এক সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ সবাইকে চমকে দিয়েছে । যেখানে দেখা যাচ্ছে, দেশে বাতাসের মানের ক্রমশ পতন হচ্ছে আর প্রায় এক লাখ মানুষ প্রতিদিন শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্রান্ত অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন । জীবনদায়ী বাতাস শুধু বিষাক্ত এবং রোগের কারণই হয়ে দাঁড়াচ্ছে না, তা কমিয়ে দিচ্ছে আয়ুও ।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ‘এপিক’ স্টাডিতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে মানুষের গড় আয়ু প্রায় দুই বছর কমিয়ে দিচ্ছে বায়ুদূষণ। নাগরিকদের আয়ু কমছে গড়ে 5.2 বছর করে, যেখানে উত্তর ভারতে এটা প্রায় দশ বছর । লখনউয়ের মতো শহরে, বাতাসে জমা হওয়া আনুবীক্ষণিক কণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার থেকে 11 গুণ বেশি । যা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে বিপদ কতটা গুরুতর । কী করে আমরা এই তথ্যকে মেনে নেব যে , উত্তর কলকাতার মতো কোনও জায়গায় বসবাসকারী মানুষ প্রতিদিন 22 টি সিগারেট খাওয়ার সমান দূষণের শিকার হচ্ছেন ? দূষণ রাজধানী বলে পরিচিত দিল্লির থেকেও জিন্দ, বাঘপত, গাজ়িয়াবাদ, মোরাদাবাদ , সিরসা ও নয়ডায় বাতাসের মান আরও খারাপ, এবং যথেষ্ট ভীতিপ্রদ । বিশ্লেষণ বলছে যে , 66 কোটি ভারতীয়-র জীবনযাত্রার ক্ষতি করছে বায়ুদূষণ এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR) ঘোষণা করেছে যে , দেশে প্রতি আটটি মৃত্যুর একটি হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণেই । এই তথ্য শিকাগোর গবেষণাকেই সমর্থন করছে । আর এখনও পর্যন্ত এই পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি । ভারতে বায়ুদূষণ দুই দশকের কাছাকাছি সময় ধরে চলছে । এই সত্য উদঘাটনের মাধ্যমে এটা বোঝা যাচ্ছে যে , শিশুদের মধ্যে হাঁপানি এবং বড়দের মধ্যে পক্ষাঘাত ও ফুসফুসের ক্যানসার বেড়ে যাওয়ার উৎসটা আসলে কোথায় ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটার বাতাসে সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ 10 মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয় । নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির ক্ষেত্রে অযোগ্যতার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডগুলি হচ্ছে আসল অপরাধী । যার জন্য দেশের তিন ভাগ অংশের শহরগুলি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হচ্ছে । বাতাসের গুণের সূচক অনুযায়ী , সবথেকে বেশি ঝুঁকির মুখে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ । যার মধ্যে বাংলাদেশের পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সবথেকে দূষিত দেশ ভারত । এটা এমন একটা রেকর্ড যার জন্য গোটা দেশের লজ্জায় মাথা নিচু করা উচিত । আমাদের উচিত প্রতিবেশী চিন যেভাবে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে বহুমুখী লড়াই বা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে , তার অনুকরণ করা । তারা কয়লাভিত্তিক নতুন কারখানা তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছে, এবং আগে থেকে থাকা কারখানাগুলির ক্ষেত্রে দূষণের মাত্রা বেঁধে দিয়েছে । কয়েকটি ইস্পাত কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং যানবাহনও নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে । উত্তর চিনে বনসৃজন করা হচ্ছে , যাতে বছরে 25 টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ হয় এবং প্রতিদিন 60 কিলো অক্সিজেন নির্গত হয় । ফলে, সেখানকার বাতাসের মান উন্নত হয়েছে এবং দূষণ কমেছে । এখানকার ছবিটা কিছুটা বিপরীত । আগের সরকারগুলির প্রতিষ্ঠানগত শিথিলতার সংশোধন করে, মোদি সরকারের প্রস্তাবিত ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্ল্যান’ এখনও চালু হয়নি । তেল-চালিত যানবাহনের জায়গায় বৈদ্যুতিন যানের ব্যবহারকে উৎসাহিত করার ছবিটা আশাব্যাঞ্জক নয় । পরিবেশ বাঁচানোর উদ্যোগ এবং বায়ুদূষণজনিত মৃত্যু যে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত , সেটা অনুধাবন করে সরকারকে তার অগ্রাধিকার বদলাতে হবে । জনগণের সক্রিয় সহযোগিতাও পেতে হবে । যদি সামাজিক বনসৃজন করা যায়, অফিস এবং বাসস্থান কাছাকাছি আসে, শিল্প ও যানবাহনের দূষণ কড়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, ধাপে ধাপে বৈদ্যুতিন পরিবহন আনা হয়, এবং ব্যাপকভাবে সৌরশক্তি ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়, তাহলে বাতাসের মান উন্নত হয়ে দেশকে সুস্থ জীবন দেবে ।