশীল মুসলিম সংগঠন, তাবলিঘি জামাতের ধর্মসভা অনুষ্ঠিত হয় । তাতে যোগ দেওয়া বহু সংখ্যক বিদেশি এবং কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের যোগ নিয়ে সরগরম ছিল গোটা দেশ । মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম দিক পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোরোনা ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া শুরু হয় । এরপরই সেই আক্রান্তের সঙ্গে নিজা়মউদ্দিনের তাবলিঘি জামাত (TJ)-এর সভায় যোগ দেওয়া সদস্যদের সম্পর্ক নিয়ে লাগাতার প্রচার করতে থাকে অডিয়ো-ভিজ়ুয়াল মিডিয়া ।
খুবই দুঃখের বিষয় এই যে, 2020 সালের প্রথম দিকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) নিয়ে দেশ জুড়ে যে সাম্প্রদায়িক প্রতিবাদ নজরে এসেছিল, সেটাই এই বার আরও খারাপ ভাবে দেখা গেল অডিয়ো ভিজ়ুয়াল মিডিয়ার একাংশের মধ্যে । কোনও কোনও টিভি চ্যানেল এমন ভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে, যাতে কোরোনা সংক্রমণের ঘটনায় একটা সাম্প্রদায়িক রং লাগানো যায় । এপ্রিলের প্রথম দিকে তাবলিঘি-ভাইরাস ও কোরোনা-জিহাদের মতো শব্দবন্ধনী বহুল পরিমাণে প্রচারিত হতে থাকে সোশাল মিডিয়ায় । এমনকী কিছু রিপোর্ট এই পর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে দাবি করা হয় চিনের ইউহান নয়, এই ভাইরাস আসলে ছড়িয়েছে দিল্লির নিজ়ামউদ্দিন থেকে !
কিছু প্রধান টিভি চ্যানেল এবং খবরের এজেন্সি আরও এককদম এগিয়ে ভ্রান্ত খবর ছড়াতে থাকে ৷ যেখানে দাবি করা হয় জামাতের সেই সভায় যোগ দেওয়া ব্যক্তিদের নজরদারির জন্য হাসপাতালে রাখা হয়েছে এবং তাঁরা নাকি স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করছেন। এমনকী তাঁরা জনসমক্ষে মল-মূত্র ত্যাগ করছেন বলেও খবর ছড়িয়ে পড়ে । 24 মার্চ থেকে জারি হওয়া দেশজোড়া লকডাউনের নিয়ম যে তাবলিঘি জামাত জেনে-বুঝেই ভেঙেছে তা প্রমাণ করতে স্টিং অপারেশন চালায় একটি টিভি চ্যানেল।
যদিও কিছু দিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয় যে, এই সব রিপোর্টের কোনও ভিত্তি নেই । সোশাল মিডিয়ায় একাধিক তথ্য যাচাই ও সংগঠনের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে কী ভাবে জেনেবুঝে উঠেপড়ে লেগেছিল কিছু মিডিয়া । নিজা়মউদ্দিনে তাবলিঘির সভার সদস্যদের জন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধিনিষেধ না মানা এবং এই বিষয়টিকে সামনে রেখে সমগ্র মুসলিম সমাজকে ছোটো করার এক পরিচিত ছক ধরে এগিয়েছে মিডিয়ার একাংশ ।
COVID-19 নিয়ে জানাজানির পর যে পদ্ধতিতে মার্চের মাঝামাঝি সময় তাবলিঘি জামাত নিজা়মউদ্দিনে সভা করেছে, তার জন্য যাবতীয় দায় অবশ্যই তাবলিঘিরই । কিন্তু এই বিষয়ে মিডিয়ার একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিকেও অগ্রাহ্য করা যায় না । বড় জমায়েত বাতিল থেকে লক্ষণ রেখা টেনে দেওয়া— এ সবই প্রধানমন্ত্রী তাঁর 24 মার্চের বক্তৃতায় বলেছেন ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা বদ্ধ জায়গায় একসঙ্গে বহু সংখ্যক তাবলিঘি সদস্যদের জমায়েত জনস্বাস্থ্য নিয়মের পরিপন্থী, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই । আইন ভঙ্গের এই বিষয়টি মিডিয়ার অবশ্যই দেখা উচিত। যদিও এই প্রশ্নও সামনে এসেছে যে, এত বড় জমায়েতের অনুমতি কীভাবে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন দিল। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট তদন্তের । তবে সে দিনের সভায় আইন যে ভাঙা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। সে দিনের সভার অন্যতম আহ্বায়ক ও তাবলিঘি জামাত নেতা মওলানা সাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির 304 নম্বর ধারা প্রয়োগ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আনা হয়েছে ।
যদিও এটা দেখা গিয়েছে যে, তাবলিঘির জমায়েতের সেই সময়ের মধ্যে সারা দেশে একাধিক জমায়েত হয়েছে। এই সব জমায়েতের সঙ্গে রাজনীতি বা হিন্দু গোষ্ঠীর যোগও ছিল। কিন্তু এর কোনওটাই তেমন ভাবে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি, যতটা নিজ়ামউদ্দিনের তবলিঘি সভা করতে পেরেছিল । এই সব সভার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভোপালে সরকার পরিবর্তনের সময় হওয়া জমায়েত, লখনউয়ের রাম নবমী, তিরুপতি ও তিরুঅনন্তপুরমের সবেক জমায়েত এবং, মাত্র কয়েক দিন আগে কর্নাটকের চিৎপুর তালুকে সিদ্ধলিঙ্গেশ্বর যাত্রা।
জনস্বাস্থ্য এখন জাতীয় চ্যালেঞ্জ । আর এখন বিশ্বজুড়ে কোরোনা ভাইরাসের ত্রাসে জনস্বাস্থ্য এখন সমগ্র বিশ্বের কাছে হয়ে উঠেছে রীতিমতো চিন্তার বিষয় । তবে এই ভাইরাসের চরিত্র রীতিমতো গণতান্ত্রিক বলা যায় । এটি ছড়িয়ে পড়ছে একেবারে সাম্য বজায় রেখে। এর কাছে গরিব-ধনী, দেশ, জাত, ধর্মের কোনও বাছ বিচার নেই । তাই, এ কথা ভাবতে কোনও অসুবিধা নেই যে, তাবলিঘির এই জমায়েত ততটাই সমস্যার, যতটা ইস্টার রবিবারে খ্রিস্টানদের জমায়েত বা একই রকম কোনও হিন্দু আয়োজিত জমায়েত ।
দুঃখের বিষয় হল, বিগত কয়েক বছর ধরে মিডিয়ার একাংশ ঘৃণা ছড়িয়ে চলেছে । সংবিধানের প্রকৃত অর্থ তথা দেশভক্তি, জাতীয় স্বার্থের মতো বিষয়গুলি তারা যেন পালটে দিয়েছে। অসহিষ্ণুতা এবং নকল দেশপ্রেমের মাধ্যমে হিন্দুত্বের প্রচার আসলে আরও বেশি বিপজ্জ্নক ভাইরাস যা দেশের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে । তবে দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক হিন্দুদের বিশ্বাস এটা নয় । তাঁরা জামার কলারে জাত নিয়ে ঘোরেন না । সমালোচক মিডিয়ার থেকে এই অংশের মানুষের সংখ্যাটা অনেকটাই বেশি । ইসলামিক বিশ্বে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তাবলিঘি জামাত যথেষ্ট বড় নাম । এদের মত হল একজন প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসীকে তাঁর আসল মতবাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া । বহু আধুনিকমনস্ক মুসলিমদের কাছে এটি আসলে ‘তকলিফি’ জামাত— যারা সমস্যা তৈরি করে ।
তাই সন্ত্রাসবাদ ও কোরোনাকে একই চোখে দেখে এবং এগুলির সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়কে মিশিয়ে ফেললে দেশকে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে । মিডিয়া চাইলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অশান্তি বাধিয়ে দিতে পারে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল রোয়ান্ডার ভয়ঙ্কর ঘটনা । এটাই হল সেই লক্ষ্ণণ রেখা,যা ভারতের কখনওই পার করা উচিত নয়।